মিয়ানমার সংকট
ক্ষমতা হারাতে যাচ্ছে জান্তা সরকার!
দেশটির থিংক ট্যাংক 'ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি'র (আইএসপি) তথ্য অনুযায়ী সামরিক বাহিনী এরই মধ্যে বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে ৪৩ শতাংশের বেশি জায়গা হারিয়েছে। থাইল্যান্ডভিত্তিক মিয়ানমারের সংবাদ মাধ্যম 'ইরাবতী'তে চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারিতে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী সামরিক বাহিনী এরই মধ্যে সারাদেশে ৩৩টি শহরের দখল হারিয়েছে, যা বর্তমানে নিয়ন্ত্রণ করছে বিদ্রোহী বাহিনীর সদস্যরা। এর মধ্যে চীন, সাকাই, কিয়াংপ্রদেশ, উত্তরাঞ্চলের শান ও শিন রাজ্য উলেস্নখযোগ্য....
প্রকাশ | ২৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
মিয়ানমার ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। সেই থেকে সাত দশকের বেশি সময় ধরে দেশটির অভ্যন্তরে চলছে সংঘাত। দীর্ঘসময় ধরে চলা সংঘাত সামাল দেওয়া গেলেও এবার হিমশিম খেতে হচ্ছে দেশটির ক্ষমতাসীন জান্তা বা সামরিক শাসকদের। বিভিন্ন সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর একের পর এক হামলায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে দেশটির সামরিক বাহিনী। প্রতিদিনই গণমাধ্যমে শিরোনাম হচ্ছে- বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে প্রদেশ হারানো ও প্রতিবেশী দেশে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পালিয়ে আশ্রয় নেওয়ার খবর। প্রশ্ন উঠছে কেন চলছে এই সংঘাত, তবে কি ক্ষমতা হারাতে যাচ্ছে জান্তা সরকার?
সংঘাত কেন?
স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৬২ সালে দেশটির ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী। ২০১৫ সালের নির্বাচন পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল সামরিক সরকার। ২০১৫ সালের ওই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে নোবেল পাওয়া অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)। ২০২০ সালের নির্বাচনে দলটির ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিজেদের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে সামরিক শাসকরা। ফলে ২০২১ সালের ১ ফেব্রম্নয়ারি অভু্যত্থানের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতা নিজেদের দখলে নেয় সামরিক বাহিনী। তবে এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি দেশটির সাধারণ জনগণ। প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এলে কঠোর হাতে তাদের দমন শুরু করে সামরিক শাসকরা।
২০২৩ সালে 'হিউম্যান রাইটস ওয়াচ'র দেওয়া এক প্রতিবেদন অনুযায়ী অভু্যত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সারাদেশে ক্র্যাকডাউন চালায়। এতে ১৬ হাজারের বেশি গণতন্ত্রকামী মানুষকে নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী পুলিশ হেফাজতে মৃতু্য হয় ২৭৩ জনের। এ ছাড়া গণহত্যা, গ্রেপ্তার, অত্যাচার ও যৌন সহিংসতাসহ অন্য নিপীড়নের কথা প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়েছে।
'অপারেশন ১০২৭'
২০২১ সালে ক্ষমতা দখলের পর সামরিক জান্তার তিন বছর পূর্ণ হতে চলেছে আগামী ১ ফেব্রম্নয়ারি। তবে প্রথম আড়াই বছর সামরিক বাহিনী দমন-পীড়নের মাধ্যমে যতটা সহজে তাদের ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছে, পরে সেই দৃশ্য অনেকটাই বদলে গেছে।
২০২১ সালের এপ্রিলেই ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) নেতৃত্বে নির্বাচনে জয়ী সদস্যরা জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করে, যাকে সংক্ষেপে বলা হয় 'এনইউজি'। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরাও এতে যোগ দেয়। সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে থাকা বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে মিলে তারা প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে এবং সব গোষ্ঠীর সমন্বয়ে তৈরি করে 'পিপল ডিফেন্স ফোর্স'। সামরিক বাহিনীর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহীরা সক্রিয় থাকলেও এটি নতুন মাত্রা পায় উত্তরাঞ্চলের তিনটি বিদ্রোহী বাহিনীর একাট্টা হয়ে আক্রমণ শুরুর পর।
২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর একজোট হয়ে হামলা চালায় দেশটির উত্তরের জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু তিনটি বিদ্রোহী বাহিনী, যাদের একসঙ্গে ডাকা হচ্ছে 'থ্রি গ্রম্নপ অ্যালায়েন্স' নামে। ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এবং আরাকান আর্মি (এএ) নিয়ে এই জোট গঠন করা হয়েছে। তারা এর নাম দেয় 'অপারেশন ১০২৭'।
এ ছাড়া শত শত স্বেচ্ছাসেবী জাতিগত বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেয়। তাদের সঙ্গে অস্ত্রে সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে দুই বছরের আপাত অচলাবস্থার অবসান ঘটে। সামরিক বাহিনীকে এই মুহূর্তে নানা ধরনের হামলার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আর তা কেবল একটি জায়গাতেই না, বরং দেশব্যাপী।
দখল হারাচ্ছে সামরিক বাহিনী
বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হামলায় চলতি বছরের প্রথম সপ্তাহেও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পশ্চাদপসরণ অব্যাহত রয়েছে। দেশটির থিংক ট্যাংক 'ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি'র (আইএসপি) তথ্য অনুযায়ী সামরিক বাহিনী এরই মধ্যে বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে ৪৩ শতাংশের বেশি জায়গা হারিয়েছে।
থাইল্যান্ডভিত্তিক মিয়ানমারের সংবাদ মাধ্যম 'ইরাবতী'তে চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারিতে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী সামরিক বাহিনী এরই মধ্যে সারাদেশে ৩৩টি শহরের দখল হারিয়েছে, যা বর্তমানে নিয়ন্ত্রণ করছে বিদ্রোহী বাহিনীর সদস্যরা। এর মধ্যে চীন, সাকাই, কিয়াং প্রদেশ, উত্তরাঞ্চলের শান ও শিন রাজ্য উলেস্নখযোগ্য।
অক্টোবরে হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে হাজার হাজার সেনা তাদের সরঞ্জাম নিয়ে বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। সারাদেশে বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে সেনাবাহিনী ৪০০-এর বেশি সীমান্ত চৌকি হারিয়েছে। এর মধ্যে সামরিক বাহিনীর আঞ্চলিক কার্যক্রম চালানোর অফিসও রয়েছে।
এদিকে রাস্তায় অতর্কিত হামলা থামাতে ব্যর্থ সামরিক বাহিনী তাদের সীমিত সংখ্যক হেলিকপ্টারের ওপর নির্ভর করে ঘাঁটিগুলোতে রসদ পাঠাচ্ছে। তাতেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। চলতি মাসে সামরিক বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার এবং একটি যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কাচিন রাজ্যের বিদ্রোহীরা।
সংকট বাড়ার কারণ কী?
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে গৃহযুদ্ধ চলমান থাকলেও এবারের সংকট নজিরবিহীন। স্থানীয় সাংবাদিকদের মতে, মিয়ানমারের সংকট গভীর হওয়ার প্রধান কারণ অভু্যত্থানের বিরুদ্ধে জনসাধারণের সক্রিয় প্রতিবাদ।
২০১৫ সালে গণতান্ত্রিক উপায়ে এনএলডি ক্ষমতায় এলেও দেশের ওপর সার্বিক ক্ষমতা ছিল না দলটির। আর তার কারণ ২০০৮ সালের সংবিধান। এই সংবিধান অনুযায়ী দেশটির পার্লামেন্টের অন্তত ২৫ শতাংশ আসন সামরিক বাহিনীর জন্য বরাদ্দ থাকবে। একই সঙ্গে কোনো আইন পাস করতে হলে অন্তত একজন সামরিক সদস্যের সম্মতি থাকতে হবে। অভু্যত্থানের পর এসব সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত ক্ষমতা ছাপিয়ে সম্পূর্ণ ক্ষমতা সামরিক শাসকের হাতে চলে যায়।
তবে 'পিপল ডিফেন্স ফোর্স' তৈরি হওয়ায় সামরিক বাহিনীর জন্য চ্যালেঞ্জ অনেকখানি বেড়ে যায়। সব গোষ্ঠীর সমন্বয়ে তৈরি করা 'পিপল ডিফেন্স ফোর্সে' অংশ নেয় জনসাধারণ। সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে থাকা সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঙ্গে তারা প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে। এতে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে একের পর এক সংগঠিত হামলায় দেশটির অভ্যন্তরে উত্তেজনা বেড়েছে।
এ ছাড়া আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে অনাগ্রহকে সংকট গভীর হওয়ার দ্বিতীয় কারণ হিসেবে মনে করেন আয় থু সান নামে স্থানীয় এক সাংবাদিক। তিনি জানান, শান্তি আলোচনার জন্য সামরিক বাহিনী কিংবা বিদ্রোহী বাহিনীর কেউই এখন পর্যন্ত প্রস্তুত না। অন্য সময়গুলোতে কোনো সংকটের সমাধানে সাধারণত সেনাবাহিনীর প্রধানই অপর পক্ষকে গোলটেবিল বৈঠকে ডেকে থাকেন। তবে এবার তেমনটা দেখা যায়নি।
সামরিক শাসক মিন অং হ্লাইং বলেছেন, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনায় যেতে তিনি রাজি নন। তার এ ধরনের মনোভাবের কারণে আলোচনা শুরুই করা যায়নি। অন্যদিকে জান্তাবিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীও সাফ জানিয়ে দিয়েছে, কোনোভাবেই তারা সামরিক শাসকদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি নয়। ফলে সামরিক শাসকের ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া ছাড়া এই সংকট নিরসনের কোনো সুযোগ আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
লড়তে চায় না সেনারা
গত বছরের নভেম্বর মাসে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের প্রেসিডেন্ট সতর্ক করে বলেছিলেন, দেশটির শান রাজ্যে শুরু হওয়া যুদ্ধ সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পুরো দেশই ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। 'ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স'র বিদ্রোহীদের উত্তর শান রাজ্যের বিশাল এলাকা দখলের কথা উলেস্নখ করে এ কথা বলেন তিনি। উলেস্নখ্য, জোটের তিনটি জাতিগত সশস্ত্র বাহিনী এখন চীনের সঙ্গে সীমান্তের বেশিরভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে।
এদিকে বিদ্রোহী গোষ্ঠী 'আরাকান আর্মি' সম্প্রতি মিয়ানমারের চীন রাজ্যের পালেতোয়া অঞ্চলটি দখল করে নিয়েছে। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটারের মতো দূরত্বে এই এলাকাটি বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের সীমান্তের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে শত শত সেনা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা বেছে নিয়েছে। যুদ্ধ না করেই হাজার হাজার সেনা আত্মসমর্পণ করেছে। সবশেষ চলতি সপ্তাহেও নতুন করে ২৭৮ জন মিয়ানমারের সেনা ভারতের মিজোরামে পালিয়ে গেছে।
নভেম্বর থেকে দফায় দফায় প্রায় ৬০০ জন সেনা সদস্য এভাবেই মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের অনেককে আবার ফেরতও পাঠানো হয়েছে। এর আগে শান রাজ্যে পরাজিত ছয় জেনারেলকে তাদের অপহরণকারীদের সঙ্গে পানীয় পান করতে দেখা যায়। সেখানে তাদের মধ্যে অপমানবোধের চেয়ে স্বস্তিই বেশি দেখা যাচ্ছিল। তবে সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করার পর তাদের মধ্যে তিনজনকে মৃতু্যদন্ড ও তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়। অন্যদের হাল ছেড়ে দেওয়া থেকে বিরত রাখতেই এটা করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানের ৭৫ বছরের দীর্ঘ ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন। সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়েছে। এ অবস্থায় নতুন সদস্য সংগ্রহের কাজটি বেশ কঠিন। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ