ইসরাইলি আগ্রাসন

গাজায় নিহতের সংখ্যা ছাড়াল ২৬ হাজার

ত্রাণের জন্য অপেক্ষারত ফিলিস্তিনিদেরও ছাড় দিচ্ছে না ইসরাইলি বাহিনী গাজার ক্ষুধার্ত মায়েদের বুকে দুধ নেই, অনাহারে শিশুরা

প্রকাশ | ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
চোখের সামনে বহু মানুষকে নিহত হতে দেখেছে সে। ধ্বংস হতে দেখেছে ঘরবাড়ি। এখনো সে বেঁচে আছে। কিন্তু জানে না, একটু পর বেঁচে থাকবে কিনা। কারণ ইসরাইল প্রতিনিয়ত বিমান হামলা চালাচ্ছে গাজায়। হামলা চালাতে ধেয়ে আসা এক ইসরাইলি বিমানের দিকে নির্বিকার তাকিয়ে আছে ফিলিস্তিনি এই বালকটি। ছবিটি বৃহস্পতিবার দক্ষিণ গাজা রাফাহ থেকে তোলা -আল-জাজিরা
ইসরাইলি বাহিনীর আগ্রাসনে গত সাড়ে তিন মাসে গাজায় নিহতের মোট সংখ্যা ২৬ হাজার ছাড়িয়েছে। এই সংখ্যা ২৬ হাজার ৮৩ জনে পৌঁছেছে। এই নিহতদের পাশাপাশি মোট আহত হয়েছেন আরও ৬৪ হাজার ৪৮৭ জন। এ ছাড়া গত ইসরাইলি বাহিনীর বোমায় গত ২৪ ঘণ্টায় গাজায় নিহত হয়েছেন ১৮৩ জন ফিলিস্তিনি এবং আহত হয়েছেন ৩৭৭ জন। শুক্রবার এক বিবৃতিতে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তথ্যসূত্র : এএফপি, আল-জাজিরা, বিবিসি, রয়টার্স এর আগে গাজায় ত্রাণ বা মানবিক সহায়তার জন্য অপেক্ষারত ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। এতে অন্তত ২০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৫০ জন। যুদ্ধবিধ্বস্ত উত্তর গাজার কুয়েত মোড়ে এ হামলার ঘটনা ঘটেছে। ইসরাইলি ট্যাংক থেকে ওই এলাকায় ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্য করে গোলা ও গুলি ছোড়া হয়। গাজায় হামাস ও ইসরাইলি বাহিনীর মধ্যে তুমুল লড়াই চলছে। বিশেষ করে খান ইউনিসে। সম্প্রতি গাজার অনেক গভীরে অভিযান শুরু করেছে ইসরাইল। ফলে অবরুদ্ধ উপত্যকা থেকে রকেট হামলা কমেছে উলেস্নখযোগ্য হারে। গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলের ইরেজ সীমান্তে অতর্কিত হামলা চালিয়ে সামরিক-বেসামরিক ইসরাইলি ও বিদেশি নাগরিকসহ এক হাজার ২০০ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করে গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাসের যোদ্ধারা। সেই সঙ্গে জিম্মি হিসেবে ধরে নিয়ে যায় আরও ২৪০ জন ইসরাইলি এবং অন্য দেশের নাগরিককে। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর গত ৭৫ বছরের ইতিহাসে সেদিন প্রথম একদিনে এতজন মানুষের হত্যা দেখেছে ইসরাইল। সেই হামলার জবাবে সেদিন থেকেই গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরাইলি বিমান বাহিনী এবং তার এক সপ্তাহ পর বিমান বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয় স্থল বাহিনীও। সেই অভিযানেই নিহত হয়েছেন এই ২৬ হাজার ৮৩ জন। নিহতদের একটি বড় অংশই নারী, শিশু এবং কিশোর-কিশোরী। গত ২৫ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঘোষিত এক মানবিক বিরতির সময় ১০৮ জন জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে হামাস। তবে এখনো এই গোষ্ঠীটির হাতে আটক রয়েছেন ১৩২ জন জিম্মি। এই জিম্মিদের ছাড়িয়ে আনতে ফের একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তুতি চলছে। তবে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, হামাসকে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করার আগ পর্যন্ত গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর অভিযান বন্ধ হবে না। এদিকে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি বলেছেন, অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার চলমান সংঘাত থেকে বোঝা যাচ্ছে, জাতিসংঘ ও বিশ্বের অন্যান্য সংস্থা তাদের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। একটি নতুন পরিচ্ছন্ন বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য মুসলিম বিশ্ব ও অন্যান্য দেশকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। ইসরাইলকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার আহ্বানও জানিয়েছেন ইব্রাহিম রাইসি। তিনি বলেন, ইসরাইলকে এভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেললেই তাদের আগ্রাসন ও হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা সম্ভব হবে। গাজার ক্ষুধার্ত মায়েদের বুকে দুধ নেই, অনাহারে শিশুরা ইসরাইলের কড়া অবরোধ ও নির্বিচার হামলার মুখে থাকা ফিলিস্তিনি ছিটমহল গাজার অপুষ্টিতে ভোগা মায়েরা যে শিশুকে জন্ম দিচ্ছেন তারা অসুস্থ হয়েই জন্মাচ্ছে, ক্ষুধার্ত মায়েদের বুকে দুধ তৈরি হচ্ছে না আর তাতে নবজাতকরা ওজন হারাচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। রাফাহ হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডে শিশুরোগের চিকিৎসক জাবর আল-শায়ের একটি নবজাতককে দেখান, জন্মের পর যার ওজন ছিল সাড়ে সাত কেজি, মাত্র দেড় মাসের মধ্যে শিশুটি দুই কেজি ওজন হারিয়ে এখন সাড়ে পাঁচ কেজি হয়েছে। আল-শায়ের বলেন, 'এটা খারাপ। এটা তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সব সময় ওর বুকে জ্বালা হচ্ছে আর পেট ব্যথা করছে।' শিশুটির মা শরুক শাবান তার সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ান, কিন্তু তিনি নিজেই খেতে পান না। দক্ষিণ গাজার অধিকাংশ মানুষের মতো তিনিও অল্প একটু রুটি ও টিনজাত খাবারের ওপর বেঁচে আছেন। চিকিৎসকরা আরও জানিয়েছেন, আহত রোগীরা ক্ষুধার কারণে দুর্বল হয়ে পড়ায় সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধও গড়ে তুলতে পারছেন না। ইসরাইলের হামলায় গাজার উত্তরাঞ্চল প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। কারও পক্ষে সেখানে যাওয়াও অত্যন্ত কঠিন। সেখানে ত্রাণ সহায়তাও বিরল। কখনো ত্রাণ পৌঁছলে ক্ষুধার্ত ও বেপরোয়া ফিলিস্তিনিরা সেগুলো ঘিরে ধরে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। ত্রাণকর্মীরা জানিয়েছেন, সেখানে তারা ক্ষীণ হয়ে যাওয়া লোকজনকে দেখেছেন, চোখ-মুখ শুকিয়ে যাওয়া এসব লোকের দেখেই বোঝা যায় এরা ক্ষুধার্ত। ছোট্ট ফিলিস্তিনি ভূখন্ড গাজার সব জায়গায় ক্ষুধা ছড়িয়ে পড়েছে। এর ২৩ লাখ বাসিন্দার সবাই ক্ষুধার্ত। তারা গত ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইলের অবিরাম বোমা হামলার মধ্যে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। চলতি সপ্তাহে জাতিসংঘ সতর্ক করে বলেছে, ভূখন্ডটির অনেক এলাকা এরই মধ্যে দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন। গাজার মিশরীয় সীমান্তের নিকটবর্তী এলাকাগুলো আমদানি করা খাবারের সীমিত সরবরাহ পেলেও ভূখন্ডটির উত্তর ও মধ্যাঞ্চল দুর্ভিক্ষের মুখে আছে বলে আন্তর্জাতিক ত্রাণ কর্মীরা জানিয়েছেন। এই দুটি এলাকায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস ও ইসরাইলি বাহিনীর মধ্যে প্রচন্ড লড়াই চলছে।