রাম মন্দিরের উদ্বোধন

ধর্মীয় বিভাজনে ভীত অযোধ্যার মুসলমানরা

প্রকাশ | ২৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
বাবরি মসজিদ ভাঙছেন আরএসএস কর্মীরা -ফাইল ছবি
গত কয়েক বছর ধরে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ধর্মীয় বিভাজন-নীতি যেভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠছে, রাম মন্দির উদ্বোধনের পর থেকে তা আরও প্রকট হওয়ার আশঙ্কা করছেন অযোধ্যার মুসলমানরা। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন বিজেপির ৫০ বছরের প্রকল্প অযোধ্যার রাম মন্দির উদ্বোধন হয়েছে সোমবার। তথ্যসূত্র : বিবিসি, সিএনএন ভারতের বৃহত্তম রাজ্য উত্তরপ্রদেশের ছোট শহর অযোধ্যায় শ্রীরাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে বিশ্বাস সনাতন ধর্মাবলম্বীদের, যিনি এই ধর্মের অন্যতম অবতার। 'রামের জন্মভূমি' বলে পরিচিত অযোধ্যায় অতীতে বিশাল একটি রাম মন্দির ছিল বলেও তথ্য পাওয়া যায় বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রে। মুঘল সাম্রাজ্যের স্থপতি সম্র্রাট জহিরউদ্দিন মোহম্মদ বাবরের নির্দেশে তার সেনাপতি মির বাকি সেখানে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন, যা পরিচিতি পায় 'বাবরি মসজিদ' নামে। মুঘল আমলের শেষে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল শুরু হওয়ার পর ১৯৮৫ সালে প্রথম মসজিদ ভবনের বাইরে দেবতা শ্রীরামের শৈশবকালীন মূর্তি 'রামলালা' স্থাপনের অনুমতি চেয়েছিলেন জনৈক হিন্দু সাধু মোহন্ত রঘুবীর দাস, কিন্তু তার সেই আবেদন খারিজ হয়ে গিয়েছিল। তারপর প্রায় ১০০ বছরের বেশি সময় এই নিয়ে দ্বন্দ্ব-বিতর্ক চলার পর ১৯৯২ সালে বিজেপির অভিভাবক সংস্থা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) নেতৃত্বে একদল উগ্র করসেবক (আরএসএসের কর্মী বাহিনী) বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলে। ওই ঘটনার জেরে ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয় ভারতে এবং সেই দাঙ্গায় নিহত হয়েছিলেন অন্তত দুই হাজার মানুষ। নিহতদের মধ্যে ছিলেন হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ। বর্তমানে অযোধ্যায় বসবাস করেন ৩০ লাখের বেশি মানুষ, তাদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ৩২ বছর পর সোমবার নতুন প্রতিষ্ঠিত রাম মন্দিরের উদ্বোধনের পর ভারত জুড়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজন আরও প্রকট হবে কি-না, এমন আশঙ্কায় ভুগছেন অনেক ভারতীয় মুসলমান। অযোধ্যার বাসিন্দা ৬৫ বছর বয়সি মাওলানা বাদশাহ খান জানিয়েছেন, ৩২ বছর আগের সেই দাঙ্গার ক্ষত এখনো ভুলতে পারেননি অনেক মুসলমান। মন্দির উদ্বোধনের দিন বাড়ি থেকে বের হবেন না বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। বাদশাহ খান বলেন, 'আমরা যতই নীরব থাকি না কেন, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ক্ষত কখনো শুকাবে না। নতুন ভারতে মুসলমানদের অবস্থান আসলে কোথায়, রাম মন্দির তার সর্বশেষ উদাহরণ।' রাম মন্দিরের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে রাজনীতি, অর্থনীতি, ক্রীড়া, বিনোদনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ ও সেলিব্রিটিসহ সাত হাজারের বেশি মানুষকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল বিজেপি। আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে মুসলমান ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের নেতারাও ছিলেন। মন্দিরের জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান অনেক মুসলমানের মনে আতঙ্ক ধরাচ্ছে বলে জানিয়েছেন অযোধ্যার মুসলমানদের স্থানীয় নেতা আজম কাদরি। তিনি বলেন, 'যখনই অযোধ্যায় নতুন লোকজনের আগমন ঘটে, তখন আমরা আতঙ্কিত হই। ৩২ বছর আগের দাঙ্গায় হারিয়ে যাওয়া স্বজন, সঞ্চয় ও পরিচিতির স্মৃতি আমাদের মনে পড়ে যায়। সবকিছু ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করা খুব সহজ কাজ নয়।' ১৯৯২ সালের দাঙ্গায় নিজের পরিবারের দুই সদস্যকে হারানো হাজি মাহবুব বলেন, 'গত কয়েক বছর ধরে যে হারে হিন্দু-মুসলমান বিভাজন দেখা দিয়েছে, আমার ভয় হচ্ছে হয়তো আর কিছুদিন পর অযোধ্যা থেকে মুসলমানদের বহিষ্কার করা হবে। অযোধ্যা থেকে নির্বাচিত ক্ষমতাসীন বিজেপির এমপি লালস্নু সিং অবশ্য এই আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, 'সবার নিরাপত্তা দেওয়া হবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কারও আশঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।' তার কথায়, 'যেভাবে অযোধ্যার অন্য বাসিন্দারা থাকছেন, সংখ্যালঘুরাও সেভাবেই থাকেন, থাকবেন। নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতির পরিবেশ বজায় রাখি আমরা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী (নরেন্দ্র মোদি) তো যা কাজ করছেন, সবার উন্নতির জন্যই করছেন। সেখানে কেউ এটা বলতে পারবে না যে, এই ধর্মের মানুষের জন্য বাড়তি কিছু করা হয়েছে বা অন্য ধর্মের জন্য কম করা হয়েছে। আমাদের সংগঠন কখনই আমাদের বলেনি যে, কারও থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলো, কারণ ভারতের নাগরিক তো সবাই।' তবে এমপির কথায় তেমন ভরসা পাননি হাসান আলি। ১৯৯২ সালের ভয়াবহ দাঙ্গার সময় নিজের পরিবার-পরিজনকে হারিয়েছেন তিনি। আত্মরক্ষার জন্য স্থায়ী পুলিশ স্টেশনে আশ্রয় নেওয়া হাসান আলির বয়স সে সময় ছিল মাত্র ৯ বছর। তিনি বলেন, '১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সে সময় স্থানীয় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবও ছিল। এমনকি দাঙ্গার সময় মুসলমানদের বাঁচাতে স্থানীয় হিন্দুরা এগিয়ে এসেছেন, এমন শত শত উদাহরণ রয়েছে। স্থানীয় হিন্দুরা এগিয়ে না এলে নিহতের সংখ্যা আরও বাড়ত।' তিনি আরও বলেন, 'কিন্তু এখনকার বাস্তবতা ভিন্ন। গত প্রায় দুই দশক ধরে মানুষের মনে যেভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢোকানো হয়েছে, তাতে কার মনে কী চিন্তা চলছে, তা আর এখন বোঝার উপায় নেই। সামনের দিনগুলোতে কী হবে, তাও বলার উপায় নেই।'