ইরান-পাকিস্তান পাল্টাপাল্টি হামলা
আলোচনায় জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ আল-আদল
ম এই গোষ্ঠীটি নিজেদের ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে 'সুন্নি অধিকার রক্ষক' হিসেবে বর্ণনা করে থাকে। ২০০৯ সালে ইরান আবদলমালেক রিগি নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে। তিনি এই জঙ্গিগোষ্ঠীটির প্রধান। এর আগে এই গোষ্ঠীটি জানদালস্নাহ বা আলস্নাহর যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত ছিল... ম পাকিস্তান তার ভূখন্ডের অখন্ডতার বিষয়ে কোনো ছাড় দিতে পারবে না। কিন্তু একই সঙ্গে তারা আরেকটি যুদ্ধক্ষেত্র উন্মুক্ত করতে চায় না। ভারত ও আফগানিস্তানের সঙ্গে এরই মধ্যে তাদের সম্পর্ক খারাপ। ইসলামাবাদ আরেক প্রতিবেশীর সঙ্গেও সম্পর্ক খারাপ করতে চাইবে না...
প্রকাশ | ২০ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী জাইশ আল-আদলকে লক্ষ্য করে ইরান গত মঙ্গলবার হামলা চালানোর পর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে, মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাত সীমানা ছাপিয়ে অন্য এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। পাকিস্তানের সরকার নিশ্চিত করে বলেছে, ওই হামলায় দুটি শিশু নিহত হয়েছে এবং তিনজন আহত হয়েছে। তারা বলেছে, মঙ্গলবারের এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা 'সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য'। একই সঙ্গে 'কোনো ধরনের উসকানি ছাড়াই' আকাশসীমা লঙ্ঘনের এ ঘটনার বদলা নেওয়া হতে পারে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
এরপর পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার এক দিন কাটতে না কাটতেই ইরানের অভ্যন্তরে হামলা চালায় পাকিস্তান। দেশটি বলছে, ইরানের অভ্যন্তরে ঘাঁটি গেঁড়ে বসা পাকিস্তানবিরোধী জঙ্গিগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে সেখানে হামলা চালানো হয়েছে। পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, বৃহস্পতিবার সকালে ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানা লক্ষ্য করে সুসংগঠিত এবং নির্ভুল সামরিক হামলা পরিচালিত হয়েছে।
ইরান দাবি করেছে, জইশ আল-আদল নামে একটি সুন্নি জঙ্গিগোষ্ঠী পাকিস্তান-ইরান সীমান্তে সক্রিয়। আমেরিকা ও ইসরাইল তাদের মদদ দিয়ে যাচ্ছে। অতীতে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর কয়েকটি হামলার দায় স্বীকার করেছে এই গোষ্ঠীটি।
ভৌগোলিক বিচারে পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশ বেলুচিস্তানের সঙ্গে ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান এবং আফগানিস্তানের নিমরুজ, হেলমান্দ ও কান্দাহার প্রদেশের সীমান্ত রয়েছে। জইশ আল-আদেল মূলত সিস্তান বেলুচিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী। বিগত সময়ে কয়েকবার পাকিস্তানের বেলুচিস্তান থেকে ইরানের সামরিক বাহিনী ও আইআরজিসিকে লক্ষ্য করে হামলার রেকর্ড রয়েছে এই গোষ্ঠীটির।
জইশ আল-আদল বা
'ন্যায়বিচারের যোদ্ধা'
ইরান-পাকিস্তানের পাল্টাপাল্টি হামলার পর আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে জইশ আল-আদল নামে এই জঙ্গিগোষ্ঠীটি। জইশ আল-আদল বা 'ন্যায়বিচার ও সমতার পক্ষে যোদ্ধা' হচ্ছে একটি জঙ্গিগোষ্ঠী, যারা ইরানের সরকারের বিরোধিতা করে। এই গোষ্ঠীটি নিজেদের ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে 'সুন্নি অধিকার রক্ষক' হিসেবে বর্ণনা করে থাকে। ২০০৯ সালে ইরান আবদলমালেক রিগি নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে। তিনি এই জঙ্গিগোষ্ঠীটির প্রধান। এর আগে এই গোষ্ঠীটি জানদালস্নাহ বা আলস্নাহর যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত ছিল।
আবদলমালেক রিগির বিরুদ্ধে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর বোমা হামলা চালানো এবং যুক্তরাজ্য ও আমেরিকার এজেন্ট হিসেবে কাজ করার অভিযোগ আনা হয়। ২০১০ সালে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃতু্যদন্ড দেওয়া হয়। সে সময় ইরানে নিয়োজিত থাকা পাকিস্তানের সাবেক কূটনীতিক মোহাম্মদ আব্বাসি বলেছিলেন, রিগির গ্রেপ্তারে পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
আমেরিকার গোয়েন্দারা বলছেন, ইরানে বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণ এবং হামলার পেছনে জইশ আল-আদলের হাত রয়েছে। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য একটি হচ্ছে ২০০৫ সালে দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদের ওপর হামলা। জইশ আল-আদল যেসব হামলার দায় স্বীকার করেছে, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে চালানো হয়েছে।
ইরান কেন পাকিস্তানে হামলা চালাল?
ইরানের সামরিক বাহিনী বা রিভলিউশনারি গার্ড কোর ইরাক এবং সিরিয়ায় বিভিন্ন লক্ষ্যে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা চালানোর পরের দিনই এই বিমান হামলা চালানো হয়। পাকিস্তানের সাবেক মন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ মুশাহিদ হুসাইন সাইদ বলেন, এই পদক্ষেপ পাকিস্তানের জন্য বিস্ময়কর ছিল। তিনি বলেন, 'আমার বিশ্লেষণ অনুযায়ী আপাতত দেখে মনে হচ্ছে, এটা ইরানের সামরিক বাহিনী রিভলিউশনারি গার্ড কোরের গোপন অভিযান এবং এটি অবশ্যই আরও বিস্তৃতভাবে দেখার সুযোগ রয়েছে।' তিনি আরও দাবি করেন, এই হামলা দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও আন্তর্জাতিক প্রটোকলের লঙ্ঘন। একই সঙ্গে এটি এমন এক সময় ইসলামী ঐক্যের চেতনাকে ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা যখন গাজায় একটি গণহত্যা চালানো হচ্ছে। সাইদ বলেন, ইসরাইলের প্রতি হতাশা প্রকাশ করার পরিবর্তে তেহরান ২৪ ঘণ্টায় তিনটি মুসলিম দেশের ওপর হামলা চালিয়েছে। এ ধরনের ভন্ডামি এবং দ্বিচারিতার তীব্র নিন্দা করা উচিত।
পাকিস্তান-ইরান উত্তেজনা
ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যকার সম্পর্কে সুসময় ও দুঃসময় দুটোই ছিল। ইরানই প্রথম দেশ হিসেবে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং বিদেশে পাকিস্তানের প্রথম দূতাবাসও ইরানে স্থাপন করা হয়েছিল। স্নায়ুযুদ্ধের সময় দুই দেশ পরস্পরকে সহায়তা করেছে এবং ভূ-রাজনীতিতে তারা ব্যাপকভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তেহরান ইসলামাবাদকে সমর্থন দিয়েছিল। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সশস্ত্র লড়াই ১৯৬৫ সালের আগস্টে শুরু হয়ে ওই বছরেরই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলেছিল।
১৯৭৯ সালের ইরান বিপস্নব ও পাকিস্তানে সৌদি-অনুপ্রাণিত 'ওয়াহাবি' ধারার ইসলাম চর্চা বাড়তে থাকলে ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়তে থাকে। ১৯৯০-এর দশকে পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িকতা এবং শিয়া ছায়াযুদ্ধে উসকানি দেওয়ার জন্য ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়। আর অন্যদিকে এ সময় কাবুলভিত্তিক তালেবান সরকারকে ইসলামাবাদের সমর্থন দেওয়া নিয়ে অস্বস্তি ছিল তেহরানের।
ভারতের সঙ্গে ইরানের সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং ওয়াশিংটনের সঙ্গে পাকিস্তানের কৌশলগত মিত্রতা বাড়ানোর বিষয়টি দুই দেশকে পরস্পর থেকে আরও দূরে সরিয়ে দিয়েছে। ২০১৮ সালে ইরান যখন চাবাহার নামে দেশটির সমুদ্র বন্দরের একাংশের নিয়ন্ত্রণ দিলিস্নর হাতে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তি সই করে, তখন ইসলামাবাদ এটি নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানে এই বিষয়টিকে গোওয়াদার বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব কমিয়ে আনতে ভারত ও ইরানের একটি পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়েছিল। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে গোওয়াদার বন্দর। এত সব অবনতির মধ্যেও দুই দেশ বড় কোনো দ্বন্দ্বে জড়ায়নি। আবার তারা তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পূর্ণ সম্ভাবনাকে কখনো ব্যবহারও করেনি।
ইসলামাবাদের 'ইন্সটিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ'র গবেষণা ফেলো আরহামা সিদ্দিকা বলেন, ২০২১ সাল থেকে দুই দেশের সম্পর্ক বেশ ইতিবাচকভাবেই এগিয়ে চলছিল। তারপরও পাকিস্তান বেশ সতর্কতার সঙ্গেই পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল। আরহামা সিদ্দিকা বলেন, 'পাকিস্তান তার ভূখন্ডের অখন্ডতার বিষয়ে কোনো ছাড় দিতে পারবে না। কিন্তু একই সঙ্গে তারা আরেকটি যুদ্ধক্ষেত্র উন্মুক্ত করতে চায় না। ভারত ও আফগানিস্তানের সঙ্গে এরই মধ্যে তাদের সম্পর্ক খারাপ। ইসলামাবাদ আরেক প্রতিবেশীর সঙ্গেও সম্পর্ক খারাপ করতে চাইবে না।'
ইকরাম সেহগাল নামে একজন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক বলেন, পাকিস্তান এ পর্যন্ত ইরানের সঙ্গে যথাযথভাবেই সম্পর্ক বজায় রেখে এসেছে। এমনও সময় ছিল যখন পাকিস্তান 'সৌদি শিবির'র অংশ হতে চায়নি। বিশেষ করে ২০১৫ সালে যখন সৌদির নেতৃত্বে সুন্নি জোট ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে তখন পাকিস্তান এর অংশ হতে অসম্মতি জানায়। পাকিস্তান তখন বুঝতে পেরেছিল, আঞ্চলিক সাম্প্রদায়িক সংঘাতে জড়ালে তার বিপদ হচ্ছে, দেশের মধ্যে শিয়া ও সুন্নি জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন একটি লড়াই ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি। তবে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সাম্প্রতিক সুসম্পর্ক এই চাপ কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে। ইকরাম সেহগাল বিশ্বাস করেন, ইরান বোঝে যে, তারা আরেকটি প্রতিবেশীর সঙ্গে নতুন করে আরেকটি যুদ্ধাবস্থা শুরু করতে পারবে না, কারণ দেশটি এরই মধ্যে বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক সংঘাতে জড়িয়ে রয়েছে। এ ছাড়া মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখেও বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে দেশটিকে। তিনি মনে করেন, পাকিস্তানের উচিত জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া এবং অন্য দেশে হামলা চালাতে নিজের ভূখন্ড ব্যবহার করতে না দেওয়া।
সেহগাল বলেন, ইরানেরও এ ধরনের বিপর্যয়মূলক পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। তাদের উচিত যোগাযোগ করে সমন্বয় করা। তা না হলে এ ধরনের পদক্ষেপ এই অঞ্চলটিকে আরেকটি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে, যা এই অঞ্চলের মানুষ সহ্য করতে পারবে না। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ