শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১
যুদ্ধে-যুদ্ধে বেড়ে ওঠা

নাসরালস্নাহ : যাকে ঘিরে লেবানন

ম ২০০৬ সালের গ্রীষ্মকালে হিজবুলস্নাহ গোষ্ঠী ইসরাইলে প্রবেশ করে একজন সেনাকে হত্যা করে এবং দুই সেনাকে জিম্মি করে নিয়ে আসে। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরাইল টানা ৩৩ দিন ধরে লেবাননে ভয়াবহ আক্রমণ চালায়, যাতে প্রায় ১২০০ লেবানিজ নিহত হয়। ওই যুদ্ধের ফলে নাসরালস্নাহ'র জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়। সেই সময় তাকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সর্বশেষ ব্যক্তি হিসেবে আরব দেশগুলোয় পরিচিত করে তোলে। বর্তমানে নাসরালস্নাহর বয়স ৬৩ বছর। এখনো তিনি তার প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলে চলেছেন। পাশাপাশি তার নেতৃত্বে ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়ে চলেছে তার দল হিজবুলস্নাহ...
যাযাদি ডেস্ক
  ১৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
নাসরালস্নাহ : যাকে ঘিরে লেবানন

ইসরাইলের সঙ্গে চলমান সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনায় এসেছে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুলস্নাহ। এর প্রধান শেখ হাসান নাসরালস্নাহ, যিনি একজন শিয়া ধর্মপ্রচারক। এই সংঘাতের প্রেক্ষাপটে তার জীবন নিয়ে রিপোর্ট করেছে বিবিসি। এতে তার ছোটবেলা থেকে হিজবুলস্নাহর প্রধান হয়ে ওঠার বর্ণনা রয়েছে।

রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ১৯৯২ সাল থেকে লেবাননের ইরানপন্থি শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুলস্নাহ'র প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি। হিজবুলস্নাহকে বর্তমানে লেবাননের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল হিসেবে গণ্য করা হয়। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো, লেবাননের জাতীয় সেনাবাহিনীর পাশাপাশি একমাত্র তাদেরই নিজস্ব শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী রয়েছে। হিজবুলস্নাহ প্রধান হাসান নাসরালস্নাহ লেবাননসহ অন্য আরব দেশগুলোয়ও ভীষণ জনপ্রিয়। কারণ, লেবাননের রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং দেশটির সরকার কাঠামোয় হিজবুলস্নাহ যেভাবে প্রবেশ করেছে, এর পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এই নেতা।

ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান এবং দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুলস্নাহ আলি খামেনির সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে নাসরালস্নাহ'র। হিজবুলস্নাহকে আমেরিকা সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা সত্ত্বেও, ইরানের নেতারা বা নাসরালস্নাহ, কেউই কখনো তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা গোপন বা অস্বীকার করেননি। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে হাসান নাসরালস্নাহ'র যেমন অনেক অন্ধ ভক্ত আছে, তেমনি তার ঘোর শত্রম্নরও কোনো অভাব নেই।

ইসরাইল তাকে হত্যার চেষ্টা করছে। ধারণা করা হয়, এ কারণে তিনি জনসম্মুখে আসেন কম। তবে তিনি নিয়মিত টেলিভিশনে বক্তৃতা দেন। সেখানে তিনি লেবানন ও বিশ্বের বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে মন্তব্য করেন এবং তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর চাপ দেওয়ার চেষ্টা করেন।

১৯৬০ সালে পূর্ব বৈরুতের একটা দরিদ্র এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন নাসরালস্নাহ। তার বাবা একটা ছোট মুদি দোকানের মালিক ছিলেন এবং তিনি ছিলেন ৯ ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড়। লেবাননে যখন গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, তখন নাসরালস্নাহ'র বয়স মাত্র পাঁচ বছর। ভূমধ্যসাগরের কোলঘেঁষা এই ছোট্ট দেশটিতে টানা ১৫ বছর ধরে বিধ্বংসী যুদ্ধ চলার কারণে সব লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল তখন। সেই সময় লেবাননের নাগরিকরা ধর্ম ও জাতিসত্তার ভিত্তিতে একে-অপরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তবে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর হিজবুলস্নাহ নেতা হাসান নাসরালস্নাহ'র বাবা লেবাননের রাজধানী বৈরুত ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং তিনি দক্ষিণ লেবাননের আল-বেজুরিয়াহ গ্রামে চলে আসেন। এই গ্রামে ছিল তার পৈতৃক বাড়ি, অর্থাৎ নাসরালস্নাহ'র দাদার বাড়ি। আল-জানুব প্রদেশের টায়ার শহরের অধিকাংশ গ্রামের মতো এই গ্রামেরও বেশিরভাগ বাসিন্দাই ছিল শিয়া মতবাদের। তাই নাসরালস্নাহ'র প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষার সময়টা কেটেছিল দক্ষিণ লেবাননের শিয়া মুসলমানদের সঙ্গে, যারা বিশ্বাস করেন- অটোমান বা উসমানীয় সাম্রাজ্য এবং ফরাসি সাম্রাজ্যের মতো ঔপনিবেশিক যুগে তারা অনেক প্রকার বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হয়েছিল। এই পরিবেশে হাসান নাসরালস্নাহ কেবল তার শিয়া পরিচয় এবং জাতিগত শিকড়ের দিকেই ঝুঁকে পড়েননি, সেই সঙ্গে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামরিক গোষ্ঠীর সদস্যও হয়েছিলেন। লেবাননের সেই প্রভাবশালী এবং সক্রিয় গোষ্ঠীটির নাম 'আমাল মুভমেন্ট'।

লেবাননে প্রত্যাবর্তন ও সশস্ত্র সংগ্রাম

হাসান নাসরালস্নাহ'র বয়স যখন ১৬ বছর, তখন তিনি ইরাকের নাজাফাতে গিয়েছিলেন। ইরাকের বাথ পার্টির নেতারা, বিশেষ করে সাদ্দাম হোসেন এই সিদ্ধান্ত নিলেন যে, শিয়াদের দুর্বল করার জন্য তাদের আরও জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। তাদের সেই পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অন্যতম সিদ্ধান্ত ছিল, ইরাকি মাদ্রাসা থেকে লেবাননের সব শিয়া শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা। যদিও নাসরালস্নাহ নাজাফে মাত্র দুই বছর পড়াশোনা করেছিলেন এবং তারপর তাকে ওই দেশ ছেড়ে আসতে হয়েছিল। কিন্তু নাজাফে থাকার ওই সময়টা এই তরুণ লেবানিজের জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল।

এখানে উলেস্নখ্য, নাজাফে থাকাকালে তিনি আব্বাস মোসাভি নামক একজন ধর্মপ্রচারকের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। ইরান-লেবাননভিত্তিক শিয়া মতবাদের ধর্মপ্রচারক মুসা আল-সাদরের একজন ছাত্র ছিলেন মোসাভি। নাজাফে থাকার সময় মোসাভি ইরানি রাজনীতিবিদ ও শিয়া মুসলিম ধর্মগুরু রুহুলস্নাহ খোমেনির রাজনৈতিক মতাদর্শ দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তারা দু'জনই ইরাকের নাজাফ থেকে লেবাননে ফিরে সেখানে চলমান গৃহযুদ্ধে যোগ দেন। হাসান নাসরুলস্নাহ লেবাননে ফেরার এক বছর পর ইরানে একটি বিপস্নব সংঘটিত হয়। আব্বাস মোসাভি এবং হাসান নাসরালস্নাহ'র মতো একজন ধর্মীয় নেতা রুহুলস্নাহ খোমেনি ইরানের ক্ষমতা দখল করেন। এই ঘটনা লেবাননের শিয়া মুসলিম এবং ইরানের সম্পর্ককে গভীরভাবে বদলে দেয়। দেশটির শিয়াদের রাজনৈতিক জীবন এবং সশস্ত্র সংগ্রাম ইরানের এই ঘটনা ও শিয়া মতাদর্শ দ্বারা উলেস্নখযোগ্যভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।

ক্ষমতায় আসার পর ১৯৮১ সালে তিনি তেহরানে রুহুলস্নাহ'র সঙ্গে দেখা করেন। তখন খোমেনি নাসরালস্নাহকে লেবাননে তার প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করেন। এই দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে নাসরালস্নাহ মাঝেমধ্যেই ইরানে আসা-যাওয়া শুরু করেন। এ সময় তিনি ইরান সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এবং ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তরের মানুষদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ইরানের শিয়া মুসলমানরা লেবাননের শিয়াদের সঙ্গে ধর্মীয় বন্ধন এবং ঐতিহাসিক রেকর্ডকে গুরুত্ব দিয়েছিল। ইরানের শিয়াদের একতার মূলমন্ত্র ছিল পশ্চিমা বিরোধী মনোভাব, যেটি প্রচার করেছিলেন রুহুলস্নাহ খোমেনি।

সে সময় ইরানের বৈদেশিক নীতিতে 'ফিলিস্তিনি আদর্শ' অগ্রাধিকার পেতে থাকে। লেবাননও সে সময় ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের ঘাঁটি হয়ে উঠল। লেবাননের বৈরুত ছাড়াও দক্ষিণ লেবাননে তাদের একটা শক্ত অবস্থান ছিল। ইরানের ইসলামিক রেভু্যলিউশান গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) সামরিক কমান্ডাররা সিদ্ধান্ত নেন যে, তারা ইরানের তত্ত্বাবধায়নে লেবাননে একটা পূর্ণাঙ্গ মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করবেন। তারা তখন এই বাহিনীর নাম দেন হিজবুলস্নাহ, যার অর্থ সৃষ্টিকর্তার দল।

হিজবুলস্নাহ ১৯৮৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। হাসান নাসরালস্নাহ, আব্বাস মোসাভি এবং আমাল মুভমেন্টের আরও কয়েকজন সদস্য একসঙ্গে এই নবগঠিত সংগঠনটিতে যোগ দেন। তখন সংগঠনটির নেতৃত্ব দেন সুভি-আল-তুফায়লি নামে একজন। দলটি খুব দ্রম্নত আঞ্চলিক রাজনীতিতে তার পদচিহ্ন তৈরি করে। নাসরালস্নাহ যখন হিজবুলস্নাহ গ্রম্নপে যোগ দেন, তখন তার বয়স মাত্র ২২ বছর। আশির দশকের মাঝামাঝি ইরানের সঙ্গে নাসরালস্নাহ'র সম্পর্ক আরও গভীর হয়। ইরানের একটি মাদ্রাসায় থাকাকালে নাসরালস্নাহ পার্সিয়ান ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠেন এবং ইরানের অনেক রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। ১৯৯২ সালে হিজবুলস্নাহর নেতৃত্ব হাসান নাসরালস্নাহর কাঁধে এসে পড়ে। সে সময় তার বয়স ৩২ বছর। অনেকে তখন মনে করেছিলেন, তাকে গোষ্ঠীটির প্রধান হিসেবে নির্বাচিত করার কারণ হলো, ইরানের সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্ক। এমনকি অনেক শিয়া আলেমদের দৃষ্টিকোণ থেকে তার পর্যাপ্ত ধর্মজ্ঞানেরও অভাব ছিল। এসব কারণে নাসরালস্নাহ আবার তার পড়াশোনা শুরু করেছিলেন।

ক্ষমতা গ্রহণের পর হাসান নাসরালস্নাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল লেবাননের নির্বাচনে 'হিজবুলস্নাহ' সদস্যদের মনোনয়ন দেওয়া। হিজবুলস্নাহ প্রথমবারের মতো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে লেবাননের আটটি সংসদীয় আসন জিতে নেয়। ইরানের আর্থিক সহায়তায় নাসরালস্নাহ তখন লেবাননের শিয়া সম্প্রদায়ের জন্য অনেক স্কুল, কলেজ, দাতব্য সংস্থার মতো জনকল্যাণমূলক কর্মকান্ড শুরু করে। ২০০৬ সালের গ্রীষ্মকালে হিজবুলস্নাহ গোষ্ঠী ইসরাইলে প্রবেশ করে একজন সেনাকে হত্যা করে এবং দুই সেনাকে জিম্মি করে নিয়ে আসে। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরাইল টানা ৩৩ দিন ধরে লেবাননে ভয়াবহ আক্রমণ চালায়, যাতে প্রায় ১২০০ লেবানিজ নিহত হয়। ওই যুদ্ধের ফলে নাসরালস্নাহ'র জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়। সেই সময় তাকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সর্বশেষ ব্যক্তি হিসেবে আরব দেশগুলোয় পরিচিত করে তোলে।

বর্তমানে নাসরালস্নাহর বয়স ৬৩ বছর। তিনি এখন শুধুমাত্র লেবাননের অদ্বিতীয় রাজনৈতিক-সামরিক নেতাই নন, সেই সঙ্গে তিনি অনেক দশকের সংগ্রামেরও সাক্ষী। তিনি এই অর্জনকে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন করতে এবং শিয়া ইসলামবাদের মতাদর্শগত ভিত্তি প্রচারের জন্য ব্যবহার করেন। তবে এখনো তিনি তার প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলে চলেছেন। পাশাপাশি তার নেতৃত্বে ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়ে চলেছে তার দল হিজবুলস্নাহ। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে