শনিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১
ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্ক

কূটনৈতিক সংঘাতের পারদ ঊর্ধ্বমুখী

সাম্প্রতিক সময়ে মালদ্বীপ ও ভারতের সম্পর্কের সমীকরণ বদলেছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে মুইজ্জু প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে তিক্ততা বেড়েছে। তার আগে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইব্রাহিম মোহাম্মদ সোলিহ। সেই সময় সরকার 'ইনডিয়া ফার্স্ট' নীতি অনুসরণ করেছে। অন্যদিকে, মুইজ্জু 'ইনডিয়া আউট' স্স্নোগান দিয়েই ভোটে লড়েন। নির্বাচনে জেতার পর প্রেসিডেন্ট মুইজ্জুর সিদ্ধান্তে দুই দেশের সম্পর্কে ক্রমশ দূরত্ব বেড়েছে। মুইজ্জুকে ভারতের থেকে বেশি 'চীনের কাছের' বলে মনে করা হয়...
যাযাদি ডেস্ক
  ১০ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
লাক্ষাদ্বীপে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক লাক্ষাদ্বীপ সফরের ছবিতে মালদ্বীপের মন্ত্রী মরিয়ম শিউনা ও অন্য নেতাদের আপত্তিজনক মন্তব্যকে ঘিরে কূটনৈতিক উত্তেজনা ও সংঘাতের পারদ ঊর্ধ্বমুখী। গত বছর ক্ষমতায় আসার পর প্রেসিডেন্ট মুহম্মদ মুইজ্জু ভারতীয় সেনাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলার বিষয়টিকে ঘিরে টানাপড়েন অব্যাহত ছিল। মুইজ্জু প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর দুই দেশের সম্পর্কের ক্রমাগত অবনতি হয়েছে। তারপর মালদ্বীপ সরকারের মন্ত্রী মরিয়ম শিউনাসহ আরও দু'জনের মন্তব্য দুই দেশের সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে একটা বড় ধাক্কা বলেই মনে করা হচ্ছে। ওই আপত্তিকর পোস্ট নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ার পর সোমবার (৮ জানুয়ারি) ভারত মালদ্বীপের হাইকমিশনারকে তলব করেছে। সেখানে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিজেদের অবস্থানের কথা স্পষ্টভাবে জানিয়েছে। অন্যদিকে, ভারতের সাধারণ নাগরিক এবং একাধিক প্রখ্যাত ব্যক্তি এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। বয়কট মালদ্বীপ, যেমন ভারতে সোশ্যাল মিডিয়া পস্ন্যাটফর্মগুলোতে ট্রেন্ড করছে, তেমনই ট্রেন্ড করছে #এক্সপেস্নারলাক্ষাদ্বীপ-ও।

এদিকে, বিতর্ক জোরাল হতেই মালদ্বীপের মোহাম্মদ মুইজ্জু সরকার নিজেদের ক্ষতির পরিমাণ কমাতে সচেষ্ট হয়েছে। প্রথমে, ওই মন্তব্যের সঙ্গে সরকারের কোনো যোগ নেই বলে একটি লিখিত বিবৃতিতে জানানো হয়। পরে যারা ওই মন্তব্য করেছেন, তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে বলে সরকারের তরফে দাবি করা হয়।

সাবেক ডেপুটি স্পিকার যা বলেছেন

মালদ্বীপ সরকারের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতকে অপমান করে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করার বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি জারি করেছে। সরকারি পদে থাকাকালীন যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের পোস্ট করেছেন, তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে।' রিপোর্ট বলছে, মরিয়ম শিউনা ছাড়াও বরখাস্ত করা হয়েছে মালশা শরিফ ও মাহজুম মজিদকেও। মালদ্বীপের সাবেক ডেপুটি স্পিকার এবং এমপি ইভা আবদুলস্নাহ মন্ত্রীদের বরখাস্তের বিষয়টি নিশ্চিত করে উলেস্নখ করেছেন, মালদ্বীপ সরকারের উচিত ভারতের জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়া।

তিনি বলেন, 'মালদ্বীপ সরকার ওই মন্ত্রীর বক্তব্য থেকে নিজেদের দূরে রেখেছে এই বিষয়টা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। আমি জানি যে, সরকার ওই মন্ত্রীদের বরখাস্ত করেছে, তবে আমার মনে হয় মালদ্বীপ সরকারের ভারতীয়দের কাছে ক্ষমা চাওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ।' তার কথায়, 'মন্ত্রীর মন্তব্য লজ্জাজনক। তিনি বর্ণবাদী এবং তা মেনে নেওয়া যায় না। এটা কিন্তু মালদ্বীপের আপামর জনসাধারণের ভারত ও ভারতীয়দের প্রতি মতামত নয়। আমরা ভারতের ওপর কতটা নির্ভরশীল, সেটা আমরা জানি। যখনই আমাদের প্রয়োজন হয়েছে, ভারতই প্রথমে সাহায্য করেছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক, সামাজিক সম্পর্ক, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাণিজ্য, পর্যটন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে আমরা ভারতের ওপর নির্ভরশীল। মানুষ এটা জানে এবং তারা কৃতজ্ঞও। সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান সরকারের জোটসহ সব রাজনৈতিক দল এই অবমাননাকর মন্তব্যের নিন্দা করেছে।'

এর আগে সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ, সাবেক প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মুহম্মদ সোলিহ এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুলস্নাহ শাহিদ এই বিবৃতির নিন্দা করে তাদের দেশের সরকারকে পরামর্শ দেন।

সাম্প্রতিক সময়ে মালদ্বীপ ও ভারতের সম্পর্কের সমীকরণ বদলেছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে মুইজ্জু প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে তিক্ততা বেড়েছে। তার আগে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইব্রাহিম মোহাম্মদ সোলিহ। সেই সময় সরকার 'ইনডিয়া ফার্স্ট' নীতি অনুসরণ করেছে। অন্যদিকে, মুইজ্জু 'ইনডিয়া আউট' স্স্নোগান দিয়েই ভোটে লড়েন। নির্বাচনে জেতার পর প্রেসিডেন্ট মুইজ্জুর সিদ্ধান্তে দুই দেশের সম্পর্কে ক্রমশ দূরত্ব বেড়েছে। মুইজ্জুকে ভারতের থেকে বেশি 'চীনের কাছের' বলে মনে করা হয়।

লাক্ষা দ্বীপে প্রধানমন্ত্রী মোদির সফর

চলতি সপ্তাহের শুরুতে লাক্ষা দ্বীপ সফরে গিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই সফরের ছবিগুলো তার অফিসিয়াল এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেলে পোস্ট করা হয়েছিল। ছবিগুলো শেয়ার করে প্রধানমন্ত্রী মোদি লিখেছেন, যারা 'অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন' তাদের অবশ্যই লাক্ষা দ্বীপে আসতে হবে। মোদিকে 'স্নর্কেলিং' (স্নর্কেল মাস্ক পরে ডুব সাঁতার) করতেও দেখা যায়। দেখতে গেলে প্রধানমন্ত্রী লাক্ষা দ্বীপের পর্যটনের প্রচারও করেছেন।

তার পোস্ট করা ছবি দেখে কয়েক লাখ মানুষ হঠাৎ গুগলে লাক্ষা দ্বীপ সার্চ করতে থাকেন। মালদ্বীপের পরিবর্তে লাক্ষা দ্বীপে মানুষের ছুটি কাটাতে যাওয়া উচিত, এই আলোচনায় সরগরম হয়ে ওঠে সামাজিক মাধ্যম। প্রসঙ্গত, ভারত থেকে প্রতি বছর দুই লাখের বেশি মানুষ মালদ্বীপ ঘুরতে যান। মালদ্বীপে ভারতীয় হাইকমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দুই লাখ ৪১ হাজার এবং ২০২৩ সালে প্রায় দুই লাখ মানুষ মালদ্বীপ ঘুরতে গিয়েছিলেন।

মন্ত্রীর আপত্তিকর বক্তব্য

মালদ্বীপের পরিবর্তে লাক্ষাদ্বীপে যাওয়ার আলোচনা যখন ভারতের সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র হয়ে ওঠে, তখন প্রতিক্রিয়া আসতে থাকে মালদ্বীপ থেকেও। এর মধ্যে একটি মন্তব্য ছিল, মালদ্বীপ সরকারের মন্ত্রী মরিয়ম শিয়ুনার। তিনি প্রধানমন্ত্রী মোদির ছবি নিয়ে আপত্তিকর কথা বলেন। পরে অবশ্য মুছে ফেলেন টুইট। অন্য একটি টুইটে মরিয়ম লেখেন, 'মালদ্বীপের ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রয়োজন নেই।' মরিয়ম সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন অনেক টুইট শেয়ার করেছেন, যেখানে মালদ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে পাওয়া যাচ্ছে এবং ভ্রমণ পিপাসুদের মালদ্বীপে আসতে বলা হয়।

মরিয়ম ছাড়াও মালদ্বীপের একাধিক নেতা একই ধরনের মন্তব্য করেছেন, যা ভারতীয়দের ক্ষুব্ধ করেছে। ওই মন্তব্যগুলোকে ঘিরে ভারতে তীব্র প্রতিক্রিয়াও দেখতে পাওয়া গেছে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বলিউডের তারকা এবং বিখ্যাত খেলোয়াড়রাও ভারতের সমর্থনে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এর প্রভাব দেখা গেছে মালদ্বীপেও। দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ নাশিদ তার দেশের সরকারকে বিষয়টি সামাল দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

সামাজিক মাধ্যমে নিজের মতো প্রকাশ করে নাশিদ লিখেছেন, 'মালদ্বীপ সরকারের মন্ত্রী কী ভয়ঙ্কর ভাষায় কথা বলেছেন এবং সেটাও এমন একটি দেশের সম্পর্কে যেটি মালদ্বীপের সুরক্ষা ও সমৃদ্ধির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুইজ্জু সরকারের উচিত এ ধরনের বক্তব্য থেকে দূরে থাকা। এছাড়াও, এটা স্পষ্ট করে দেওয়া উচিত যে, এগুলো সরকারের মতামত নয়।'

মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহামেদ সোলিহ ওই মন্তব্য 'অসংবেদনশীল' এবং দুই দেশের সম্পর্ককে 'নষ্ট' করার মতো বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, 'ভারতের বিরুদ্ধে মালদ্বীপের সরকারি কর্মকর্তাদের সামাজিক মাধ্যমে বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের নিন্দা জানাই। ভারত সব সময়ই মালদ্বীপের ভালো বন্ধু। আমাদের দুই দেশের পুরনো বন্ধুত্বকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে, এমন অসংবেসদনশীল মন্তব্য আমাদের মেনে নেওয়া উচিত নয়।'

মালদ্বীপ সরকারের ব্যাখ্যা

এর কয়েক ঘণ্টা পর মালদ্বীপ সরকার একটি বিবৃতি প্রকাশ করে বিষয়টি স্পষ্ট করে। গত রোববার প্রকাশ করা সেই বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, 'বিদেশি নেতা এবং শীর্ষ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমে করা অবমাননাকর মন্তব্য সম্পর্কে সরকার অবগত। এই মতামতগুলো একেবারেই ব্যক্তিগত এবং তা মালদ্বীপ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করে না।' বিবৃতিতে বলা হয়, 'সরকার বিশ্বাস করে, বাক স্বাধীনতাকে গণতান্ত্রিক ও দায়িত্বশীলভাবে বিবেচনা করা উচিত, যাতে ঘৃণা, নেতিবাচকতা বৃদ্ধি না পায় বা আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে মালদ্বীপের সম্পর্ককে প্রভাবিত না করে।' বিবৃতিতে আরও বলা হয়, 'সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো এ ধরনের অবমাননাকর মন্তব্যকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করবে না।'

ভারত জুড়ে প্রতিক্রিয়া

মালদ্বীপের মন্ত্রীর মন্তব্যকে কেন্দ্র করে ভারত আপাতত উত্তাল। দিলিস্নতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে সোমবার ডেকে পাঠানো হয় ভারতে মালদ্বীপের হাইকমিশনার ইব্রাহিম সাহিদকে। সূত্রের খবর, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

এদিকে, অবমাননাকর মন্তব্যকে ধিক্কার জানিয়ে সরব হয়েছেন সাধারণ মানুষ, বলিউড তারকা, খেলোয়াড়সহ অনেকেই। একাধিক বড় তারকা ঘুরতে যাওয়ার জন্য মালদ্বীপের পরিবর্তে লাক্ষা দ্বীপকে বেছে নেয়ার কথা জানিয়েছেন। লাক্ষা দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা জানিয়ে কেউ বা সেখানেই শুটিং করার কথা জানিয়েছেন।

ভারতের ভ্রমণপিপাসুদের অনেকেই মালদ্বীপের যাওয়ার আসন্ন পরিকল্পনা বাতিল করেছেন বলে জানিয়েছেন। একটি বেসরকারি ভ্রমণ সংস্থা ঘোষণা করেছে, তারা মালদ্বীপের বুকিং বাতিল করছে। দেশের প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য থেকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের দেখাদেখি অন্যান্য ভ্রমণ সংস্থাও একই পন্থা নিয়েছে। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে