গাজা ইসু্যতে আঞ্চলিক সংঘাত যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, সেই লক্ষ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি বিস্নংকেন মধ্যপ্রাচ্য সফর করেছেন। কিন্তু তার এই প্রচেষ্টা ভেস্তে যেতে শুরু করেছে। কারণ, প্রতিবেশী লেবানন থেকে ইরানপন্থি হিজবুলস্নাহর হামলা দিন দিন বাড়ছেই। আর ইসরাইলও সাম্প্রতিক সময় লেবাননে হামলা-হত্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। এমন উত্তেজনার মধ্যেই লেবাননে ইসরাইলি হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ নিতে ইহুদি ভূখন্ডটির উত্তরাঞ্চলে প্রথমবারের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কমান্ড সেন্টারে হামলা চালিয়েছে হিজবুলস্নাহ। মঙ্গলবার উত্তর ইসরাইলের ওই সেনাঘাঁটিতে বিস্ফোরক-বোঝাই ড্রোন হামলা চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছে গোষ্ঠীটি। তথ্যসূত্র : রয়টার্স, গার্ডিয়ান, আল-জাজিরা
এর আগে, গত সোমবার লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে ইসরাইলের বিমান হামলায় হিজবুলস্নাহর অভিজাত শাখা 'রাদওয়ান ফোর্স'র জ্যেষ্ঠ কমান্ডার উইসাম আল-তাবিলসহ অন্তত তিন যোদ্ধা নিহত হন। এই হামলার পর ইসরাইলকে চড়া মাশুল দিতে হবে বলে হুমকি দেয় হিজবুলস্নাহ। মঙ্গলবার উত্তর ইসরাইলে সামরিক ঘাঁটিতে হামলা সাম্প্রতিক হত্যাকান্ডের প্রতিশোধে চালানো হয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছে তারা। গোষ্ঠীটি বলেছে, গত সপ্তাহে বৈরুতে হামাসের উপ-প্রধান সালেহ আল-অরৌরি এবং সোমবার হিজবুলস্নাহ কমান্ডারকে হত্যার প্রতিশোধের অংশ হিসেবে সাফেদে ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তরে ড্রোন হামলা চালানো হয়েছে।
হিজবুলস্নাহর হামলার বিষয়ে অবগত একটি সূত্র বলেছে, তিন মাস আগে গাজা উপত্যকা থেকে ইসরাইলে হামাসের হামলা শুরুর পর প্রথমবারের মতো সীমান্ত থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে ইসরাইলের সাফেদে হামলা চালিয়েছে হিজবুলস্নাহ। ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর একজন মুখপাত্র বলেছেন, উত্তরের একটি সামরিক কমান্ড সেন্টারে ড্রোন আঘাত হেনেছে। কিন্তু সেখানে কোনো ক্ষয়ক্ষতি কিংবা হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। তবে হামলার এই ঘটনাটি কোথায় ঘটেছে, তা নির্দিষ্ট করে জানাননি তিনি।
ইসরাইল-লেবানন সীমান্ত এলাকায় এবারের এই সংঘাত ২০০৬ সালের ইসরাইল-হিজবুলস্নাহ যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। হামাসের সঙ্গে ইসরাইলের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় প্রত্যেক দিন ইসরাইলি সামরিক চৌকি ও ভূখন্ডে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে আসছে হিজবুলস্নাহ। জবাবে ইসরাইলের সামরিক বাহিনীও লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করছে। সাম্প্রতিক সংঘাতে ইসরাইলের হামলায় লেবাননে এখন পর্যন্ত হিজবুলস্নাহর ১৩০ জনের বেশি যোদ্ধা নিহত হয়েছেন। বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ আর হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনায় সীমান্তে উভয় প্রান্তের লাখ লাখ মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছেন। সম্প্রতি উভয়পক্ষের হামলা বৃদ্ধি পাওয়ায় গাজা সংঘাত পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র বলেছেন, মঙ্গলবারও দক্ষিণ লেবাননের ঘান্দৌরিয়েহ শহরে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। এ সময় হিজবুলস্নাহর যোদ্ধাদের একটি গাড়িতে বিস্ফোরণে অন্তত তিনজন নিহত হয়েছেন। এক বিবৃতিতে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী বলেছে, তাদের বিমান বাহিনী লেবাননের সীমান্ত সংলগ্ন কেফার কিলা গ্রামে হিজবুলস্নাহর লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। পাশাপাশি দক্ষিণ লেবাননের অন্য একটি এলাকায় হিজবুলস্নাহর একটি ড্রোন স্কোয়াডকেও বিমান থেকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে।
মঙ্গলবার টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে হিজবুলস্নাহর উপ-প্রধান নাইম কাশেম বলেছেন, তারা লেবানন থেকে যুদ্ধের সম্প্রসারণ ঘটাতে চান না। তবে ইসরাইল যদি যুদ্ধের সম্প্রসারণ ঘটায়, তাহলে তাদের স্তব্ধ করার জন্য হিজবুলস্নাহর সর্বোচ্চ প্রতিক্রিয়া অনিবার্য।
নির্বিচার হামলা চলছেই, গাজায়
নিহত ছাড়াল ২৩ হাজার
এদিকে, ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখন্ডে ইসরাইলি হামলায় নিহতের সংখ্যা ২৩ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় নিহত হয়েছেন প্রায় আড়াইশ ফিলিস্তিনি। এ ছাড়া গত অক্টোবর থেকে চলা এই হামলায় আহত হয়েছেন আরও প্রায় ৫৯ হাজার ফিলিস্তিনি। সোমবার অবরুদ্ধ এই ভূখন্ডটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা বেড়ে কমপক্ষে ২৩ হাজার ৮৪ জনে পৌঁছেছে। এ ছাড়া একই সময় আহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়ে ৫৮ হাজার ৯২৬ জনে পৌঁছেছে। মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলি হামলায় আরও ২৪৯ জন নিহত এবং ৫১০ জন আহত হয়েছেন।
উলেস্নখ্য, গত ৭ অক্টোবর হামাসের নজিরবিহীন আন্তঃসীমান্ত হামলার পর থেকে ইসরাইল গাজা উপত্যকায় অবিরাম বিমান ও স্থল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইলি এই হামলায় হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী শিবির, মসজিদ, গির্জাসহ হাজার হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। মাঝে হামাসের সঙ্গে এক সপ্তাহব্যাপী মানবিক বিরতির পর গত ডিসেম্বরের শুরু থেকে গাজা উপত্যকায় পুনরায় বিমান ও স্থল হামলা শুরু করে ইসরাইল। বিরতির পর শুরু হওয়া এই অভিযানে গাজায় হামলা আরও তীব্র করে দখলদার সেনারা।
ইসরাইলি আক্রমণ গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ এই ভূখন্ডটির ৬০ শতাংশ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে এবং অব্যাহত অবরোধের কারণে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং ওষুধের তীব্র সংকটের মধ্যে প্রায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনি ঘরবাড়ি হারিয়ে বাস্তুচু্যত হয়েছেন। অসংখ্য আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, গাজায় ইসরাইলের কর্মকান্ড যুদ্ধাপরাধ বা গণহত্যার সমান এবং তুরস্ক ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলো যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ইসরাইলকে আন্তর্জাতিক আদালতে জবাবদিহি করতে কাজ করছে।