জান্তা ছেড়ে বিদ্রোহীদের পক্ষে চীন?

প্রকাশ | ০২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
মিয়ানমারের কয়েকজন বিদ্রোহী -ফাইল ছবি
২০২১ সালের ১ ফেব্রম্নয়ারি মিয়ানমার জান্তা যখন দেশটির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে, তখন এটিকে 'মন্ত্রিসভায় বড় রদবদল' বলে আখ্যা দিয়েছিল চীন। এরপর যখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে, শুরু হয় গৃহযুদ্ধ, তখনো সামরিক শাসকদের পাশে ছিল বেইজিং। অভু্যত্থানের জেরে মিয়ানমার জান্তার ওপর পশ্চিমা দেশগুলো নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার তীব্র নিন্দা জানায় চীন। এর মাধ্যমে 'উত্তেজনা বাড়ানো হচ্ছে' বলে দাবি করে তারা। মিয়ানমারের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার চীন। জান্তা বাহিনীর কাছে এ পর্যন্ত ২৫ কোটি ডলারের বেশি মূল্যের অস্ত্র বিক্রি করেছে চীনা সরকার। কিন্তু গত অক্টোবরের শেষের দিক থেকে মনে হচ্ছে হাওয়া বদলে গেছে। দেখা যাচ্ছে, আপন স্বার্থরক্ষায় যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রতিবেশীর বিষয়ে নিজেদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করছে চীন। এর নেপথ্যে রয়েছে উত্তর মিয়ানমারে 'থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স' নামে পরিচিত জাতিভিত্তিক মিলিশিয়াদের একটি জোটের উত্থান। চীনের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সঙ্গে এদের সম্পর্ক রয়েছে বলে শোনা যায়। চীন সীমান্তবর্তী অঞ্চলে কার্যক্রম চালানো জান্তাবিরোধী এই জোট সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের জন্য সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স এরই মধ্যে দুই শতাধিক সেনাঘাঁটি এবং চারটি সীমান্ত ক্রসিং দখল করেছে, যা চীন-মিয়ানমার বাণিজ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উলেস্নখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, মিয়ানমারের এই বিদ্রোহী জোটকে প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় দিচ্ছে চীন। কিছু ক্ষেত্রে বেইজিং এদের সাহায্য করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে মিয়ানমারের অন্য সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোও জান্তা বাহিনীর ওপর আক্রমণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এর ফলে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে দেশটির দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা। দূরত্ব বাড়ছে চীন-জান্তার? 'অপারেশন ১০২৭' নামে পরিচিত বিদ্রোহীদের এই অভিযান শুরু হয়েছিল গত অক্টোবরের ২৭ তারিখে। নভেম্বরে এসে অনেকেই ধারণা করতে শুরু করেন, মিয়ানমারে মিত্রপক্ষ বদলেছে চীন এবং সামরিক জান্তার সময়ও ফুরিয়ে আসছে। স্পষ্টতই এতে মনোক্ষুণ্ন হয় মিয়ানমার জান্তা। বিষয়টি গোপনও করেনি তারা। নভেম্বর মাসে জান্তা-সমর্থকদের চীনবিরোধী বিক্ষোভ করতে অনুমতি দেন দেশটির সামরিক জেনারেলরা। এর পরপরই জান্তাকে আশ্বস্ত করতে ফের উদ্যোগ নেয় বেইজিং। মিয়ানমারের সঙ্গে যৌথ নৌ-মহড়া করে চীন। তাদের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই'র সঙ্গে ডিসেম্বরের শুরুতে সাক্ষাৎ হয় মিয়ানমারের উপ-প্রধানমন্ত্রী থান সুয়ের। এ ছাড়া গত ১৪ ডিসেম্বর চীন ঘোষণা দেয়, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও জাতিগত মিলিশিয়াদের মধ্যে একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতা করেছে তারা। স্বার্থরক্ষার চেষ্টায় চীন এসব ঘটনা মিয়ানমারের প্রতি চীনের দ্বিধান্বিত দৃষ্টিভঙ্গির দিকে ইঙ্গিত করে। দীর্ঘমেয়াদে, মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের বিশাল অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব রয়েছে এবং বেইজিং চায় না, প্রতিবেশী দেশটি পশ্চিমাদের দিকে ঝুঁকে পড়ুক। আর স্বল্পমেয়াদে, চীন তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই মিয়ানমার সরকার দেশটির জঙ্গলময় সীমান্ত অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। ফলস্বরূপ, দুই দেশের মধ্যকার দুই হাজার কিলোমিটার সীমান্তে নিরাপত্তাহীনতার বিষয়ে উদ্বিগ্ন চীন। এটি তাদের অবকাঠামোগত বিনিয়োগগুলোকে যেমন বিপন্ন করেছে, তেমনি শরণার্থী, মাদক এবং অন্যান্য অপরাধমূলক উপাদান চীনে ঢুকে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এর সবশেষ সংযোজন অনলাইন প্রতারণা কেলেঙ্কারি। একটি প্রতারক চক্র গত তিন বছরে হাজার হাজার চীনা নাগরিককে মিয়ানমারে পাচার করেছে। মানুষজনকে প্রেমের সম্পর্কের ফাঁদে ফেলে বা মুনাফার লোভ দেখিয়ে অনলাইনে ভুয়া বিনিয়োগে প্রলুব্ধ করার কাজে ব্যবহার করা হয় এসব ভুক্তভোগীকে। যারা এতে রাজি হন না, তাদের নির্যাতন বা হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এই অপরাধের ব্যাপকতা এবং এতে ভুক্তভোগী ও অপরাধী হিসেবে চীনা নাগরিকরা জড়িত থাকায় বিষয়টি চীনের অগ্রাধিকারমূলক বৈদেশিক নীতিতে পরিণত হয়েছে। গত মে মাসে চীনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং অনলাইন কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি নিয়ে মিয়ানমার সফর করেন। এরপরও অনলাইন প্রতারক চক্রকে ধরতে কেমন কোনো পদক্ষেপই নেয়নি বা নিতে ব্যর্থ হয়েছে মিয়ানমার জান্তা। অভিযোগ রয়েছে, এই প্রতারক চক্রের কাছ থেকে অর্থ পান সামরিক শাসকরা। ধারণা করা হয়, এ কারণেই সীমান্তবর্তী বিদ্রোহী মিলিশিয়াদের প্রশ্রয় দিচ্ছে চীন। থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সও ঘোষণা দিয়েছে, তাদের লক্ষ্যগুলোর মধ্যে একটি হলো- অনলাইন প্রতারক চক্রকে নির্মূল করা। তবে এখনো মিয়ানমার জান্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলেছে চীন। মিয়ানমারের বেশিরভাগ ব্যাংক, বিমানবন্দর, বড় শহর ও শিল্প এলাকা সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও চীন-রাশিয়া থেকে নতুন যুদ্ধবিমান কিনেছে জান্তা। ফলে চীন হয়তো কখনো কখনো মিয়ানমারের বিদ্রোহীদের সমর্থন দেবে, কিন্তু সামরিক শাসকদের পাশেই বেশি দাঁড়াবে তারা। চীনের এই 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' নীতিই সম্ভবত মিয়ানমারের পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলছে। তথ্যসূত্র : দি ইকোনমিস্ট