বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

নির্বাচন ঘিরে ত্রিমুখী শঙ্কা বিএনপিতে 

হাসান মোল্লা
  ২০ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫১
বিএনপির লোগো

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রলম্বিত করার নানা রকম আভাস পাচ্ছে বিএনপি। এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে ত্রিমুখী শঙ্কায় আছে দলটি। সেগুলো হচ্ছে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব তৈরি হবে। ফ্যাসিবাদের দোসররা এর সুযোগ নিয়ে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করবে এবং অন্তর্বর্তী সরকার যদি দেড় বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার প্রচেষ্টা করে, তাহলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতাও তৈরি হতে পারে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার এবং ছাত্র প্ল্যাটফর্ম থেকে সাম্প্রতিক সময় নির্বাচন ইস্যুতে যে ধরনের বক্তব্য এসেছে, এতে বিএনপির অভ্যন্তরে ‘নির্বাচন প্রলম্বিত হওয়ার সন্দেহ বেড়েছে। সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণে নির্বাচনী রোডম্যাপের ব্যাপারে খুব স্পষ্টভাবে কোনো মেসেজ না থাকায় আশাহত হয়েছে দলটি। এ ছাড়া সম্প্রতি আল জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও নির্বাচনী পথনকশার বিষয়টি স্পষ্ট করেননি ড. ইউনূস। এ

মন প্রেক্ষাপটে বিএনপি মনে করছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান লক্ষ্য যে নির্বাচন-সেটি থেকে তারা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে কিনা কিংবা ঠিক কতদিন তারা ক্ষমতায় থাকতে চান, সেটি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে। জানা গেছে, বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ড. ইউনূসের এই ভাষণ এবং সাক্ষাৎকার নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছে। নির্বাচন ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টা যে বক্তব্য রেখেছেন, সেটি কার্যত বিএনপিকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সরকারের বর্তমান অবস্থান ‘নির্বাচনকে প্রলম্বিত করার অবস্থান’ বলে দলটির ভেতর বিবেচিত হচ্ছে।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে জাতি নির্বাচনী রোডম্যাপ সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়ার আশা করেছিল। সেটি পরিষ্কার না হওয়ায় জনগণের মধ্যে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন সম্পর্কিত রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা উনার কাছ থেকে আমরা এখনো আশা করি।

রোডম্যাপ দেওয়া হলে এখন যে বাজার পরিস্থিতি, সরবরাহ পরিস্থিতি এগুলোর একটু উন্নতি হতে পারত। কারণ, অনিশ্চিত পথযাত্রায় অনেক সময় বিনিয়োগ-সরবরাহ বিঘিœত হয়, যেটা আমাদের জন্য এখন জরুরি। তিনি আরও বলেন, সংস্কার এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি একই সঙ্গে চলতে পারে। যদি এ ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা দেওয়া না হয়, তাহলে জনমনে এই প্রশ্নটা ঘুরপাক খেতে থাকবে। যার কারণে অনেকে অনেক সময় অস্থিরতা সৃষ্টির সুযোগ নিতে পারে। যারা কথিত স্বৈরাচারের কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ইতোমধ্যে দেশে নানা অস্থিরতার সুযোগ সৃষ্টির পাঁয়তারা করেছে, সেটি রুখতে প্রধান উপদেষ্টা দ্রæততম সময় একটি নির্বাচনী রোডম্যাপ দিবেন বলে দেশবাসীর প্রত্যাশা।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দুই তিনজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারের কার্যক্রমে বিএনপির কোনো বিরোধিতা নেই। তারা সরকারকে সহযোগিতা করছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান লক্ষ্য যেহেতু নির্বাচন, তাই যে সংস্কারগুলো একটি অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনের পূর্বশর্ত- রাজনৈতিক মতৈক্যের ভিত্তিতে, সেগুলোতে সরকারের অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। কারণ, গত দেড় দশক ধরে ভোটাধিকার বঞ্চিত মানুষ এখন ভোট দিতে উন্মুখ হয়ে রয়েছে। তাই সরকারের উচিত, নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। এ ক্ষেত্রে সরকারের সংস্কারের পাশাপাশি একই সঙ্গে নির্বাচনী প্রস্তুতিও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সরকার যদিও বলছে, নির্বাচনের যাত্রা শুরু হয়েছে। তবে রোডম্যাপ না দেওয়ায় এটি সরকারের ‘রাজনৈতিক’ বক্তব্য হিসেবে মনে করা হচ্ছে।

এদিকে ছাত্র প্ল্যাটফর্ম থেকেও বারবার বলা হচ্ছে, শুধু একটি নির্বাচনের জন্য দেশে গণবিপ্লব হয়নি। বিএনপি নেতারা বলছেন, তারা যেখানে সংস্কারের পক্ষে, সেখানে ছাত্রদের এ ধরনের বক্তব্যে বিএনপিতে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপির অভিমত, গত ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান ছিল গত ১৫ বছরে দেশে গণতন্ত্রহীনতা এবং আওয়ামী সরকারের নির্যাতন-নিপীড়ন, গুম-খুনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার ক্ষোভের সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ। এ কারণেই শেখ হাসিনাকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছে। তাই দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন- যারা দেশে বিদ্যমান নানাবিধ সংকট নিরসনে কাজ করতে পারে। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, সরকার যদি নির্বাচন প্রলম্বিত করে, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি হতে পারে এবং সেটি কোনো পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে, সেটি এখনই বলা যাবে না। এমনটা হলে ফ্যাসিবাদের দোসররা তার সুযোগ নিয়ে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। সেটি রুখতে সরকার দ্রæততম সময় নির্বাচনী রোডম্যাপ দিবে বলে প্রত্যাশা তাদের।

বিএনপি চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে। বিগত কয়েক মাস ধরে এই দাবিতে নানা প্ল্যাটফর্ম থেকে সোচ্চার রয়েছে তারা। দলটির নীতিগত সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আগামী বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে তারা দেশে একটি সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চায়। শুধু বিএনপি নয়, তাদের জোটও দ্রæততম সময়ের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে।

বিএনপি মনে করছে, অন্তর্বর্তী সরকার যদি দেড় বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার প্রচেষ্টা করে, তাহলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতাও তৈরি হতে পারে। বিএনপি মনে করছে, অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করতে ‘পতিত’ আওয়ামী লীগ এবং তাদের দোসররা সর্বোচ্চ মাত্রায় তৎপর রয়েছে। দেশের বাইরে থেকে তারা নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ অব্যাহত রাখছে। তাদের নির্দেশনা দেওয়া আছে- যখন প্রয়োজন হবে, তখনই মাঠে নামতে হবে। বিএনপি এ-ও মনে করছে, যতদিন দেশে একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন না হবে, ততদিন আওয়ামী লীগও এই সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে তাদের অপতৎরতা অব্যাহত রাখবে; দেশি-বিদেশি বন্ধুদের অব্যাহতভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে যাবে। সেটিও সরকারকে আমলে নিতে হবে।

বিএনপি এই মুহূর্তে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা ৩১ দফাকে সারাদেশে নতুন করে ব্র্যান্ডিং করার মধ্যে রয়েছে। এ লক্ষ্যে মঙ্গলবার ঢাকা বিভাগের মধ্য দিয়ে ১০ সাংগঠনিক বিভাগে কর্মশালার কার্যক্রম শুরু করেছে দলটি। এই ৩১ দফা বিএনপির একটি নির্বাচনী মেনুফেস্টু। ডিসেম্বরের মধ্যে এই কর্মশালার কার্যক্রম শেষ হলে নির্বাচন দাবিতে সোচ্চার হবে দলটি। তখন বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশের চিন্তা রয়েছে বিএনপির।

যাযাদি/ এসএম

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে