মিডিয়ার বলি তারেক রহমানের অগ্রাধিকার গণমাধ্যম সংস্কার 

প্রকাশ | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৩১

হাসান মোল্লা
তারেক রহমান ও তার সেই কার্টুন। ছবি: সংগৃহীত

অসংখ্য নেতিবাচক বক্তব্য ও শব্দ ব্যবহার করে দুর্নীতির বরপুত্র, খাম্বাম্যান, মিস্টার টেন পার্সেন্ট, গ্রেনেড হামলাকারী, অর্থ পাচারকারী হিসেবে পরিকল্পিতভাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে খলনায়ক বানানোর মিশনে গত দুই যুগ বেশ সফল ছিল তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। 

মূলত সুদূর প্রসারী পরিকল্পনার মাধ্যমে কিছু দালাল মিডিয়া সদস্যদের সহায়তা নিয়ে এই তৎপরতা চালানো হয়েছিল। সঙ্গত কারণে মিডিয়া সন্ত্রাসের মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে দেশের ভাগ্য নিয়ে কেউ যাতে ছিনিমিনি খেলতে না পারে সে বিষয়টি বিএনপিতে এখন সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এর অংশ শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরপরই নিজের ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন নিজেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে মিডিয়া সংস্কারের আগাম ইঙ্গিত দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। 

বিএনপি নেতাদের দাবি, দলের শীর্ষ নেতা তারেক রহমান সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন তার প্রমাণ দিয়েছেন নিজের করা পোস্টের মধ্য দিয়ে। গত ১১ আগস্ট নিজের ব্যঙ্গাত্মক একটি কার্টুন ফেসবুকে শেয়ার করেন বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। পোস্টে তিনি কার্টুনিস্টদের আবারো নির্ভয়ে কার্টুন আকার আহবান জানান। তারেক রহমান লিখেন, ‘আমি গভীরভাবে আনন্দিত যে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক কার্টুন আঁকার স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। ২০০৬ সালের আগে বাংলাদেশি কার্টুনিস্ট, বিশেষ করে শিশির ভট্টাচার্য প্রায়ই আমার মা এবং আমাকে নিয়ে কার্টুন তৈরি করতেন। যাই হোক, গত ১৫ বছরে আমরা কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে জোরপূর্বক গুমের শিকার হতে দেখেছি। তার কাজের জন্য অকল্পনীয় নির্যাতন এবং কারাবরণ সহ্য করতে হয়েছে। আরো অনেকে একই ধরনের নিপীড়নের মুখোমুখি হয়েছেন। শিশির ভট্টাচার্য অবশেষে কার্টুন তৈরি করা বন্ধ করে দিয়েছেন।’

তারেক রহমান আরো লেখেন, ‘আমি কার্টুনিস্ট মেহেদীর ভক্ত, শিশির ভট্টাচার্যের কাজও উপভোগ করতাম। আমি আন্তরিকভাবে আশা করি, তিনি শিগগিরই আবার নিয়মিত রাজনৈতিক কার্টুন তৈরি শুরু করবেন।’

তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ সূত্রমতে, গত দুই যুগের রাজনৈতিক পটভ‚মি পর্যালোচনা করেছে বিএনপি। দলের বিপর্যয়ের বেশ কয়েকটি কারণও শনাক্ত করেছে দলটি। এর মধ্যে বিপর্যয়ের প্রধান কারণ হিসেবে সামনে এসেছে মিডিয়া। কেন, কীভাবে কাদের সহায়তায় মিডিয়া বিএনপি ও দেশের ক্ষতি করেছে তা বেরিয়ে এসেছে বিএনপির পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানে। 

বিএনপির করা অনুসন্ধানের বিষয়ে দলের মিডিয়া সেল সূত্র জানায়, ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার আগ থেকেই আওয়ামী লীগ মিডিয়ার মাধ্যমে বিএনপিকে ধ্বংস করতে ষড়যন্ত্র করে। অন্যদিকে গণমাধ্যমের ঊর্ধ্বতন পদে থেকে একটি রাজনৈতিক দলের দালাল হিসেবে নিজেদের বিবেকবিবর্জিত কার্যক্রমে নিয়োজিত করবে এমনটি আশা করেনি বিএনপি। সঙ্গত কারণে বিষয়টি বিএনপি গুরুত্ব না দেওয়ায় চতুর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মিডিয়াকে ব্যবহার করেছে। ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে একটি প্রকল্পের জন্য বরাদ্দের চেয়ে বেশি লুটপাটের তথ্য প্রকাশ করে তারেক রহমানকে দুর্নীতির বরপুত্র বানানোর চেষ্ট করেছে। অবৈধ অস্ত্র ধরে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ক্ষতি বন্ধে ভূমিকা রাখার পরও সহায়তাকরী হিসেবে মিডিয়ার অপতৎপরতার কারণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি এক স্থান থেকে সরিয়ে আরেক স্থানে নিয়ে মূল পরিকল্পনাকারীদের আড়াল করে গ্রেনেড হামলায় তারেককে জড়ানোর বিষয়টি দক্ষতার সঙ্গে করতে কয়েকটি মিডিয়া দ্বিধাবোধ করেনি। অন্যদিকে অর্থ পাচার মামলায় খালাস দেওয়ায় বিচারপতির দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়ার বিষয়টি চাপা দিতেও ব্যাপক তৎপর ছিল বেশকটি মিডিয়া। অন্যদিকে সেই বিচারককে হেনস্তা করতে তার চরিত্র হনন করে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। ওই সময় চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয় হাওয়া ভবনকে দুর্নীতির প্রতীক হিসেবে বারবার সামনে আনা হয়েছে। 

বিএনপির মিডিয়া সেলের একাধিক নেতা জানান, বিএনপি সবসময় সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। কিন্তু স্বাধীনতার নামে অনেক মিডিয়া আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়ে ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে ৪ দলীয় জোট সরকারকে নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। ২০০৭-০৮ সালে ১/১১ সরকারের সময় বিশেষ সংস্থার প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সংবাদ পরিবেশনের বাধ্য হয়েছিলেন বলে প্রখ্যাত সাংবাদিক মাহফুজ আনাম স্বীকারও করেছেন। সেই সময় বিএনপিকে ভাঙতে এবং ধ্বংস করতে মিডিয়ার ভ‚মিকা কি ছিল তা সবারই জানা। আর ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দুর্নীতিবাজ, আগুন সন্ত্রাসী, জঙ্গি, যুদ্ধাপরাধীর মদদদাতাসহ কত নামে যে বিএনপিকে ব্যবহার করেছে তা দেশবাসী দেখেছে। অথচ বিএনপি জেল, জুলুম, নির্যাতন, হামলা, মামলা, গুম, খুনের শিকার এ বিষয়গুলো সামনে আসেনি। ২০২৪ সালের মতো সুষ্ঠু নির্বাচন নাকি কেউ কখনো দেখেনি এমন সংবাদ পরিবেশন করতে পর্যন্ত বিবেকে বাধেনি। অন্যদিকে বিশেষ দিবসে বিএনপির ক্রোড়পত্র পর্যন্ত ছাপেনি বেশিরভাগ সংবাদ মাধ্যম। ৪/৫টি গণমাধ্যম এই ক্রোড়পত্র ছেপেছে নিয়মিত। কিন্তু তারেক রহমানের বাণীর বিষয়ে আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে এমনও হয়েছে যে যায়যায়দিন ছাড়া আর কোনো পত্রিকা ক্রোড়পত্র ছাপাতে সাহস করেনি। 

বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিডিয়ার বিষয়ে দলটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ ও করণীয় ঠিক করেছে। ৫ আগস্ট থেকে ৫ সেপ্টেম্বর ১ মাসের বিশ্লেষণ হচ্ছে বিগত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রায় সর্বত্র স্বস্তি থাকলেও আতঙ্ক রয়ে গেছে দেশের মিডিয়া হাউসগুলোতে। ফ্যাসিবাদ শেখ হাসিনা তৈরিতে অন্যতম নিয়ামক হিসেবে ভ‚মিকা পালন করেছে এই মিডিয়া হাউসের কতিপয় সুবিধাভোগীরা। তারা সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক সাংবাদিকতার চরম অন্তরায় ছিলেন। ন্যূনতম ন্যায়ের পক্ষে থাকা কণ্ঠস্বরকে এসব সুবিধাভোগী ও ফ্যাসিবাদের দোসররা দমিয়ে রাখতে এমন কোনো কাজ নেই যা করেননি। এখন দেশের নতুন যাত্রায়, আগামীর বাংলাদেশ গড়তে যখন আপাময় মানুষ কাজ করছে তখন ওইসব দোসরদের অনেকে রয়েছেন পর্দার অন্তরালে। আপাতত চাপের কারণে তারা নিশ্চুপ থাকলেও সময় ও সুযোগ আসলে আগের মতো ফণা তুলতে মোটেও কার্পণ্য করবে না। 

৫ সেপ্টেম্বর-পরবর্তী বিশ্লেষণ হচ্ছে, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে কিছুদিন ওইসব সুবিধাভোগীরা চুপ থাকলেও এখন সু-কৌশলে নিজেদের পুরনো চেহারায় ফিরতে শুরু করেছে। বেশিরভাগ মিডিয়া ইনিয়ে-বিনিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে মিথ্যা সংবাদ প্রচার করছে। অনেক ক্ষেত্রে রং-চং মিশিয়ে এমনভাবে সংবাদ প্রকাশ করছে যাতে দেশের সাধারণ মানুষ বিএনপির ওপর বিরক্ত হয় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। 

সবমিলে বিএনপির সার্বিক বিশ্লেষণ হচ্ছে, কথিত ওয়ান-ইলেভেনের প্রাক্কালে বিএনপিকে নিয়ে দেশের সব মিডিয়া বিএনপির বিরুদ্ধে, বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে এবং রিসার্চ সেল হিসেবে পরিচিত ‘হাওয়া ভবন’ নিয়ে অনেক কল্পকাহিনী প্রচার করেছিল। বিশেষত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়ে নানান গুজব প্রচার করেছিল। পক্ষান্তরে ১৬ বছরের স্বৈরশাসন থেকে দেশ মুক্ত হলেও বিগত দিনে সীমাহীন লুটপাট, নৈরাজ্য, হত্যা, গায়েবি মামলা, বিজয়া পরিবারের ওপর অত্যাচার-জুলুম, গুম-খুন নিয়ে তেমন কোনো সংবাদ আসছে না। অথচ অনেক সত্য লুকিয়ে আছে এই ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদ শাসনামলে। বিডিআর হত্যা ঘটনায় কোনো অনুসন্ধান প্রতিবেদন নেই, শাপলা চত্বরে গণহত্যার কোনো প্রতিবেদন নেই, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী আর তাদের অনুচরদের লুটপাটের প্রতিবেদন নেই। গায়েবি মামলা নিয়ে এখন অনেক প্রতিবেদন করা যায় সেসবের কোনো অস্তিত্ব নেই। এর বাইরে এখন বিএনপির যদি ১০টি নিউজ প্রকাশ করা হয় তার মধ্যে অন্তত এমন একটি নিউজ বাছাই করা হয় যেখানে বিএনপিকে অপরাধী হিসেবে তুলে ধরা যায়। 

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ‘প্রবাসীর বাসায় ডাকাতি করলেন যুবদল নেতারা!’, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ছাত্রদলের সম্পৃক্ততা নিয়ে নিউজ করেছে। অথচ ওই ডাকাতির সঙ্গে যুবদলের কোনো সম্পৃক্তনা নেই। আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের কোনো কমিটিই নেই।

এমন অবস্থায় দলের করণীয় বিষয়ে বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, ‘মিথ্যা সমালোচনার জবাবে নয়, ইতিবাচক কাজের মধ্য দিয়ে গণমাধ্যমে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে চায় বিএনপি।’ এর অংশ হিসেবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শুরু থেকে সকল বিষয়ে ধৈর্য্য ও বিচক্ষণতার সঙ্গে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। দলের যে কোনো পর্যায়ের নেতার অনৈতিক কার্যকলাপ সমর্থন না দিয়ে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিয়ে সাংগঠনিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া বিএনপি ঘোষিত ‘৩১ দফা’র ভিত্তিতে মিডিয়ার বিষয়ে করণীয় অনুয়ায়ী দল কাজ করবে। 

বিএনপি ঘোষিত ‘৩১ দফা’র ১১নং দফায় মিডিয়ার বিষয়ে বলা হয়েছে। এই দফায় উল্লেখ করা হয়, গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান ও সার্বিক সংস্কারের লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি, মিডিয়া সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী এবং বিজ্ঞ, অভিজ্ঞ ও গ্রহণযোগ্য মিডিয়া ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি ‘মিডিয়া কমিশন’ গঠন করা হবে। সৎ ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশ পুনরুদ্ধার করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এই লক্ষ্যে সন্ত্রাসবিরোধী আইন-২০০৯ এর প্রয়োজনীয় সংশোধনসহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সব কালাকানুন বাতিল করা হবে। চাঞ্চল্যকর সাগর-রুনি হত্যাসহ সব সাংবাদিক নির্যাতন ও হত্যার বিচার নিশ্চিত করা হবে।

যাযাদি/ এসএম