দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখতে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে বিএনপি। দখল লুটপাটের জন্য বহিষ্কারের মতো শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি বেফাঁস মন্তব্য করা নেতাদেরও ছাড় দেওয়া হবে না বলে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। দলের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুুকে বেফাঁস বক্তব্য দেওয়ার জন্য কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অনেক স্থানে বিএনপি নেতাকর্মী বিক্ষুব্ধ-বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাদের নামে জমি, দোকান ও মার্কেট দখল, লুটতরাজ, চাঁদাবাজি এবং প্রতিপক্ষের ওপর হামলাসহ নানা ধরনের অভিযোগ পায় কেন্দ্র। এসবের লাগাম টানতে কেন্দ্র থেকে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত কয়েক দিনে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে যুবদলের প্রায় ৬০, ছাত্রদলের ১০, বিএনপির ১৫ ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কয়েকজন রয়েছেন।
এ ছাড়া তিন জেলায় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। শাস্তি পাওয়া নেতাদের মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছেনÑ ঢাকা মহানগর, বগুড়া, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরিশাল, পঞ্চগড়, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নরসিংদী, নোয়াখালী, ঝিনাইদহ, লালমনিরহাট ও লক্ষ্মীপুর জেলার। ছাড় দেওয়া হচ্ছে না কেন্দ্রীয় নেতাদেরও। গত রোববার বিএনপির বরিশাল বিভাগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিনের দলীয় পদ স্থগিত করা হয়েছে। শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে বৃহস্পতিবার হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হাশিমকে বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। আর শুক্রবার নীতি ও আদর্শের চরম পরিপন্থি বক্তব্য দেওয়ায় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত নোটিশে বলা হয়েছে, শুক্রবার ‘শেখ হাসিনার ছবি প্রচার করলে টিভি-পত্রিকা জ্বালিয়ে দেওয়া হবে’ মর্মে আপনি যে বক্তব্য দিয়েছেন তা দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আপনার এই বক্তব্য বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির নীতি ও আদর্শের চরম পরিপন্থি। বিএনপি দেশের একটি উদার ও বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। দলটি কখনোই দখল ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রশ্রয় দেয় না।
গত ১৫-১৬ বছর ধরে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে গিয়ে বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী স্বৈরাচারী সরকারের ভয়াবহ নিপীড়ন ভোগ করেছে। সম্প্রতি কোমলমতি শিক্ষার্থী ও জনতা নিজেদের জীবন দিয়ে রক্তঝরা আন্দোলনে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতন ঘটিয়ে বর্তমানে দেশে গণতন্ত্রের যে জাগরণ সৃষ্টি করেছে, আপনার বক্তব্য সেটিকেও কালিমালিপ্ত করেছে।’
‘আপনার বক্তব্যটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অনভিপ্রেত এবং বিএনপির গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতি কুঠারাঘাত। বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে আপনার এই বক্তব্য গত দেড় দশক ধরে রক্তস্নাত পথে বিএনপির নিরবচ্ছিন্ন গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মহিমাহ্নিত অবদানকে হেয়প্রতিপন্ন করার শামিল।’
দুলুকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই নোটিশের জবাব দিতে বলা হয়েছে
এদিকে মাঠপর্যায়ে লুটতরাজ, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব ও বিশৃঙ্খলার নজরদারি করতে মূল দলের পাশাপাশি অঙ্গ দলগুলোর জেলা, মহানগর, থানা নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দলের নেতাদের নাম ভাঙিয়ে কেউ কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটালে বা চেষ্টা করার খবর পেলেই দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ছুটে যাচ্ছেন।উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আলোচিত-সমালোচিত সাদিক এগ্রোর জায়গায় বিএনপির সাইনবোর্ড ব্যবহার করে একটি মহল দখলের চেষ্টা করে। খবর পেয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক ওই এলাকায় ছুটে যান। সেখানে খালের জায়গায় গড়ে তোলা রাজনৈতিক কার্যালয়টি দেখে তা ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন। এ ছাড়া আরেকটি হাউজিংয়ের দখলে স্থানীয় নেতা মনোয়ার হোসেন জীবন ওরফে লেদু হাসান এবং তেরেনাম বাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পর তাদের বিষয়টি দেখার আশ্বাস দেন।
দখল-লুটপাটের বিষয়ে দলের অবস্থান প্রসঙ্গে আমিনুল হক বলেন, কিছু দুষ্কৃতকারী, নব্য বিএনপি দলের নাম ব্যবহার করে বিএনপির নামে বদনামের অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এই লোকগুলোই লুটতরাজ, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব ও বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। দুষ্কৃতকারী বিএনপির লোক হলে তাকেও পুলিশে দিতে হবে। কেননা চাঁদাবাজি, দখলদারি, লুটতরাজের বিরুদ্ধে বিএনপির জিরো টলারেন্স নীতি।
শুধু উত্তর বিএনপিই নয় দক্ষিণেও কড়া নজরদারি আছে দলটির নেতাকর্মীদের। এরই মধ্যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাদের জনগণের পাশে থাকার কথা জানিয়েছে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ এই ইউনিট। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বা ওয়ার্ড বিএনপির কোনো নেতার নাম ব্যবহার করে কেউ অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করলে, তাকে ধরিয়ে দেওয়ার বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মহানগর দক্ষিণের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনু, সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিনসহ মহানগর, থানা এবং ওয়ার্ডের নেতাদের নাম ব্যবহার করে কেউ যদি কোনো অনৈতিক সুবিধা দাবি করে, তৎক্ষণাৎ তাকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সোপর্দ করুন।’
একই সঙ্গে তার রাজনৈতিক পরিচয়সহ মহানগরের আহ্বায়ক, সদস্য সচিব এবং দপ্তরে অবহিত করার জন্য জনসাধারণকে অনুরোধও জানিয়েছে মহানগর দক্ষিণ বিএনপি। বিশেষ নির্দেশনার এ বিজ্ঞপ্তিতে মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক ০১৭৯০৪৩৫৪১৩, সদস্য সচিব ০১৯১৬৩৬৪৬৯৭ এবং দপ্তর ০১৭৮৯২৫২০২৮, ০১৭১৫৭৬৭৬৫৫ এই নম্বরে জানাতে বলা হয়েছে।
যে কোনো অনিয়মের বিষয়ে দলের অবস্থান প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান যায়যায়দিনকে বলেন, দেশের অনিয়ম দূর করতে আন্দোলন করেছি। দলের কেউ যদি কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকে তা বরদাশত করা হবে না।
যাযাদি/ এস