রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

কোটা বিরোধী আন্দোলন : নৈরাজ্যের শঙ্কায় অ্যাকশনে প্রস্তুতি

সাখাওয়াত হোসেন
  ০৯ জুলাই ২০২৪, ১৪:৪৫
-ফাইল ছবি

সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা বাতিলের দাবিতে চলমান আন্দোলন ক্রমান্বয়ে বিস্তৃত হওয়ার পাশাপাশি এর গতি-প্রকৃতিও দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। আন্দোলনের শুরুতে শুধু উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ শিক্ষার্থীরা মাঠে নামলেও বিগত সময়ের মতো এতে এখন বহিরাগতরাও যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে।

এছাড়া সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল ও স্বার্থান্বেষী বিশেষ গোষ্ঠী নানাভাবে উসকানি দিয়ে আন্দোলনকে সহিংসতায় রূপ দেওয়ার অপচেষ্টা চালাতে পারে। যা কোটা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে কোটা আন্দোলন যে কোনো মুহূর্তে নৈরাজ্যের দিকে টার্ন করতে পারে।

অনাকাক্সিক্ষত এ পরিস্থিতির উদ্ভব হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাতে জনগণের জান-মাল ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে সে জন্য তাদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের যাতে কঠোর হাতে দমন করে দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়া যায় এজন্য তাৎক্ষণিক অ্যাকশনে নামার প্রস্তুতি রাখার তাগিদ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এছাড়া কোটাবিরোধী আন্দোলনে কৌশলে ঢুকে পড়ে বহিরাগত যাতে কোনোভাবেই সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে এজন্য গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করতে বলা হয়েছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, নৈরাজ্যকর যে কোনো পরিস্থিতি সামাল দিতে এরই মধ্যে ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রয়োজনে জলকামান, এপিসি ও রায়ট কার ব্যবহার করা হবে। নাশকতার কোনো পরিকল্পনা নিয়ে কেউ মাঠে নামলে তাদের তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার করবে পুলিশ। এ জন্য আগাম তথ্য সংগ্রহে শুধু আন্দোলনের মাঠেই নয়, পাড়া-মহল্লাসহ নগরীর সর্বত্র গোয়েন্দাদের তৎপর রাখা হচ্ছে।

এদিকে আন্দোলনকারীরা যাতে কোনো বিশেষ মহলের ইন্ধনে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টির ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা না দেয়, এ ব্যাপারে তাদেরও সতর্ক করা হচ্ছে। এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কোটাবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এরই মধ্যে তাদের সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তারা দুই দফা আলোচনায় বসেছে।

গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানায়, একটি দুষ্কৃৃতিকারী চক্র অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে থাকে। বিভিন্ন গোষ্ঠী নিজেরা সহিংসতায় সরাসরি অংশ না নিয়ে তাদের ব্যবহার করে। তাদের কাছ থেকে অবৈধ অস্ত্র, শক্তিশালী বোমা ও ককটেলসহ বিভিন্ন বিস্ফোরক দ্রব্য সংগ্রহ করা হয়। কখনো কখনো এসব দুষ্কৃৃতিকারী ভাড়াটে কর্মী হিসেবে নৈরাজ্য সৃষ্টির মিশনে অংশ নেয়। এই চক্র যাতে কোনো বিশেষ গোষ্ঠী কর্তৃক ব্যবহৃত হতে না পারে সেদিকেও গোয়েন্দারা কড়া নজর রাখছে।

অন্যদিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক আন্দোলন চলাকালে একটি গোষ্ঠী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ভিন্ন কোনো অপকৌশলে গুজব ছড়িয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে থাকে। এ চক্র যাতে কোটাবিরোধী আন্দোলনকে ইস্যু করে এ ধরনের অপতৎপরতা চালাতে না পারে এ ব্যাপারে সাইবার ক্রাইম ইউনিটসহ একাধিক টিমকে তৎপর রাখা হয়েছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা জানান, কোটাবিরোধী আন্দোলন পরিস্থিতি তারা সার্বক্ষণিক নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচিতে তারা কোনো ধরনের বাধা দেবে না। বরং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিও সহনশীলতার সঙ্গে মোকাবিলা করার চেষ্টা করবে। তবে কর্মসূচি পালনের নামে তাণ্ডব চালানোর চেষ্টা করলে তা যাতে কঠোরভাবে দমন করা যায় তার সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। কোনো কর্মসূচিতে নৈরাজ্য সৃষ্টির আগাম তথ্য পাওয়া গেলে গোটা এলাকা কর্ডন করে রাখা হবে। ওইসব স্পটে রায়ট কার, জলকামান ও দাঙ্গা ফোর্স মোতায়েন রাখারও আগাম নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

তবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যাতে কোনোভাবেই অহেতুক হয়রানি-নির্যাতনের শিকার না হন, সেদিকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতনরা। তারা জানান, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা ঠেকানোই হবে পুলিশের মূল লক্ষ্য। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ যাতে অতি উৎসাহী হয়ে কিংবা কোনো বিশেষ মহলের উসকানির ফাঁদে পা দিয়ে কোনো ধরনের অ্যাকশনে না নামে সে ব্যাপারেও কঠোর নির্দেশনা রয়েছে।

মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, চলমান আন্দোলনের শুরু থেকেই পুলিশ সর্বোচ্চ সহনশীল অবস্থানে রয়েছে। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কোথাও কোনো সংঘাতে যায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা সড়ক-মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ করছেন। এক সপ্তাহ ধরে ঢাকায় গুরুত্বপূর্ণ শাহবাগ মোড়সহ অন্তত ৬টি স্পট অবরোধ করা হচ্ছে। সেখানে আন্দোলনকারীরা কেউ কেউ পুলিশের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন। তবে সরকারের পক্ষ সরাসরি আন্দোলনে বাধা না দিয়ে সহনশীল থাকার নির্দেশনা দেওয়ায় পুলিশ অনেকটা দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। যদিও জনদুর্ভোগ কমাতে পুলিশ সরব রয়েছে।

এদিকে শুধু ঢাকাতেই নয়, দেশের যে কোনো এলাকায় আন্দোলনকারীরা সংঘাত-সহিংসতা বা নাশকতার দিকে অগ্রসর হলে পুলিশ তাৎক্ষণিক অ্যাকশনে নামবে। এ ব্যাপারে লিখিত বার্তা দেওয়া না হলেও মৌখিক নির্দেশনা রয়েছে বলে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা স্বীকার করেন।

ঢাকা ও ঢাকার বাইরের একাধিক থানার ওসিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যারা কোটাবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন, তাদের ব্যাপারে তারা নিয়মিত খোঁজখবর রাখছেন। বিশেষ করে আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তারা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মী কিংবা দুষ্কৃতিকারী চক্রের সঙ্গে গোপন কোনো বৈঠক বা আঁতাত করছে কিনা সে ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রয়েছে। এছাড়া আন্দোলনের নামে সড়ক-মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে জনদুর্ভোগ অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে আন্দোলনকারীরা ক্ষুব্ধ জনতার মুখোমুখি হয়ে না পড়েন সে বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ড. খ মহিদ উদ্দিন বলেন, জনদুর্ভোগের বিষয়টি বিবেচনায় রাখার জন্য আন্দোলনকারীদের অনুরোধ করা হয়েছে। বিশেষ করে দীর্ঘ সময় সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করে রাখার কারণে সাধারণ মানুষের যে ভোগান্তি হচ্ছে তা অবর্ণনীয়। তাই এ ব্যাপারে তারা যেন সহনুভূতিশীল হন। এছাড়া এ আন্দোলনে যেন কোনো দুষ্কৃতিকারী প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন।

কোটাবিরোধী আন্দোলন পুলিশের সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ রয়েছে দাবি করে এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, কোনো ধরনের সহিংস আচরণ করা হলে পুলিশ অ্যাকশনে যাবে। সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এদিকে ঢাকার বাইরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের যেসব উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গত কয়েকদিন ধরে সড়ক-মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে আন্দোলন করছে সেখানকার পরিস্থিতিও পর্যবেক্ষণ করছে গোয়েন্দারা।

একইসঙ্গে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীদের গতিবিধি নজরে রাখা হচ্ছে। প্রশাসনের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, কোটাবিরোধী আন্দোলন সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রেখে তা সামাল দিতে চায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে এতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হস্তক্ষেপ তাদের কাম্য নয়। কেননা গোয়েন্দারা মনে করেন, কোটাবিরোধী আন্দোলন প্রতিহত করতে ছাত্রলীগ মাঠে নামলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের মুখোমুখি অবস্থানে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। যা সামাল দেওয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। বরং ছাত্রলীগ নিস্ক্রিয় থাকলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বাগে রাখা পুলিশের পক্ষে সহজ হবে। তাই কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ওপরও নজর রাখতে গোয়েন্দাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

যদিও ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি খাদেমুল বাশার জয় জানান, কোটা আন্দোলন তারা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। আন্দোলনের নামে পরিস্থিতি অশান্ত করে তোলার ষড়যন্ত্র হলে ছাত্রলীগ তার করণীয় ঠিক করবে। বিএনপি-জামায়াত যাতে এই পরিস্থিতির ফায়দা লুটতে না পারে এ জন্য ছাত্রলীগ সতর্ক রয়েছে।

তবে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর একজন সদস্য জানান, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগ মাঠে নামলে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। ত্রিমুখী সংঘর্ষের ফলে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করেছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে এবার জটিলতা এড়াতে সংযমী আচরণ করছে। আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেটি চূড়ান্ত পর্যায়ে।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে