রাজপথে বাড়ছে উত্তাপ : সর্বোচ্চ সতর্ক পুলিশ

প্রকাশ | ২৪ জুলাই ২০২৩, ০৯:৪৬

সাখাওয়াত হোসেন

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী জোট ও বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মসূচি বাড়ছে। বড় ধরনের শোডাউনের মধ্য দিয়ে দু’পক্ষই ক্ষমতা প্রদর্শনের চেষ্টা করছে। প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হলেই রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়াচ্ছে। 

আন্দোলন কর্মসূচিতে কর্তৃত্ব জাহির করতে গিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যেও হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে ১৭৯টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ২ হাজার ৪২২ জন আহত এবং ১৪ জন নিহত হয়েছেন। উত্তপ্ত রাজপথ সামলাতে র‌্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনী প্রচণ্ড চাপের মুখে পড়েছে।

আন্দোলন কর্মসূচির নামে রাজপথে কেউ যাতে জ্বালাও-পোড়াও ও ভাঙচুরসহ কোনো ধরনের তাণ্ডব চালাতে না পারে সে জন্য আগাম গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি টহল কার্যক্রম জোরদার রাখার প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। সভা-সমাবেশ, পদযাত্রা ও মিছিলে প্রতিপক্ষের আকস্মিক হামলা মোকাবিলায় প্রতিটি কর্মসূচির গুরুত্বপূর্ণ স্পটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা র‌্যাব-পুলিশের বড় দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর্মসূচি স্থলে আসা-যাওয়ার পথে তল্লাশি অভিযান চালাতে হচ্ছে। একই সঙ্গে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি চলাকালে দু’পক্ষের নেতাকর্মীরা যাতে সংঘর্ষ জড়িয়ে পড়তে না পারে এ জন্য গড়ে তুলতে হচ্ছে শক্ত প্রতিরোধ দেয়াল। 

অন্যদিকে রাজনৈতিক সহিংসতার নিত্য-নতুন ঘটনায় মামলা রুজু, তদন্ত এবং সংশ্লিষ্ট আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশকে সর্বোচ্চ তৎপর থাকতে হচ্ছে। চোরাগোপ্তা হামলা, বোমাবাজি ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা নতুন করে যাতে আর ঘটতে না পারে এজন্য চিহ্নিত নাশকতাকারীদের গতিবিধিও সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে পুলিশের কাজের চাপ স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়েছে। 

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের এডিসি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, চুরি, ডাকাতি, খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে মাঠপর্যায়ের প্রতিটি পুলিশ কর্মকর্তা-সদস্যকে সার্বক্ষণিক তৎপর থাকতে হয়। এছাড়া বিভিন্ন অপরাধের মামলা তদন্ত তাদের রুটিন ওয়ার্ক। অথচ গত কয়েক মাস ধরে আওয়ামী লীগ-বিএনপির একের পর এক পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি এবং এতে সৃষ্ট সংঘাত-সহিংসতা মোকাবিলা করতে পুলিশকে প্রায়ই ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। যা অপরাধ দমন ও মামলা তদন্ত কার্যক্রমকে ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত করছে।

ডিএমপির অপরাধ জোনের দায়িত্বশীল এ পুলিশ কর্মকর্তার দাবি, কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের ক্যাডাররা সম্প্রতি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা আন্দোলন কর্মসূচির নামে রাজপথে নেমে নাশকতা চালানোর পাঁয়তারা করছে। সুযোগ পেলেই তারা প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এসব হামলায় সাধারণ জনগণও নিস্তার পাচ্ছে না। যা সামলাতে পুলিশকে সর্বোচ্চ প্রস্তুত থাকতে হচ্ছে। 

গোয়েন্দা পুলিশের একজন সহকারী কমিশনার জানান, রাজনৈতিক কোনো বড় দল কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করলেই তাদের ফোর্স ডেপ্লেয়মেন্ট ছক সাজাতে হয়। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, কর্মসূচি স্থলের ভিডিও ফুটেজ ও স্থির চিত্র ধারণে কর্মকর্তা-সদস্য মোতায়েন তালিকা তৈরি করে তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করতে হয়। এ সময় তাদের অনেক রুটিন ওয়ার্ক কাটছাঁট করতে হচ্ছে। যার ঘাটতি পূরণে পরবর্তীতে তাদের অতিরিক্ত ডিউটি করতে হচ্ছে।

এদিকে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের দাবি, রাজপথের উত্তাপ সামলে জনগণের জানমাল রক্ষার্থে প্রায় তাদের জীবনের ঝুঁকি নিতে হচ্ছে। দু’পক্ষের সংঘর্ষ ঠেকাতে তারা প্রতিরোধের দেয়াল গড়ে তোলার চেষ্টা চালালে উভয়পক্ষই তাদের ওপর আক্রমণ করছে। তাদের নাশকতায় বাধা দিলেও হামলা চালাচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হলে তারা বাধ্য হয়ে লাঠিচার্জ ও টিয়ার শেল ছুড়ে পিকেটারদের ছত্রভঙ্গ করছেন। ভয়াবহ পরিস্থিতিতে প্রয়োজনে ফাঁকা গুলি ও রাবার বুলেট ছুড়তে হচ্ছে। অথচ এ নিয়ে অনেকে ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকার’ করছে।

ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের একাধিক সার্জেন্ট ও টিআই জানান, বড় যে কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতেই গোটা রাজধানী স্থবির হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ব্যস্ত সড়কে কোনো কর্মসূচি হলে নগরীর যানজট পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। যা সামলাতে তাদের নাভিশ্বাস ওঠে।

সংশ্লিষ্ট ট্রাফিক কর্মকর্তাদের অভিযোগ, বিভিন্ন এলাকা থেকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগ দিতে আসা নেতাকর্মীদের বহনকারী অধিকাংশ যানবাহন ট্রাফিক আইনের তোয়াক্কা করে না। তারা খেয়াল-খুঁশিমতো উল্টোপথে গাড়ি চালিয়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে গেলে উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয়। এমনকি অনেক সময় তারা সড়কের মাঝখানে আড়াআড়িভাবে যানবাহন দাঁড় করিয়ে রাস্তা অবরোধ করে যানজট পরিস্থিতি ভয়াবহ করে তোলে। 

এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজপথের উত্তাপ বাড়লে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও কতটা বেশি চাপে পড়তে হবে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। তাদের আশঙ্কা, পুলিশের ওপর রাজপথ সামাল দেওয়ার মাত্রাতিরিক্ত চাপ বাড়লে দেশের অপরাধ পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেবে। কেননা, এ কাজে তাদের ব্যস্ততার সুযোগে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠবে। খুনি, ছিনতাইকারী, ডাকাত, চাঁদাবাজ ও ধর্ষকসহ বিভিন্ন গুরুতর অপরাধে সম্পৃক্ত অপরাধীদের ধরপাকড়ে পুলিশ জোরালো ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হবে। মামলা তদন্তেও ভাটার টান পড়বে। 

তাদের এ আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তা গত কয়েক মাসের অপরাধচিত্র পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) আটটি বিভাগের ৫০টি থানার বিভিন্ন এলাকায় হঠাৎ করেই খুনের ঘটনা বেড়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন এই ছয় মাসে রাজধানীতে ৮৪টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে গেল জুন মাসেই খুনের ঘটনা ঘটেছে ২৪টি। এর মধ্যে রমনা বিভাগে চারটি, ওয়ারী বিভাগে পাঁচটি, মতিঝিলে একটি, তেজগাঁওয়ে তিনটি, মিরপুরে তিনটি, গুলশানে পাঁচটি ও উত্তরা বিভাগে তিনটি ঘটনা রয়েছে।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত রমনা জোনে ৯টি, লালবাগ জোনে পাঁচটি, ওয়ারী জোনে ২০টি, মতিঝিল জোনে ছয়টি, তেজগাঁও জোনে ১৩টি, মিরপুর জোনে ১১টি, গুলশান জোনে ১১টি, উত্তরা জোনে ৯টি খুনের ঘটনা ঘটেছে।

এছাড়া জুন মাসে ওয়ারী এবং তেজগাঁও জোনে একটি করে এবং গুলশান জোনে দু’টি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ছিনতাই কিংবা দস্যুতার ঘটনায় ২৪টি মামলা দায়ের হয় বিভিন্ন থানায়। ছয়টি অপহরণের ঘটনা ঘটে এবং দু’টি সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। সিঁধেল চুরির ঘটনা ঘটে তিনটি।

অন্যদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) দেওয়া তথ্যানুযায়ী, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ৬৩টি সংঘর্ষের ঘটনায় ৬৬৬ জন আহত ও ১০ জন নিহত হয়েছে। বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের অভ্যন্তরীণ বিরোধের জের ধরে ১২টি সংঘর্ষের ঘটনায়  আহত হয়েছে ৯৯ জন এবং নিহত ২ জন। জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরীণ কোন্দলে আহত হয়েছে ১২ জন। 

এছাড়া বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ৪২টি সংঘর্ষে ৭৪৮ জন; বিএনপি ও যুবলীগ-ছাত্রলীগের ১৩টি সংঘর্ষে ১৫৪ জন; আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টির ১টি সংঘর্ষে ২৫ জন; ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের ২টি সংঘর্ষে ৬০ জন; ছাত্রলীগ-সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের ১টি সংঘর্ষে ১২ জন ও আওয়ামী লীগ-গণতন্ত্র মঞ্চের ১টি সংঘর্ষে ১৫ জন আহত হয়েছে।

এদিকে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির ২০টি সংঘর্ষে ৪১৫ জন, ছাত্রদলের সঙ্গে পুলিশের ১টি সংঘর্ষে ১৫ জন এবং ছাত্রলীগ-ছাত্রদল ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষে ১৩ জন আহত হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১০টি সংঘর্ষে ৯০ জন, পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৫ জন, উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৮ জন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৭টি সংঘর্ষের ঘটনায় ৭০ জন এবং উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৫ জন আহত হয়।

উত্তপ্ত রাজপথ সামলাতে পুলিশের চাপে থাকার কথা স্বীকার করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, দীর্ঘদিন ধরে জনবিচ্ছিন্ন বিএনপি আকস্মিক আন্দোলনের নামে রাজপথে নেমে নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। জনগণের ভোগান্তির কথা বিবেচনায় না নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই কর্মসূচি দিচ্ছে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় যেহেতু যে কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি দেওয়ার অধিকার রয়েছে, তাই তাদের সে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। তবে তারা যাতে আন্দোলনের নামে জনগণের জানমালের কোনো ক্ষতি করতে না পারে সে জন্য পুলিশকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হচ্ছে। নাশকতাকারীসহ বিভিন্ন অপতৎপরতায় সম্পৃক্ত অপরাধীদের গ্রেপ্তারেও পুলিশ সর্বোচ্চ তৎপরতা চালাচ্ছে।

এদিকে নির্বাচনের আগে পুলিশের চাপ আরও বাড়বে বলে মনে করেন খোদ সংস্থাটির প্রধান আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি বলেন, আগামীতে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত নানা চ্যালেঞ্জ আসতে পারে। আইনশৃঙ্খলার যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। আন্দোলন কর্মসূচির নামে দেশকে অস্থিতিশীল করার যে কোনো ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে। এজন্য পুলিশের প্রয়োজনীয় লজিস্টিকস, প্রশিক্ষণ এবং পুলিশ সদস্যদের দৃঢ় মনোবল রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর যে কোনো চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিতে পুলিশ এরই মধ্যে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েছে।

যাযাদি/ এস