কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার সংকট ও সম্ভাবনার বাস্তব পর্যালোচনা
প্রকাশ | ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৭:৪৫

হায়রে কওমি মাদ্রাসা! আর কবে তোর ঘুম ভাঙবে!!??
বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসা একটি প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা। দীর্ঘ ইতিহাস, ত্যাগ ও একনিষ্ঠতায় গড়ে ওঠা এই ব্যবস্থার ভেতরে আজ স্পষ্ট সংকট ও বিকার দৃশ্যমান। এই লেখাটি কেবল সমালোচনা নয়; এটি একজন দায়িত্বশীল মানুষ ও অভ্যন্তরীণ পর্যবেক্ষকের বাস্তব ও ব্যথিত বিবেচনার ফল। আমরা এখানে তিনটি স্তরে কওমি ব্যবস্থার সমস্যাবলি ও সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করব—শিক্ষাগত ঘাটতি, মানবিক অবহেলা, এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংকীর্ণতা।
এক. শিক্ষাগত ঘাটতি ও ভবিষ্যৎ-অভিমুখহীনতা
দারুল উলুম দেওবন্দের ইতিহাস ও আকাবিরদের জীবনী ছাত্রদের মাঝে জোর দিয়ে পড়ানো হয়। অথচ মুসলিম সভ্যতার বিস্তৃত ইতিহাস—খিলাফতে রাশেদা, উমাইয়া ও আব্বাসীয় খেলাফত, সালজুক ও ওসমানীয় সাম্রাজ্য, এমনকি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রাষ্ট্রনীতি ও দাওয়াতি কৌশল—সেগুলো গুরুত্ব পায় না। ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়।
এদের অধিকাংশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো দিকনির্দেশনা থাকে না। ‘দারস’ পড়া আর ‘তাকরার’ করাকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য মনে করে চলে। বিয়ে, সংসার, সামাজিক দায়িত্ব, আত্মীয়-স্বজন, অর্থনৈতিক সচ্ছলতা—এসব মৌলিক মানবিক বাস্তবতাকে তারা অবহেলা করে। অনেক ছাত্র ঘুম ভেঙে উঠে দেখে—না আছে ঘর, না আছে চাকরি, না আছে জীবনের দিশা। তখন তারা মুহতামিম সাহেবের পেছনে ঘুরে বেড়ায় কোনো সস্তা বেতনের ‘খেদমত’ পাওয়ার আশায়।
দুই. মানবিক অবহেলা ও দ্বৈত নীতি
মাদ্রাসার ফান্ড যেন কেবল মুহতামিম সাহেবের ব্যক্তিগত অতিথি আপ্যায়নের জন্যই নির্ধারিত। অন্য কোনো শিক্ষক নিজের খরচে আত্মীয়কে মেহমান করলে প্রশ্ন ওঠে, “এত মেহমান কেন আসে?” মুহতামিম সাহেব তাঁর আত্মীয়র অসুস্থতার খবরে গ্রামে গেলেই ছুটি মঞ্জুর হয়; কিন্তু সাধারণ শিক্ষক বা কর্মীর জন্য ছুটি হয়ে যায় কঠিনতম ব্যাপার।
এই ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক হয়ে পড়েন চাপে জর্জরিত, আবদ্ধ, নিঃস্ব, এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়া একজন মানুষ। তার স্ত্রী—যিনি সংসারের আশায় শ্বশুরবাড়িতে এসেছিলেন—অপেক্ষার বোঝা নিয়ে দিন গোনে। এ এক নির্মম বাস্তবতা, যেখানে শরীয়তের বিধান থাকা সত্ত্বেও জীবন ব্যাহত হয় প্রতিষ্ঠানের একপাক্ষিক নিয়মে।
তিন. প্রাতিষ্ঠানিক সংকীর্ণতা ও প্রতিভা-নিষ্পেষণ
কিছু কওমি ছাত্র দুনিয়াবি পড়াশোনায় আগ্রহী হলে তাদের নিরুৎসাহিত করা হয়, এমনকি দাখিল পরীক্ষার জন্য বহিষ্কারও করা হয়েছে। একজন ছাত্র যদি এগিয়ে যায়, তাকে অন্য কওমি মাদ্রাসায় স্থান দেওয়া হয় না।
এখানে একটি বাস্তব তুলনা জরুরি—ড. আ.ফ.ম খালিদ হোসেন, যিনি আজ ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, তিনিও একসময় কওমি ধারার অংশ ছিলেন। অথচ আজ তার মতো ১০০ জন তৈরি করতে পারল না এই শিক্ষা ব্যবস্থা, বরং সেই পথ রুদ্ধ করেই চলছে।
একজন মেধাবী ছাত্র যদি কওমি আদর্শ লালন করে, পাশাপাশি আধুনিক দক্ষতা অর্জন করে প্রশাসন, ব্যবসা, শিক্ষা বা স্বাস্থ্যখাতে ভূমিকা রাখতে পারত, তাহলে কওমি শিক্ষার গ্রহণযোগ্যতা বহু গুণে বাড়ত। তখন ছাত্ররাও সম্মান পেত, আত্মমর্যাদা পেত এবং কওমি মাদ্রাসা আরও সমৃদ্ধ হতো সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির অনুদানে।
প্রস্তাবনা ও উপসংহার
এই সংকট কাটাতে কিছু বাস্তব পদক্ষেপ এখনই গ্রহণ করা দরকার—
১. পাঠ্যক্রমে ঐতিহাসিক বিস্তার:
খোলাফায়ে রাশেদা থেকে শুরু করে আধুনিক দাওয়াতি আন্দোলন পর্যন্ত ইসলামের ইতিহাসকে গুরুত্ব সহকারে যুক্ত করা।
২. দাওয়াতি দর্শনের সংস্কার:
‘ঘৃণা’ নয়, ‘দাওয়াত ও হিকমাহ’-এর নীতিতে মানুষকে আকর্ষণ করার চেতনা গড়ে তোলা।
৩. দুনিয়াবি দক্ষতা:
ভাষা, কম্পিউটার, প্রযুক্তি, লেখালেখি, অর্থনীতি ও জনসংযোগে মৌলিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা।
৪. শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের মানবিকীকরণ:
ছুটি, পারিবারিক সময়, এবং মেহমানদারিতে সমতা ও মানবিকতা নিশ্চিত করা।
৫. প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার:
দাখিল বা এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা এবং অনুপ্রবেশ-নির্ভর নয়, মেধা-নির্ভর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা।
শেষ কথা:
এই লেখার মূল সুর শুধুই দুঃখের নয়—এ এক সম্ভাবনার ডাক। কওমি মাদ্রাসা যদি সাহস করে নিজের ভিতরটা জাগিয়ে তোলে, যদি আত্মসমালোচনার পথে চলে, তাহলে হয়তো আগামী প্রজন্ম আর বলতে বাধ্য হবে না—
“হায়রে কওমি মাদ্রাসা! আর কবে তোর ঘুম ভাঙবে?”
লেখক: ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম
চেয়ারম্যান - আলহাজ্ব কে.এম. আব্দুল করীম (রহ.) ট্রাস্ট