বালু উত্তোলন স্বাভাবিক নদী ব্যবস্থাপনার অংশ হতে পারে, যদি তা সঠিক পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণের আওতায় পরিচালিত হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আমাদের দেশে ড্রেজার মেশিনের মাধ্যমে অবৈধভাবে, যথেচ্ছভাবে বালু উত্তোলন একটি ভয়াবহ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবৈধ কর্মকাণ্ড শুধু নদী ও পরিবেশ নয়, মানব জীবন ও অর্থনীতিকেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
প্রথমত, নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ ব্যাহত হয়। ড্রেজার দিয়ে নির্বিচারে নদীর তলদেশ থেকে বালু তুললে নদীর গভীরতা ও প্রস্থ অস্বাভাবিকভাবে পরিবর্তিত হয়। ফলে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ নষ্ট হয়, পানির প্রবাহে অস্থিরতা তৈরি হয় এবং একদিকে ভাঙন, অন্যদিকে পলি জমার সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয়ত, নদীর তীরবর্তী ভাঙন ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। অতিরিক্ত বালু উত্তোলনের ফলে নদীর পাড় দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বর্ষা মৌসুমে বা একটু বেশি স্রোত এলেই গ্রাম, ফসলি জমি, সড়ক ও অবকাঠামো ধসে পড়ে। হাজার হাজার মানুষ তাদের বসতভিটা হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে, আর জাতি হারায় মূল্যবান কৃষি ও সামাজিক সম্পদ।
তৃতীয়ত, জলজ প্রাণিবৈচিত্র্য ধ্বংস হয়। নদীর তলদেশের বাস্তুসংস্থান (Aquatic Ecosystem) অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর। যেখানে বালু উত্তোলন করা হয়, সেখানে মাছের ডিম পাড়ার স্থান নষ্ট হয়ে যায়, ছোট প্রাণী ও জলজ উদ্ভিদ নিঃশেষ হয়ে পড়ে। এতে করে সামগ্রিক মৎস্য সম্পদ ও নদী-নির্ভর জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
চতুর্থত, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস পায়। নদীর তলদেশে অতিরিক্ত খনন ভূগর্ভস্থ পানির পুনঃভরণ প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। ফলে এলাকার পানির স্তর নেমে যায়, নলকূপ ও কূপের পানি শুকিয়ে যায় এবং কৃষি ও জনজীবনে পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়।
পঞ্চমত, পরিবেশ দূষণ বৃদ্ধি পায়। ড্রেজার চালাতে প্রচুর ডিজেল বা ইঞ্জিন ফুয়েল ব্যবহার হয়, যার কারণে নদীর পানিতে তেল মিশে যায়। পানিদূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করে, যা মানুষ ও প্রাণীর স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।
সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, এই অবৈধ বালু উত্তোলন নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে সংঘটিত হয়, স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী মহলের মদদে। ফলে পরিবেশ আইনের প্রয়োগ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ন্যায়বিচার ও টেকসই উন্নয়নের পথ আরও কঠিন হয়ে ওঠে।
করণীয় কী?
১. কঠোরভাবে অবৈধ ড্রেজার পরিচালনা নিষিদ্ধ করতে হবে।
২. পরিবেশ অধিদপ্তর, নদী রক্ষা কমিশন ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
৩. জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে—কারণ পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার।
৪. টেকসই নদী ব্যবস্থাপনার জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
৫. পরিবেশবান্ধব বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে অবৈধ বালু ব্যবসার প্রতি নির্ভরতা কমাতে হবে।পরিবেশ ও নদী হলো আমাদের অস্তিত্বের মূল ভিত্তি। অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ না হলে একদিন আমাদের অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড়াতে হবে। তাই এখনই সময়, কঠোরভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার—নইলে আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে যাব এক ধ্বংসস্তূপ।
লেখক : চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট মানবাধিকার আইন বিশেষজ্ঞ এবং মানবাধিকার কর্মী।
যাযাদি/ এসএম