পতিতাবৃত্তি কি শ্রম? রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সমাজের বাস্তবতা 

প্রকাশ | ২২ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৪৬ | আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২৫, ১৩:১৪

মো. আসিফ হাসান রাজু
ফাইল ছবি

বর্তমানে যৌনপেশাকে “শ্রম” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাবটি বিশ্বজুড়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

অনেক মানবাধিকার সংস্থা যৌনকর্মীদের ‘অধিকার’ ও ‘সম্মানজনক শ্রম’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায়। জাতিসংঘের UNAIDS ২০২১ সালে যৌনপেশাকে প্রাপ্তবয়স্কদের সম্মতিসাপেক্ষ শ্রম (consensual adult labor) হিসেবে বৈধতার পক্ষে মত দেয়। 

যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, নিউজিল্যান্ডের মতো দেশগুলো যৌনকর্মীদের জন্য আইনি সুরক্ষা ও শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করতে নীতিগত পরিবর্তন এনেছে। বাংলাদেশেও নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। দেশের ১১টি স্বীকৃত যৌনপল্লিতে প্রায় এক লাখ নারী এই পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও, আইনি স্বীকৃতি তাদের সামাজিক মর্যাদা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা বা পুনর্বাসনের সুযোগ বাড়াতে পারেনি। 

 রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থাকলেও সমাজ এখনও এই পেশাকে অসম্মানজনক বলে গণ্য করে। ফলে প্রশ্ন ওঠে—শুধু আইন দিয়ে কি সমাজ বদলায়?

নৃবৈজ্ঞানিকভাবে যৌনপল্লি একটি ভৌগোলিক স্থানই শুধু নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক ও শ্রেণিভিত্তিক বাস্তবতা। Erving Goffman-এর “stigma” তত্ত্ব অনুযায়ী, পতিতালয়ে অবস্থানকারী নারীরা সমাজের চোখে একটি “দাগযুক্ত পরিচয়” বহন করেন—যা তাদের ব্যক্তি হিসেবে মূল্যায়নকে বাধাগ্রস্ত করে। আবার Pierre Bourdieu-এর “symbolic violence” ধারণা অনুযায়ী, সমাজ সাংস্কৃতিক কাঠামোর মধ্য দিয়েই নারীর ওপর এক ধরনের নীরব সহিংসতা চালায়, যার ফলে একজন যৌনকর্মী কেবল শরীরসর্বস্ব ‘সেবাদানকারী’ রূপেই পরিগণিত হন।

যৌনপেশাকে শ্রম হিসেবে বৈধতা দিলে তা সমাজের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য একটি “সহজ আয়ের পথ” হিসেবে প্রলুব্ধ করতে পারে। বিশেষ করে যখন অন্য পেশায় প্রবেশের দরজা তাদের জন্য বন্ধ থাকে, তখন এই স্বীকৃতি হয়ে ওঠে একটি বিপজ্জনক বিকল্প।

এখানে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামে পতিতাবৃত্তি স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ। কুরআনে বলা হয়েছে, “আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না; নিঃসন্দেহে এটি অশ্লীল কাজ ও নিকৃষ্ট পথ” (সূরা বনী ইসরাইল: ৩২)। ইসলামের এই নির্দেশ শুধু যৌনপাপ থেকে বিরত থাকার কথাই বলেনি, বরং সেই পথে যাওয়ার সম্ভাব্য পরিবেশ ও প্রলোভন থেকেও বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। নবী করীম (সা.) বলেছেন, “তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।” অর্থাৎ সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব একজন নারী কেন পতিতাবৃত্তিতে জড়াচ্ছেন, তা অনুধাবন করে তাকে পুনর্বাসনের পথ দেখানো।

এই পেশা থেকে নারীদের সরিয়ে আনতে চাই একটি মানবিক ও কার্যকর রাষ্ট্রীয় কৌশল। যৌনকর্মীদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ, সামাজিক ব্যবসা মডেল, সরকারি চাকরিতে কোটা এবং ক্ষুদ্র ঋণের সুযোগ বাড়াতে হবে। 

যারা স্বেচ্ছায় এই পেশা ছাড়তে চান, তাদের জন্য মানসিক পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তোলা দরকার। যৌনপল্লিতে জন্ম নেওয়া শিশুদের জন্য আবাসিক শিক্ষাব্যবস্থা, মনোসামাজিক সহায়তা এবং নিরাপদ বেড়ে ওঠার পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। সমাজের মানসিকতা বদলাতে হবে মিডিয়া, স্কুল কারিকুলাম, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় নেতৃত্বকে সম্পৃক্ত করে।

সবচেয়ে বড় কথা, পতিতাবৃত্তিকে ‘শ্রম’ হিসেবে বৈধতা দেওয়ার আগেই দেখতে হবে এই স্বীকৃতি বাস্তবে কোনো উন্নয়ন আনছে কি না। যদি সমাজ ও সংস্কৃতি সেই স্বীকৃতিকে মান্যতা না দেয়, তবে তা কেবল কাগুজে সমাধান হয়ে থাকবে। 

রাষ্ট্রীয় বৈধতার চেয়েও জরুরি যারা এই পেশায় নিপতিত হয়েছেন, তাদের জন্য বিকল্প পরিচয়ের সুযোগ তৈরি করা। যেন একদিন তারা সমাজে মর্যাদার সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেন ‘পল্লির নারী’ পরিচয়ের বাইরে গিয়ে।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞান বিভাগ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
Email: [email protected]