বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২

কোটা আন্দোলন পরবর্তী সমন্বয়কদের বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ পথচলা

ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম
  ২০ এপ্রিল ২০২৫, ১৪:৪৬
কোটা আন্দোলন পরবর্তী সমন্বয়কদের বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ পথচলা
ফাইল ছবি

২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি তাৎপর্যপূর্ণ মোড় তৈরি করেছিল। লাখো শিক্ষার্থী ও তরুণ-তরুণীর অংশগ্রহণে গড়ে ওঠা এই আন্দোলন সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং প্রশাসনিক পর্যায়ে আলোচনার ভিত্তি স্থাপন করে। আন্দোলনের অন্যতম চালিকাশক্তি ছিলেন ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ে পরিচিত একদল তরুণ, যারা মাঠপর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সমাবেশ পরিচালনা করেছেন এবং দাবি আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

তবে আন্দোলনের সেই প্রাথমিক সাফল্যের পরবর্তী সময়টি ছিল কিছুটা জটিল। একদিকে আন্দোলনের ঢেউ থিতিয়ে এসেছে, অন্যদিকে সমন্বয়কদের আচরণ, সাংগঠনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে অভিযোগ উঠেছে যে, কিছু সমন্বয়ক ত্রাণের অর্থ ব্যবহারে স্বচ্ছতা রক্ষা করেননি, কিছু ক্ষেত্রে ক্যাম্পাস দখল বা আইনবহির্ভূত কর্মসূচিতে জড়িত হয়েছেন, আবার কেউ কেউ নিরাপত্তার জন্য প্রশাসনিক শক্তিকে ব্যবহার করেছেন—যা শিক্ষার্থীদের মধ্যেই বিভ্রান্তি তৈরি করেছে।

এমন পরিস্থিতিতে খুলনার মোল্লা আজম খান কমার্স কলেজের একজন ছাত্র, যিনি জুলাই আন্দোলনের সময় সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন, অভিযোগ করেছেন যে, ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ের কারণে তিনি যৌথ বাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, পুলিশ সদস্যরা তাঁর ওপর নির্যাতনের সময় বলেন, “৫ আগস্টের পর দেশটাকে জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছিস। এখন আমরা মারব, আওয়ামী লীগ মারবে, বিএনপিও মারবে।”

এই অভিযোগ যদি সত্য হয়, তবে তা উদ্বেগজনক এবং একটি গণতান্ত্রিক সমাজে ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের প্রতি রাষ্ট্রযন্ত্রের আচরণ কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে।

এতদসত্ত্বেও, আন্দোলনের এই তরুণ নেতৃত্বের সামনে এখন একাধিক বিকল্প পথ খোলা। কেউ কেউ ইতোমধ্যেই ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সংগঠনে যুক্ত হওয়ার কথা ভাবছেন, কেউ শিক্ষা ও ব্যক্তিগত উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিতে চাইছেন। তাদের কেউ কেউ জনপ্রিয়তা ও জনসমর্থনের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক দল গঠন বা প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতিতে প্রবেশ করতে পারেন, যেটি একটি স্বাভাবিক রূপান্তর হিসেবেই দেখা যেতে পারে। তবে এটি গুরুত্বপূর্ণ যে, এমন রূপান্তর যেন গণতন্ত্রের মৌলিক নীতিমালা—স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, জনসম্পৃক্ততা—অমান্য করে না।

ইতিহাস বলে, দীর্ঘ আন্দোলনের পর নেতৃত্বে থাকা তরুণরা যদি সময়মতো নিজেদের অবস্থান ও দায়িত্ব মূল্যায়ন না করেন, তবে তারা কখনও কখনও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চ কিংবা অতীতের বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনের পর দেখা গেছে, জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকলেও অনেক নেতা সময়ের সাথে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছেন, কিছু ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন।

এজন্যই সময়মতো মূল্যায়ন, আত্মসমালোচনা এবং পরবর্তী পথচলার জন্য প্রস্তুত হওয়া অত্যন্ত জরুরি। নেতৃত্ব মানেই শুধু মিছিলের সামনে দাঁড়ানো নয়; এটি দায়িত্ব, আত্মসংযম এবং বৃহত্তর জনগণের প্রতি জবাবদিহিতার প্রশ্ন।

তরুণ সমন্বয়কদের প্রতি আমাদের প্রত্যাশা থাকবে—তারা অতীতের রাজনৈতিক ইতিহাস, সাফল্য ও ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের বিকাশের পথ খুঁজে নেবেন। তারা যদি শিক্ষাক্ষেত্রে ফিরে গিয়ে নিজেদের জ্ঞান ও মেধাকে সমৃদ্ধ করেন, তবে ভবিষ্যতে রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে বারবার প্রমাণিত হয়েছে—ছাত্রসমাজ পরিবর্তনের অন্যতম চালিকাশক্তি। সেই শক্তির সঠিক ব্যবহারে যেমন সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়, তেমনি তা যদি সঠিকভাবে পরিচালিত না হয়, তবে ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। কাজেই এখনই সময়, যখন নেতৃত্বের কাঠামোতে থাকা তরুণরা ভেবে দেখবেন—তারা ইতিহাসের পাতায় কীভাবে স্মরণীয় হতে চান।

লেখক: চেয়ারম্যান, ডেমোক্রেসি রিসার্চ সেন্টার (ডিআরসি)

যাযাদি/এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে