ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন আমলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে?
প্রকাশ | ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৪৯
ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন।
গত ৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ৬০ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে পরাজিত করেন রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি আামেরিকার ৪৭ তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে ২০২৫ সালে জানুয়ারি মাসে শপথ গ্রহণ করবেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনঃনির্বাচনের মাধ্যমে তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে নতুন চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বিশেষ করে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতির অধীনে ট্রাম্প প্রশাসন তাঁদের নিজস্ব স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে বৈশ্বিক সম্পর্ক পরিচালনা করতে পারে। যদিও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পরিবর্তন হলেও তাঁদের পররাষ্ট্রনীতিতে খুব বেশি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতি পিপাসু ব্যক্তিদের মনে একটা জিজ্ঞাসা ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটা হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে বাংলাদেশ ভবিষ্যৎ কেমন হবে? ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনার সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ও বাণিজ্য যুক্তরাষ্ট্রের অনেকাংশে ওপর নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি বাজার, যেখানে প্রতি বছর প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। এর মধ্যে প্রধানত হলো তৈরি পোশাক। ট্রাম্প প্রশাসনের চীন বিরোধী বাণিজ্যনীতি যেমন, চীনা পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ বাংলাদেশের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে। মার্কিন বাজারে চীনা পণ্যের বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা বাড়তে পারে। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি সবসময় প্রতিকূল হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ট্রাম্পের আমলে মার্কিন বাণিজ্য চুক্তিগুলোতে কঠোর শর্ত আরোপের প্রবণতা দেখা গেছে। বাংলাদেশ যদি এই কঠোর শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হয় তবে বাণিজ্য সুবিধা হ্রাস পেতে পারে। তাই বাংলাদেশকে আরও প্রতিযোগিতামূলক পণ্য সরবরাহ এবং মার্কিন বাজারের চাহিদা মেটাতে প্রস্তুত থাকতে হবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন নীতিতে সবসময় কড়াকড়ি লক্ষ্য করা যায়। ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্প ঘোষণা করেছিলেন, তিনি জয়ী হলে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৫ লাখ বাংলাদেশি বসবাস করছেন, যাদের মধ্যে কয়েক হাজার অবৈধ অভিবাসী। এদের অনেকেই রেমিট্যান্সের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। ট্রাম্প প্রশাসন যদি অবৈধ অভিবাসীদের ব্যাপকভাবে বিতাড়িত করে, তাহলে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ২০১৭ সালে ট্রাম্প ১১ জন বাংলাদেশি অভিবাসীকে বিতাড়িত করেছিলেন, যা ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে ঘটতে পারে।
ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে বাংলাদেশ সরাসরি পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দু হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র তার মূল মনোযোগ চীন, রাশিয়া, এবং ন্যাটো জোটের মতো বৃহৎ আন্তর্জাতিক ইস্যুগুলোর দিকে নিবদ্ধ করবে। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখার কৌশল ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদেও অব্যাহত থাকবে। ট্রাম্প যদি ভারতের চোখে দক্ষিণ এশিয়াকে দেখে, তাহলে ভারতীয় স্বার্থকে সমর্থন করতে গিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব পড়তে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার এবং মানবাধিকার ইস্যুতে ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশ সরকারকে চাপে ফেলতে পারে। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে ৩১ অক্টোবর ট্রাম্প তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ বাংলাদেশের হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন। এসব বিষয় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলতে পারে এবং তা আন্তর্জাতিক অঙ্গণে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগিতার একটি বড় উৎস। বাংলাদেশে ইউএসএইডের মাধ্যমে বিভিন্ন খাতে সহায়তা প্রদান করা হয়। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি অনুসারে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে অধিক মনোযোগ দেওয়া হলে এই সহায়তা হ্রাস পেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এছাড়াও বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা, এবং শিক্ষা খাতে মার্কিন সহায়তা একটি বড় অবদান রাখে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য প্রদান করে। যদি ট্রাম্প প্রশাসন এই খাতে সহায়তা কমিয়ে দেয় তবে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। এছাড়া, বাংলাদেশের বিনিয়োগ নীতি যদি আরও উদার না করা হয় তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) হ্রাস পেতে পারে। তাই বাংলাদেশকে একটি যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের পরিবেশ বিষয়ক নীতি বাংলাদেশের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ। প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে এসেছিলেন এবং পরিবেশগত ইস্যুগুলোতে সহায়তা হ্রাস করেছিলেন। বাংলাদেশ, যেটি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম, আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিলের ওপর নির্ভরশীল। ট্রাম্প প্রশাসন যদি পুনরায় পরিবেশগত চুক্তিগুলো থেকে দূরে থাকে এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সহায়তা হ্রাস করে তবে বাংলাদেশের অভিযোজন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করতে বাংলাদেশকে তখন আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বাইরে নিজের সম্পদ ব্যবহার করতে হতে পারে যেটার প্রভাব ভয়ংকর হতে পারে।
বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অন্যতম প্রধান সামরিক সেনাবাহিনী প্রেরণকারী দেশ। এই মিশনে মার্কিন অর্থায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি ট্রাম্প প্রশাসন জাতিসংঘে আর্থিক সাহায্য হ্রাস করে তবে এটি বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে প্রভাব ফেলতে পারে। শান্তিরক্ষী মিশন থেকে প্রাপ্ত অর্থ দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশের উচিত কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখা এবং নতুন সুযোগগুলো কাজে লাগানো। সেক্ষেত্রে মার্কিন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশের বিনিয়োগ নীতিমালা সহজ করতে হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাংলাদেশি বাজার উন্মুক্ত করতে হবে। তাছাড়া, চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সম্পর্ক আরও জোরদার করতে হবে। তবে চীন-মার্কিন বিরোধে সরাসরি কোনো একপক্ষীয় অবস্থান নেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। একইসাথে ট্রাম্প প্রশাসনের ভারতমুখী নীতির কারণে বাংলাদেশের জন্য ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নত রাখা জরুরি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশের জন্য বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ এবং একইসাথে সুযোগ তৈরি হতে পারে। অভিবাসন নীতি, বাণিজ্য, জলবায়ু পরিবর্তন, এবং আন্তর্জাতিক সাহায্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির সরাসরি প্রভাব পড়তে পারে। তবে বাংলাদেশ যদি সঠিক কৌশল গ্রহণ করে এবং বহুমুখী সম্পর্ক বজায় রাখে, তাহলে এ পরিস্থিতিকে দেশের উন্নয়নের জন্য কাজে লাগানো সম্ভব হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার পাশাপাশি চীন, ভারত, এবং অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখাই হবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি।
যাযাদি/এস
লেখক : শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।