বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকট সমাধানে বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি জরুরি
প্রকাশ | ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৪:১৩
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক ধারণা হিসেবে উঠে এসেছে। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত এদেশে গণতন্ত্রের আড়ালে স্বৈরতন্ত্রের চাষাবাদ হয়েছে দেদারসে।
দীর্ঘ দেড় দশকের সামরিক শাসন বাদ দিলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোতে কখনোই গণতন্ত্রের সুবাতাস লাগেনি। প্রায় প্রতিটি দল গণতান্ত্রিক কাঠামো বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরকার গঠন করলেও সময়ের সাথে সাথে হয়ে উঠেছে স্বৈরাচারী। এককেন্দ্রিক ক্ষমতা চর্চায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে নির্বাচিত সরকার প্রধানেরা। চেষ্টা করেছে প্রতিপক্ষের উপর দমন-পীড়ন এবং গণমাধ্যম ও বিচার ব্যবস্থার উপর নগ্ন প্রভাব বিস্তারের। সর্বশেষ, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এই সংকট আরও প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল।
আওয়ামী লীগ সরকারের জোরপূর্বক ও অন্যায়ভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার প্রচেষ্টা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের কফিনে প্রায় শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছিল। দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটবর্জন করতে বাধ্য হয়েছে প্রধান বিরোধী দলগুলো। অর্থাৎ, বাংলাদেশে গণতন্ত্র কেবলমাত্র একটি নামমাত্র ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে, যেখানে জনগণের প্রকৃত মতপ্রকাশ এবং অংশগ্রহণ খুবই সীমিত। গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্রের চর্চা বন্ধ করে গণমুখী ও জবাবদিহিতামূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা এখন সময়ের দাবি।
বৈশ্বিক গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত শোচনীয়। লন্ডনভিত্তিক দি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ২০২৩ সালের গণতন্ত্র সূচকে বিশ্বের ১৬৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫তম। সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ৫ দশমিক ৮৭। নাগরিক স্বাধীনতায় দেশটির স্কোর মাত্র ৪ দশমিক ৭১। সূচকে প্রতিটি দেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে পূর্ণ গণতন্ত্র, ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র, হাইব্রিড শাসনব্যবস্থা ও কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা হিসেবে ভাগ করা হয়। স্কোর অনুযায়ী বাংলাদেশে ‘হাইব্রিড শাসনব্যবস্থা’ বিদ্যমান।
আর হাইব্রিড শাসনব্যবস্থা বলতে এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে নির্দেশ করে যেখানে প্রায়ই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়, বিরোধী দলের ওপর সরকারের দমন-পীড়ন দেখা যায়, বিচারব্যবস্থা পরাধীন অর্থাৎ নিয়ন্ত্রিত এবং সংবাদমাধ্যমের উপর হস্তক্ষেপ করা হয়। এছাড়াও এতে দেশে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার, আইনের দুর্বল শাসন, নাগরিক সমাজকে দুর্বল করে রাখার অভিপ্রায় লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অবস্থা শুধু যে বর্তমানেই শোচনীয় তা নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই সংকট বিদ্যমান। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নতুন করে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইলেও বাংলাদেশের অবস্থা একই রয়ে গেছে।
সর্বশেষ, ২০০৬ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ধরণ ছিল ‘ত্রুটিপূর্ণ’। এরপর ২০০৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের গণতন্ত্র টানা হাইব্রিড শাসনব্যবস্থা হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে।
দীর্ঘ দেড় দশকের সামরিক শাসন এদেশের আপামর জণগনকে গণতন্ত্রের কথা প্রায় ভুলিয়ে রেখেছিল। শুধু দেড় দশক বলাটাও ভুল হবে। কারণ, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশাল কায়েমের প্রচেষ্টাকেও এদেশের বিজ্ঞসমাজ গণতন্ত্রের আড়ালে স্বৈরতন্ত্র বলেই মনে করেন। তবে, জনগণের মনে গণতন্ত্রের আশা জেগেছিল ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পরে। ব্যাপক গণআন্দোলনের মুখে রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্র নিশ্চিতকরণে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবুও সংসদ কার্যকর, সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত এবং আইনের প্রকৃত শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র সংকটের মুখোমুখি। ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে স্বৈরাচারী সরকারকে অকুণ্ঠ সমর্থন ও পরোক্ষভাবে শোষণনীতি গ্রহণের কারণে এই সংকট আরও দৃঢ় হচ্ছে। সহজভাবে বলতে গেলে, দলীয় সকল কাজকেই নেতাকর্মী ও সমর্থকদের কাছে সঠিক বলে বিবেচিত হয়, যদিও তা অযৌক্তিক। এই নীতি থেকে বের হয়ে ভালো কাজে বাহবা ও মন্দ কাজের সমালোচনার সংস্কৃতি গড়ে না উঠলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র আরও সংকটের মুখোমুখি হবে তা সহজেই অনুমেয়।
বলা বাহুল্য, একটি টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখন বাংলাদেশের আপামর জনগণের দৃঢ় চাওয়া। তবে এটি এমনি এমনি জনগণের ভাগ্যাকাশে উদিত হবে না। এর জন্য প্রয়োজন নতুন, উদ্ভাবনী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি, যা গণতান্ত্রিক চেতনা, মূল্যবোধ এবং সুশাসন নিশ্চিত করবে। সুশাসনের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে। এর জন্য ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা আবশ্যক। আর এই লক্ষ্যে বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থায় আইন, কাঠামো ও কার্যগত ইতিবাচক সংস্কারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। তবে যেসব ক্ষেত্রে সংস্কারে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনার সুযোগ রয়েছে।
বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা অধিকাংশ সময় বিতর্কিত হয়েছে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরিতে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা জরুরি। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। আওয়ামীলীগ ও বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ১৯৮৮ সালের চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও বর্জন করে। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর অনুষ্ঠিত গণতান্ত্রিক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করে।
বিভিন্ন দলের আপত্তি সত্ত্বেও দলীয় সরকারের অধীনেই ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ ছোটবড় বেশ কয়েকটি দল এ নির্বাচন বর্জন করে। ফলে মাত্র ১১ দিনের মাথায় এ সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং নতুন নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ জয়লাভ করে। এরপর ২০১৪ সালের দশম, ২০১৮ সালের একাদশ এবং ২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন কার্যত নির্বাচন বলেই পরিগণিত হয়নি। এই নির্বাচন তিনটিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকারের অধীনে একটি একপাক্ষিক ও পাতানো নির্বাচন বলে দেশবিদেশের বহু সংস্থা উল্লেখ করেছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে অবশ্যই সাংবিধানিক রক্ষাকবচ প্রয়োজন। তাই কোন দলীয় সরকারের অধীনে নয় বরং সংবিধানের আলোকে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশনের অধীনে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে।
স্পষ্টতই বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী পদটি অসীম ক্ষমতার অধিকারী। দেশের সকল প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক ব্যক্তি কার্যত প্রধানমন্ত্রীর হাতের পুতুলতুল্য। ইচ্ছা করলেই তিনি যা কিছু করতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর হাতে কেন্দ্রীভূত এই ক্ষমতা কার্যত নির্বাহী, বিচার ও আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ার উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। এতে গণতন্ত্রের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কাঠামো স্বৈরতান্ত্রিক রূপ ধারণ করেছে। তাই সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার পরিধি নির্ধারণ করতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে, নির্বাহী ক্ষমতা যেন সবসময় নির্দিষ্ট পরিসীমায় থাকে এবং অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তাদের নিজস্ব ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। এই লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কাছাকাছি ক্ষমতার একজন রাষ্ট্রপতি থাকবেন, যার নিয়োগ হবে জনগণের দ্বারা এবং যার পেছনে জনগণের সমর্থন থাকবে। রাষ্ট্রপতির কোন কাজেই প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের সুযোগ রাখা যাবে না, যেমনটি বর্তমানে রয়েছে। পাশাপাশি একজন ব্যক্তির সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হতে পারার বিধান করতে হবে। তা যদি এক মেয়াদে সীমাবদ্ধ করা যায় তবে আরও ভালো। এতে প্রধানমন্ত্রীর পদকে নিজ সম্পত্তি বানিয়ে তোলার আগেই অন্য প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণ করবেন যা স্বৈরতন্ত্রের পথকে কিছুটা হলেও রোধ করবে।
বাংলাদেশের মত এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থায় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার প্রবণতা তুলনামূলক বেশি থাকে। তাই যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার আলোকে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ চালু করতে হবে। নিম্নকক্ষের প্রতিনিধিরা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন। উচ্চ কক্ষে নির্বাচিত এবং মনোনীত উভয় সদস্য থাকবেন। এতে সুশীল সমাজ, সাংবাদিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মনোনয়ন হবে। ফলে তাঁরা ক্ষমতাসীন সরকারের ভুলগুলো সংসদের অভ্যন্তরেই শুধরে দিতে সক্ষম হবেন। পাশাপাশি শক্তিশালী গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষমতাসীন সরকার ভুলত্রুটিগুলো গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণে জনসম্মুখে আসে। এতে সরকারের জবাবদিহিতা বাড়বে এবং স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবণতা কমে আসবে।
সবচেয়ে বড় যেই জিনিসটি প্রয়োজন তা হলো সংবিধান সংস্কার। বাংলাদেশের সংবিধানই প্রধানমন্ত্রীকে স্বৈরচারী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। সংবিধানে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পৃথকভাবে উল্লেখ থাকলেও কার্যত প্রধানমন্ত্রীর হাতে সকল নির্বাহী ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত। সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, মন্ত্রিসভা সরকার পরিচালনার দায়িত্বে থাকে, যার নেতৃত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী। এটি কার্যত প্রধানমন্ত্রীকে সকল নির্বাহী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেয়। যদিও ৫৫(৩) ধারায় মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সংসদ সরকার দলের নিয়ন্ত্রণে থাকে বলে কার্যত দায়ী থাকার প্রশ্নই আসে না। সংসদ মন্ত্রিসভাকে নিয়ন্ত্রণ করার পরিবর্তে উল্টো মন্ত্রিসভা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আবার ৫৫(৪) অনুচ্ছেদে সরকারের সকল নির্বাহী ব্যবস্থা রাষ্ট্রপতির নামে গৃহীত হবার বিধান থাকলেও তা নামমাত্র। প্রকৃত ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর।
এছাড়াও সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সাংসদরা দলীয় হুইপ মেনে চলতে বাধ্য থাকেন। এতে সদস্যরা দলের বিরুদ্ধে কোন বিলে ভোট বা মতামত দিতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রীর দলীয় সাংসদরা সিদ্ধান্তে সমর্থন দিতে বাধ্য হওয়ায় তাঁর ক্ষমতা আরও পাকাপোক্ত হয়েছে। আবার ২২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হতে বিচারবিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে। তবে বিচার বিভাগ স্বাধীন হলেও সংবিধানের ৯৫ ও ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারক নিয়োগ এবং অপসারণে সরকারের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। ফলে দলীয় ব্যক্তিদেরকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। এতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ আরও বেড়ে যায়। আবার রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কমিশনগুলোর প্রধানকে নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি, যা পরোক্ষভাবে প্রধানমন্ত্রীর পছন্দ অনুযায়ীই হয়ে থাকে। এছাড়া, সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা উল্লেখ আছে, যেখানে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে সংশোধনী আনা যায়। সরকার দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে সংবিধানে পরিবর্তন আনা তাদের জন্য সহজ হয়ে যায়। আরও বড় ব্যাপার হলো যে, সংসদ নিয়ন্ত্রণে থাকায় প্রধানমন্ত্রী যেরূপ ইচ্ছা প্রায় সেরূপ আইন প্রণয়ন করতে পারে। আবার বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণে থাকায় সেই আইনের জুডিশিয়াল রিভিউও পক্ষেই থেকে যায়। তাই সংস্কারের মাধ্যমে গোড়া থেকে সংকট মূলোৎপাটন ছাড়া গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশের কোন সম্ভাবনাই নেই বললেই চলে।
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এমাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রসার নিয়ে বেশ আশাবাদী। তাঁর মতে, “বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। স্বৈরাচারের আঘাতে মুচড়ে গেছে, কিন্তু তা নিঃশেষ হয়নি। দেহ তার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, কিন্তু অন্তরাত্মা রয়েছে অক্ষত।” তবে আমাদের মতো তরুণদের নিকট বাংলাদেশের গণতন্ত্র এক হতাশার নাম। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা গণতন্ত্রের যেসব সুফল সম্পর্কে পড়েছি, জন-আকাক্সক্ষা প্রতিফলনের যে স্বপ্ন দেখেছি, জন্ম অবধি তা চোখে পড়েনি। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সুবাতাস এখনও পৌঁছাতে পারেনি। অদূর ভবিষ্যতে যে পৌঁছাবে সেই আশাও ক্ষীণ। ওই যে, ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। আমাদেরও হয়েছে সেই একই দশা। গণতন্ত্রের জন্য লড়াই-সংগ্রাম কম হয়নি। গণতন্ত্রের মুক্তির জন্য শহীদ নূর হোসেনের মত কম প্রাণ উৎসর্গ হয়নি। তবুও তা যেন অধরাই রয়ে গেল। এই সংকটের শেষ কোথায় তা ঠাওর করাও দুরূহ। তবুও আমরা কিঞ্চিত আশা রাখি। জনগণের ব্যাপক সচেতনতা ও শক্তিশালী রাজনৈতিক অঙ্গীকারের মাধ্যমে বাংলাদেশে একদিন প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে সেই স্বপ্ন আমরা দেখি। তাই দেশ ও দশের উন্নয়নে পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ইতিবাচক ও জনকল্যাণমুখী সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রকৃত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে উঠবে সেই প্রত্যাশাই থাকবে।
লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]
যাযাদি/ এস