শস্যবীজের দাম ক্রমাগত বাড়ছে, কৃষি কাজে উৎসাহ হারাচ্ছে কৃষক
প্রকাশ | ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১৪:৫১
বাংলাদেশে কৃষি পেশার প্রতি দিন দিন কমছে কৃষকদের আগ্রহ। এর পেছনের অন্যতম কারণ কৃষি পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া। বিশেষ করে মৌসুমী ফসলের বীজ বপন কালে বীজের উচ্চমূল্য কৃষকদের জন্য হয়ে উঠেছে প্রধান বাধা।
এ সময় সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএডিসি এবং বাজারের আরতদাররা বীজের দাম কমানোর পরিবর্তে তা বাড়িয়ে দেওয়ায় কৃষকদের চাষাবাদের আগ্রহে ভাটা পড়ছে।
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। বাংলাদেশের জনগনের একটা বিশাল অংশ তাদের জীবনধারণের জন্য কৃষির উপর নির্ভর করে। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র দূরীকরণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষি খাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সর্বশেষ আদমশুমারী তথ্যমতে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১১.৩৮ শতাংশ এবং কৃষিতে নিয়োজিত জনশক্তি ৪৫.৪ শতাংশ। যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক।
বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য আলু অন্যতম একটি ফসল। আলু চাষে দেশের কৃষকদের আগ্রহও দীর্ঘদিনের। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আলুর বীজের উচ্চমূল্য তাদের জন্য তৈরি করেছে নানা সমস্যা। সাধারণত অক্টোবর-নভেম্বর মাস আলুর বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। অথচ এই মৌসুমের আগমনে প্রত্যাশিতভাবে আলুর বীজের মূল্য কমানোর পরিবর্তে, তা আকাশচুম্বী পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একসময় সরকারী ও বেসরকারি কোল্ড স্টোরেজে বীজ সংরক্ষণ করা হলেও, বর্তমানে এসব বীজের মূল্য বৃদ্ধির জন্য কোনো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কার্যকর নেই বললেই চলে।
বাজার বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) এবং বিভিন্ন আরতদারেরা বর্তমানে যে দামে আলুর বীজ বিক্রি করছে, তা কৃষকদের চাহিদার তুলনায় অস্বাভাবিকভাবে বেশি। এই উচ্চমূল্যের কারণে চাষিরা আলুর মতো গুরুত্বপূর্ণ ফসল উৎপাদনে আগ্রহ হারাচ্ছে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে হুমকিস্বরূপ।
কৃষকদের ভাষ্যমতে, শুধু আলুর বীজই নয়; ধান, গম, পেঁয়াজ, রসুন, সরিষা সহ বিভিন্ন মৌসুমী শস্যবীজের দামও মৌসুমের সময় বেড়ে যাচ্ছে। বীজ বপনের মৌসুমে এমন অবস্থা হওয়ায় কৃষকরা চাষাবাদ থেকে নিরুৎসাহিত হচ্ছে, যা কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
এভাবে যদি প্রতিটি শস্যবীজের দাম বাড়তে থাকে, তাহলে কৃষিকাজ থেকে আমাদের নিজেদের সরিয়ে নিতে হবে। এই অবস্থায় অনেকেই চাষাবাদ ছেড়ে বিকল্প কর্মসংস্থানের খোঁজ করছেন। শস্যবীজের দামে লাগাম টানতে হবে এবং শস্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার চাইলে সঠিকভাবে কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষিত বীজ কম খরচে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করতে পারে।
কৃষিতে উৎসাহ প্রদান করা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। বিএডিসি’র মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে শস্যবীজের দাম কমানোর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের বীজ মজুদ ও বিতরণের ব্যবস্থায় কোনোরকম পরিবর্তন আনছে না। এই পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। যদি এই অবস্থা চলতে থাকে এবং কৃষকরা বীজ কিনতে না পারে, তাহলে আমাদের খাদ্য উৎপাদনে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে, যা পরবর্তীতে দেশের খাদ্য সরবরাহ চেইনে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। এই সমস্যার দ্রুত সমাধান না করলে দেশে অচিরেই খাদ্য সংকটের সম্ভাবনা তৈরি হবে, যা কেবল খাদ্যের সংকটেই থেমে থাকবে না, বরং দেশের অর্থনীতিতেও এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বীজের মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। সরকারি কোল্ড স্টোরেজ এবং অন্যান্য সংরক্ষণাগারগুলোর সক্ষমতা বাড়িয়ে সঠিক সময় বীজ সরবরাহ নিশ্চিত করা, কৃষকদের চাষে উৎসাহিত করতে বীজের দামে ভর্তুকি প্রদান করা, যাতে কৃষকরা সহজেই তা ক্রয় করতে পারে এবং বীজের মূল্য নির্ধারণে মনিটরিং কমিটি গঠন। এছাড়া যারা উচ্চ মূল্যের বীজ কিনতে অক্ষম, তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা।
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষার্থে কৃষকদের সহায়তা করা প্রয়োজন। শস্যবীজের উর্ধ্বগতির জন্য কৃষকদের কৃষিকাজে নিরুৎসাহিত করা দেশের জন্য মোটেই শুভ লক্ষণ নয়। সরকারকে এই সংকটের দিকে নজর দিয়ে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। অন্যথায়, অদূর ভবিষ্যতে খাদ্য সংকটের সম্ভাবনা বাস্তব রূপ ধারণ করতে পারে, যা দেশের জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
লেখক : শিক্ষার্থী, কৃষি অনুষদ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (পবিপ্রবি)
যাযাদি/ এস