আগামীর চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশ | ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:৫৭

মোঃ হেদায়েত উল্লাহ তুর্কী
ফাইল ছবি

শত সীমাবদ্ধতা এবং ছোট ক্যাম্পাস নিয়ে দুর্বার গতিতে আপন লক্ষ্যে এগিয়ে চলছে পুরান ঢাকা তথা বাংলাদেশের প্রাচীনতম ঐতিহাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজকের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির বয়স আঠারো পেরিয়ে উন্নিশে পড়লেও প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত বয়স একশত পঞ্চাশ বছরের বেশী। 

সম্ভবত এটিই বিশে^র একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেটি পাঠশালা থেকে পর্যায়ক্রমে স্কুল কলেজের গন্ডি পেরিয়ে বিশ^বিদ্যালয়ে রুপান্তরিত হয়েছে। 

জানা যায় ১৮৬৮ সালে জগন্নাথ রায় চৌধুরী জগন্নাথ স্কুলের প্রতিষ্ঠা করেন। বালিয়াটি (মানিকগঞ্জ) এর জমিদার জগন্নাথ রায় চৌধুরীর মধ্যম পুত্র (জগন্নাথ রায় চৌধুরীর তিন সন্তান ছিলেন) কিশোরীলাল রায় চৌধুরী ১৮৮৪ সালে এটিকে কলেজে রুপান্তরিত করে নামকরণ করেন জগন্নাথ কলেজ। তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য এবং সহযোগীতা করেছিলেন অনাথবন্ধু মল্লিক, আইনজীবী ত্রৈলোক্যনাথ বসু ও বিচারপতি সারদাচরণ মৈত্র। জগন্নাথ কলেজ মাত্র ৪৮ যখন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে।

জগন্নাথ কলেজের  সুনাম ছড়িয়ে পড়লে সন্তোষের জমিদার রাজা মন্মথ রায় চৌধুরী কলেজ কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের অনুমতিক্রমে তাঁদের টাঙ্গাইলস্থ প্রমথ-মন্মথ কলেজটিকে জগন্নাথ কলেজের সঙ্গে যুক্ত করেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের জন্মলগ্নে তার সুতিকাগৃহে যে দুটো কলেজ তাদের পুষ্টি, সহচার্য ও সেবা দিয়ে পালন করেছিল তার  একটি হল জগন্নাথ কলেজ এবং অপরটি ঢাকা কলেজ। জগন্নাথ কলেজ তার ছাত্র, শিক্ষক, বই-পুস্তক ইত্যাদি দিয়ে সেদিন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়কে তার হাঁটি হাঁটি পা পা অবস্থা থেকে উত্তরণে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলো। 

জগন্নাথ কলেজ এবং ঢাকা কলেজের ডিগ্রী ক্লাসের সমস্ত ছাত্র নিয়ে ১৯২১ সালের ১লা জুলাই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। জগন্নাথ কলেজ পূর্ববাংলায় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সহযোগীতা করতে গিয়ে নিজে ডিগ্রী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েড কলেজে পরিনত হয়। কালের পরিক্রমায় এটি সরকারী জগন্নাথ কলেজ, সরকারী জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় কলেজ এবং ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ঘোষণা এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০০৫ মহান জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার মাধ্যমে পরিপূর্ণ বিশ^বিদ্যালয় হিসেবে পথচলা শুরু করে। পথচলার শুরুর দিকটা এতটা মসৃণ ছিলো না। জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় আইন ২০০৫ এর ২৭ (৪) ধারা মোতাবেক এটি পরিচালিত হওয়ার কথা ছিলো। 

এই ধারায় উল্লেখ ছিলো বিশ^বিদ্যালয়টি তার নিজস্ব আয় থেকে ব্যয় করবেন। যার ফলে প্রথমদিকে অনেক ভালো ভালো শিক্ষক চাকুরির অনিশ্চয়তার কারনে বিশ^বিদ্যালয়ে যোগদান করেননি এবং তৎকালিন কলেজের প্রায় সকল শিক্ষকই বিশ^বিদ্যালয় ছেড়ে অন্য সরকারী কলেজে যোগদান করেন। তখন কলেজ আমলের কয়েকজন শিক্ষক বিশ^বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এইমুহুর্তে যাদের কথা মনে পড়ছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ও জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের একমাত্র হল বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের প্রথম প্রভোষ্ট অধ্যাপক ড. এস এম আনোয়ারা বেগম এবং অন্যজন হলেন পিরোজপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. কাজী সাইফুদ্দীন, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সেলিম, লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. আছমা বিনতে ইকবাল। ২০১২ সালে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে ২৭(৪) ধারা বাতিল হলে এটি একটি পরিপূর্ণ স্বায়ত্বশাসিত বিশ^বিদ্যালয় হিসেবে পথ চলা শুরু করে। ২০০৫ সালে জাতীয় সংসদে গৃহীত জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় আইন বলে পূর্বতন জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীরা জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে গণ্য হয়। 

তাদের নিয়ে অল্প কয়েকটি বিভাগের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম চালু হয়। পরবর্তীতে যুগোপযোগী অনেক বিভাগ খোলা হয়। সঙ্গীত, চারুকলা, নাট্যকলা বিভাগ খোলার মাধ্যমে জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়কে পুরান ঢাকার সাংস্কৃতি কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে রুপান্তির করা হয়। পহেলা বৈশাখে পুরান ঢাকার প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে এ কর্মকান্ড পরিচালিত হয়ে আসছে। স্বল্প সময়ে বিশ^বিদ্যালয়টি আন্তর্জাতিক সঙ্গীত উৎসব আয়োজন করে বিশে^র সংগীত প্রেমীদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছেন। 

বর্তমানে বিশ^বিদ্যালয়ে সাতটি অনুষদে ৩৯টি বিভাগ ও দুটি ইনস্টিটিউটে ১৫ হাজার ৯৬০ জন শিক্ষার্থী, ৬৭৮ জন শিক্ষক ও প্রায় ৭০০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি মেধাবিকাশের জন্য রয়েছে সাংস্কৃতি কেন্দ্র, আবৃত্তি সংসদ, চলচিত্র সংসদ, ডিবেটিং সোসাইটি, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, আইটি সোসাইটি, রঙ্গভূমি, সায়েন্স ফিকশন সোসাইটি, ফিল্ম ক্লাব, ক্যারিয়ার ক্লাব, মাইম সোসাইটি। সেবামুলক সংগঠন হিসেবে রয়েছে বাঁধন, রোভার স্কাউটস, রেঞ্জার ইউনিট, বিএনসিসি। 

সবার আগে বিশ^বিদ্যালয়ের খবর সবার কাছে পৌছে দেওয়ার জন্য রয়েছে সাংবাদিক সমিতি, রিপোর্টার্স ইউনিটি, প্রেসক্লাব সহ নানান মাধ্যম বিশে^র একমাত্র অনাবাসিক পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরুর পনের বছর পর ২০২০ সালে উদ্বোধন করা হয় এখনো পর্যন্ত একমাত্র ছাত্রী হল বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল। 

খাতা কলমের হিসেবে মাত্র ১১ দশমিক ১১ একর জায়গা নিয়ে পথচলা জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় ধুপখোলা খেলারমাঠে ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় যাতে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং বিশ^বিদ্যালয়ের আচার্য এডভোকেট মোঃ আব্দুল হামিদ। বর্তমান ক্যাম্পাসে জায়গার সংকুলন না হওয়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষনা মোতাবেক ঢাকার কেরানীগঞ্জে ২০০ একর জমির উপর নতুন ক্যাম্পাস স্থ্াপন নির্মাণের কাজ চলমান। ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করে বর্তমানে উন্নয়ন প্রকল্প চলছে। 

ইতোমধ্যে দৃষ্টিনন্দন লেক খনন, বাউন্ডারি ওয়াল নির্মান, পুকুর ঘাট নির্মাণ, প্রকৌশলী বিল্ডিং নির্মাণ, জমিতে বালু ভরাটসহ অনেক কাজ সম্পন্ন হয়েছে বা চলমান রয়েছে। জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীরা বর্তমান সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বিভিন্নক্ষেত্রে তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখছেন। বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা থেকে শুরু করে যে কোন ধরনের চাকুরির পরীক্ষায় প্রথম সারিতে অবস্থান করছেন এ বিশ^বিদ্যালয়ের কৃতিশিক্ষার্থীরা। 

নানান সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কৃতি শিক্ষার্থীরা তাদের অর্জিত জ্ঞানের সঠিক প্রয়োগের মধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী এবং গবেষক হিসেবে সুযোগ করে নিয়েছেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি ক্রীড়াঙ্গনে বরাবরই সরব উপস্থিতি ছিলো জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের। জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের একটি ক্রিকেট দল ঢাকা প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগের খেলায় নিয়মিত কৃতিত্বের সঙ্গে অংশ নিতো। 

সেই সময়কার এই প্রতিষ্ঠানটি একাধিকবার আন্তঃবিশ^বিদ্যালয় ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ান হওয়ার গৌরব অর্জন করে। ক্রিকেটার খুদাবক্স, সুকুমার, খালেক, মুক্তা, বাদশা, ইকবাল সহ অনেকে ঢাকার ক্রিকেট লীগে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। ফুটবলে সব সময় নজরকাড়া সাফল্য দেখিয়েছেন এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। 

১৯৩৭ সালে বিলেতের দুর্ধর্ষ ইষ্টলিংটন কোরিনথিয়েন্স নামে যে ফুটবল দলটি এই উপমহাদেশে একমাত্র খেলায় পরাজয় বরণ করেছিলে সেটা ছিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত ঢাকা দলের বিরুদ্ধে যে দলে রুনু বোস ও পাখি সেনসহ জগন্নাথের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন এবং একমাত্র যে গোলটি হয়েছিল সেটারও কৃতিত্ব ছিল কলেজের কৃতি শিক্ষার্থী পাখি সেনের।

 তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ একাধিকবার ফুটবল, হকি এবং এ্যাথলেটিক্সে একাধারে চ্যাম্পিয়ান হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। কাজী আব্দুল আলীম, আব্দুর রহিম, সাবেক বাংলাদেশ ক্রীড়া পরিষদের সচিব আব্দুর রশিদ, ইলিয়াস উদ্দিন আহম্মেদ, কামরুজ্জামান, গুরুদাস চক্রবর্তী, আবদুল হামিদ, আনোয়ার হোসেন, মারী, গৌর গোপাল সাহা, হবিবুর রহমান, প্রতাপ শংকর হাজরা, জাকারিয়া পিন্টু (স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক), বশীর আহমেদ, গোলাম সারোয়ার টিপু, মোহসিন, কর্নেল মীর নজরুল ইসলাম, জুয়েল (স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ ক্রিকেটার) সহ অনেক খ্যাতিমান ক্রীড়াবিদের বেড়ে উঠা এই জগন্নাথের ক্যাম্পাস থেকে। মহিলা ক্রীড়াবিদ হিসেবে টলি, শামসুন্নাহার, রাজিয়া সুলতানা অণু, রোকেয়া, খুরশিদা বেগম খুশি, মুনিরা সহ অনেকে দেশের পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন। 

ফুটবলে স্যার এফ রহমান শীল্ড, ফিরোজ খান নুন কাপ সহ বিভিন্ন টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ান হয়ে আলোচনায় ছিলো জগন্নাথ কলেজ ফুটবল দল। এছাড়া উন্মুক্ত ক্রীড়া প্রতিযোগীতায় ভার উত্তোলনে প্রথম বাংলাদেশ গেমসে ইউসুফ ও খলিলের স্বর্ণ পদক লাভ, কুস্তিতে মুন্নি ও নজরুল ইসলামের স্বর্ণ পদক লাভ এবং সাঁতারে মোশাররফ হোসেনের স্বর্ণ পদক অর্জন ছিলো মনে রাখার মতোন। এছাড়া ১৯৭৭ সালে এশিয়াডে মুষ্টিযুদ্ধে আবদুল হালিমের ব্রোঞ্জ পদক লাভ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 

জগন্নাথের শিক্ষার্থী বিশ^বিখ্যাত সাঁতারু ব্রজেন দাস  মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে বিশ্ববাসির নজর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ডবল ক্রসিং সহ তিন বার ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে বিশ^কে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় ক্রীড়া পুরস্কার প্রাপ্ত ক্রীড়াবিদ ক্রীড়া ভাষ্যকার আবদুল হামিদ, খোদাবক্স মৃধা ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের কৃতি শিক্ষার্থী। নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী জর্জিস আনোয়ার নাঈস সাফ গেমসে স্বর্ণজয় করেন। 

বর্তমান জাতীয় ক্রিকেট এবং ফুটবল দলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী প্রতিনিধিত্ব করছেন। ক্রীড়াঙ্গনের পাশপাশি সাংস্কৃতি অঙ্গনে জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ^বাসীর কাছে পৌছে গেছেন। প্রখ্যাত অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান, জাহিদ হাসান, মীর সাব্বির, শামীম জামান, সিদ্দিকুর রহমান, অভিনেত্রী রত্না সহ অনেকে তাদের অভিনয় দিয়ে সবার মন কেড়েছেন। কন্ঠশিল্পী বিপ্লব, সেলিম খান, শান্তারা নিজেদের পাশাপাশি বিশ^বিদ্যালয়কেও সবার সামনে তুলে এনেছেন। এই প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষক-কর্মকর্তা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন।

 জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক রেজাউল করিম পিএইচডি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য যিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন চাকুরির শেষ দিন পর্যন্ত। মাত্র আঠার বছর বয়সের একটা বিশ^বিদ্যালয় থেকে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়ে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ প্রাপ্ত হয়েছেন যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশাসনিক দক্ষতার প্রমান। উপাচার্য হিসেবে প্রথিতযশা পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মোঃ কামরুল খান বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় জামালপুরে, ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. প্রিয়ব্রত পাল ঈশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ও উপ-উপাচার্য হিসেবে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুল বাকী নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে, একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাঃ আলী নূর বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ বিজনেজ এন্ড টেকনোলজিতে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়েছেন এবং দায়িত্ব পালন করছেন ও করছেন। জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ শওকত জাহাঙ্গীর এবং ইংরেজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমেদ নিজ বিশ^বিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। সঙ্গীত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. অণিমা রায়, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. লাইসা আহমেদ লিসা জাতীয় পর্যায়ের সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। 

অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ড. মোঃ আইনুল ইসলাম বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়কে করেছেন সমুজ্জল। সবচেয়ে বড় আশার জায়গা হল জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখন জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করছেন। এই সকল মেধাবী শিক্ষকদের হাত ধরেই আগামীর চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তত হচ্ছে আগামীর প্রজন্ম। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ছে মেধা। জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. কে.এ. এম রিফাত হাসান পরিচালক (ছাত্র কল্যাণ) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। জগন্নাথ কলেজ প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীদের ছিলো অগ্রণী ভূমিকা। 

বৃটিশ বিরোধী প্রথম নাটক মঞ্চস্থ করেছিলো জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীরা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে শহীদ হন ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী মোঃ রফিক উদ্দিন। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে জগন্নাথ কলেজের অনেক শিক্ষার্থী শাহাদৎ বরণ করেন। জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের বর্তমান বিজ্ঞান ভবনের সামনে ছিলো একাত্তরের পাক-হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প। জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধ ভাস্কর্যটি দেশের একমাত্র ভাস্কর্য যেখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি এবং গণহত্যা ফুটে উঠেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙ্গালীর মুক্তির সনদ ছয়দফা ঘোষণা করলে তাঁর পক্ষে ’৬৬ সালে সর্বপ্রথম মিছিল করেছিলেন জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা। জগন্নাথের ছাত্ররাজনীতি তথা জগন্নাথ কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি থেকে জাতীয় রাজনীতিতে স্থান করে নিয়েছেন সাবেক মন্ত্রী রাজিউদ্দিন রাজু, সাবেক মন্ত্রী কাজী ফিরোজ রশিদ,  ছাত্রনেতা থেকে মন্ত্রী ও অবিভক্ত ঢাকার মেয়র (সাবেক) নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রায়ত সাদেক হোসেন খোকা, মন্ত্রী (সাবেক) হয়েছেন  আছাদুজ্জামান খান কামাল, প্রতিমন্ত্রী (সাবেক) হয়েছেন হারুণ-আল-রশিদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের জিএস থেকে সংসদ সদস্য (সাবেক) হয়েছেন ডা. মোস্তাফা জালাল মহিউদ্দিন, জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ নজরুল ইসলাম বাবু, সাবেক সংসদ সদস্য ধনু সহ অনেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। জগন্নাথের যে সকল কৃতি শিক্ষার্থীরা পরবর্তীতে সরকারের ও দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদ, ভাষা সংগ্রামী অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, কুটনীতিক প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী এ কে এম আব্দুর রউফ। সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পদধুলি পড়েছিলো দেড়শত বছরের পুরানো শিল্প সাহিত্য এবং রাজনীতির আতুরঘর খ্যাত জগন্নাথের ক্যাম্পাসে।

খাতা কলমের হিসেবে জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের বয়স ১৮ পেরিয়ে ১৯ হলেও এর আবেগের বয়স ১৫০ বছর। তাইতো এখনো বিশ^বিদ্যালয়ের যে কোন অনুষ্ঠানে ছুটে আসেন কলেজ আমলের শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন বিভাগের এলামনাই গঠনে কলেজ এবং বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমন্বয় দেখা যায়। বলা যায় জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের বয়স একটি নির্দ্দিষ্ট সংখ্যামাত্র কিন্তু এর আবেগ-ভালবাসা অপরিসীম।
সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে এম সিরাজুল ইসলাম খান, অধ্যাপক ড. আবু হোসেন সিদ্দিক, অধ্যাপক ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, অধ্যাপক ড. মো. ইমদাদুল হক (দায়িত্ব পালনকালে মারা যান), অধ্যাপক সাদেকা হালিম পিএইচডি (মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বেই পদত্যাগ করেন) এর ধারাবাহিকতায় বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক রেজাউল করিম পিএইচ.ডি জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়কে বিশ^মানের বিশ^বিদ্যালয় রুপে গড়ে তোলার জন্য তাঁর মেধা ও মনন দিয়ে কাজ করে চলেছেন। একাডেমিক এবং প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি ক্যাম্পাসটি সুন্দর করে সাজানোর চেষ্ঠা করে যাচ্ছেন। চলতি বছরে বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো নারী দিবস পালন করা হয়। দুর্নীতি ও যৌন নিপিড়নের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষনা করেই ক্ষ্যান্ত হননি তার বাস্তব প্রয়োগ শুরু করেছেন বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক রেজাউল করিম। তিনি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলের সমন্বয়কদের প্রতিনিধি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও একাডেমিক  দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিয়ে বৈষম্যহীন ক্যাম্পাস গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অন্যতম দাবীর মধ্যে রয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দখল হয়ে যাওয়া হলগুলো উদ্ধার, ছাত্র সংসদ চালুকরণ, দ্রুত সময়ের মধ্যে নতুন ক্যাম্পাসের কাজ শেষ করা, মেধার ভিত্তিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষক - কর্মকর্তা - কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া। ছোট ক্যাম্পাস, জায়গার অপ্রতুলতা, নানা সীমাবদ্ধতা, গবেষণাগারের অভাব, ছাত্র হল বিহীন একটা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই চেষ্ঠা করে যাচ্ছেন জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়কে একটি বিশ^মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রুপান্তরিত করার জন্য। আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সম্পূর্ণ প্রস্তুত জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়। আজকের শিক্ষার্থীদের হাত ধরে একদিন বিশ^মঞ্চে মাথা উচু করে দাড়াবে জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়।

লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার এবং সাবেক শিক্ষার্থী
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

যাযাদি/ এস