প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা

প্রকাশ | ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৫৬

তামান্না তাসনিম
ফাইল ছবি

শিক্ষা মানুষের চিন্তা ও বিবেকের উৎকর্ষতা এবং অন্তর্নিহিত শক্তিকে বিকশিত করে। মূল্যবোধের প্রসার ঘটায়। শিক্ষার মূলভিত্তি হলো প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে শিশুদের সহজাত সক্ষমতাকে ব্যবহার করে তার মূল্যবোধ ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা। প্রাথমিক বিদ্যালয় হচ্ছে এ কাজ নিপুণভাবে সম্পাদনের সূতিকাগার। আর এক্ষেত্রে দক্ষ, মেধাবী ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। শিশুরা স্বভাবতই সংবেদনশীল এবং অনুকরণপ্রিয়। 

শিক্ষকদের চরিত্রগুণ এবং জ্ঞানের গভীরতায় শিশুরা প্রভাবিত হয়। একজন আদর্শ শিক্ষক শুধু পাঠ্যবই ই নয়  জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার প্রতি শিশুদের আগ্রহী করে তোলেন।  বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে শিশুর মানসিক গঠনে ভূমিকা রাখেন। তাই বিশ্ব গ্রামের নাগরিক হিসেবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হলে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই শিশুদের জ্ঞান, বিজ্ঞান ও শিল্প সংস্কৃতির চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে।শিক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে গুণগত শিক্ষা বা মানসম্মত শিক্ষাকে।

 ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছর সময়কে ‘জাতিসংঘ শিক্ষা দশক’ হিসাবে গণ্য করে ইউনেস্কো গুণগত শিক্ষার কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করেছিল। 

গুণগত শিক্ষা এমন একটি বিষয় যা কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর নির্ভর করে না। এজন্য প্রয়োজন বিভিন্ন উপাদান যেমন যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক, সঠিক ভৌত অবকাঠামো, উপযুক্ত শিক্ষা পদ্ধতি, উপযুক্ত মূল্যায়ন পদ্ধতির সমন্বিত এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনা। গুণগত শিক্ষার জন্য যে উপাদানটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক। তাই মেধাবী শিক্ষকদের জন্য বুনিয়াদি ও বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি কর্মকালীন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। লব্ধ প্রশিক্ষণ কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে সেটিও নিবিড়ভাবে লক্ষ করা প্রয়োজন। বিদ্যালয় পর্যায়ে প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান প্রয়োগে সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করে উত্তরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যুক্তিসংগত অনুপাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

এই গুণগত বা কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিতে অন্তরায়গুলো হচ্ছে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার উচ্চহার, অতিদরিদ্র বা দুর্গম এলাকার শিশুদের ভর্তি না-হওয়ার প্রবণতা, বাল্যবিবাহ ও অন্যান্য কারণে নারী শিক্ষার্থী হ্রাস, শহরাঞ্চলে ক্রমবর্ধমান দরিদ্র জনসংখ্যা এবং মানসম্মত প্রশিক্ষণমূলক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশের অভাব। 

গুণগত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনে দলবদ্ধভাবে শেখার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। কারণ দলগতভাবে কাজের মাধ্যমে বাস্তব জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব।  শিশুদের মাঝে শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিকতা ও আত্মবিশ্বাসের সন্নিবেশ ঘটাতে হবে। কারণ শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধু মানবযন্ত্র তৈরি নয়, বরং কাদামাটির মত মানবশিশুকে বরেণ্য চিত্রকর, সংগীতশিল্পী, খেলোয়াড় হিসেবে তৈরি করা। সমাজের সব শ্রেণির শিশুদের জন্য একীভূত শিক্ষার ব্যবস্থা করা এবং উদ্ভাবনী বিভিন্ন কার্যক্রমে উৎসাহ প্রদান এ ব্যাপারে জোড়ালো ভূমিকা রাখবে। নিয়মিত ও ফলপ্রসূ মা সমাবেশ, অভিভাবক সমাবেশ, হোমভিজিট ও উঠান বৈঠকের মাধ্যমে, শিশু অভিভবক এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে পারস্পরিক বোঝাপড়া তৈরি করতে হবে। সর্বোপরি যথাযথ মনিটরিং এর মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা এর গুণগতমান নিশ্চিত করতে হবে।  

আমরা জানি যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)’ এর ৪ নং অভিষ্ট হলো ‘সকলের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষালাভের সুযোগ সৃষ্টি। যার ৪.২ নং লক্ষ্যমাত্রা হলো ২০৩০ সালের মধ্যে সকল ছেলে মেয়ে যাতে প্রাথমিক শিক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাসহ শৈশবের একেবারে গোড়া থেকে মানসম্মত বিকাশ ও পরিচর্যার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে তার নিশ্চয়তা বিধান করা। তাই শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে আমাদের সচেষ্ট হতে হবে।

লেখক : ইউএনও সদর