বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ২৬ আশ্বিন ১৪৩১

বিশ্ববিদ্যালয় দিবস : বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

ড ইলিয়াছ প্রামানিক
  ১০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৬
ফাইল ছবি

১২ অক্টোবর ২০২৪ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী; এদিন উদ্বোধন করা হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক। ২০০৮ সালের ২০ অক্টোবর রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে যাত্রা শুরু করে উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি)। এই প্রতিষ্ঠানের পেছনের ইতিহাস দীর্ঘ এবং সংগ্রামের। নব্বই দশক থেকেই রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবী ওঠে।

১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় সংসদে এই প্রসঙ্গে আলোচনা হয়। তবে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ এবং ২০০১ সালে পুনরায় বিএনপি ক্ষমতায় আসলেও, কোনো সরকারই রংপুরে একটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি। রংপুরের সন্তান হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদও দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন, কিন্তু তিনিও রংপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেননি। “রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয় চাই” এই স্লোগানকে সামনে রেখে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন সমন্বয় পরিষদ গঠিত হয়। এই পরিষদের মাধ্যমে রংপুরের নাগরিক সমাজ তাঁদের দাবীটি ২০০৮ সালের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জোরালোভাবে পেশ করে। সংসদের ভিতরে এবং বাইরে ব্যাপক আলোচনা হলেও সমাধান আসেনি, অবশেষে ২০০৮ সালে সেই সময়ের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রংপুরের মানুষের ন্যায্য দাবীটির প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে রংপুরে একটি পুরনাঙ্গ সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ১২ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে সমগ্র কৃতিত্ব নিজের ঘরে তোলার চেষ্টা করেছে।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০১৮ সালের মধ্যে ১৫টি একাডেমিক ভবন, একটি ১০ তলা প্রশাসনিক ভবন, ৮টি হল, ১৪টি কোয়ার্টার, ৬টি ডরমিটরি, একটি জিমনেসিয়াম এবং একটি অডিটোরিয়াম নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল। তবে ২০২৪ সাল নাগাদ এসে দেখা যাচ্ছে যে, এই পরিকল্পনার এক-তৃতীয়াংশও বাস্তবায়িত হয়নি। প্রতিষ্ঠানটি ৫টি বিভাগ এবং তিনটি অনুষদ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে ৬টি অনুষদের অধীনে ২২টি বিভাগ রয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউজিসি-র (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন) কোর্সলোড অনুসারে প্রয়োজনীয় শিক্ষকের ৩০% কোনো বিভাগেই নেই। অনেক বিভাগে দুটি শ্রেণীকক্ষে ছয়টি ব্যাচ পাঠদান করছে, যেখানে নেই কোনো গবেষণাগার (ল্যাব) বা সেমিনার লাইব্রেরি।

আবার কিছু বিভাগে একটি শ্রেণীকক্ষেই চারটি ব্যাচ পাঠদান করছে, যা শিক্ষার মানকে উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকটও অত্যন্ত প্রকট। প্রায় ৮,০০০ শিক্ষার্থীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে আসন রয়েছে মাত্র ৮০০টি। বিশ্ববিদ্যালয়টি ৭৫ একর জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত হলেও এখানে কোনো স্টেডিয়াম বা পর্যাপ্ত খেলার মাঠ নেই, বরং চারপাশে দেখা যায় অপরিকল্পিত বনায়ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন ব্যবস্থাও পর্যাপ্ত নয়। ৫২ সিটের ৫টি এবং ৩৬ সিটের ১টি বাস দিয়ে প্রায় ৭,০০০ শিক্ষার্থীর যাতায়াতের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব নয়, যা শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন জীবনে বড় ধরনের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়টি নেসকোর অধীনে ১১ কেভি আলাদা ফিডার থাকলেও, নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ পায় না। দীর্ঘদিন ধরে পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ পিএলসি এর অধীনে ৩৩ কেভি আলাদা লাইনের দাবি থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে ক্যাম্পাসে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়াও, ৪৪০ ভোল্টের ক্যাবলগুলোর মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় প্রায়ই সেগুলো ছিঁড়ে পড়ে এবং মেরামতের জন্য দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হয়, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করছে। বিশেষ করে ল্যাবের ক্লাস ও পরীক্ষা এসব সমস্যার কারণে বারবার বিঘ্নিত হচ্ছে।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) বিদ্যুৎ সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান হতে পারে ক্যাম্পাসের বিদ্যুৎ লাইনগুলোকে ভূগর্ভস্থ করা। তবে এটি বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ আর্থিক বরাদ্দ প্রয়োজন, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে বরাবরই অবহেলিত হয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বেরোবি সর্বমোট ২০০ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ পেয়েছে, যা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য একেবারেই অপ্রতুল। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, কেবল ২০২৪-২৫ অর্থবছরেই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ পেয়েছে ১,৬৫৫ কোটি টাকা, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছে ৮৪০ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা এবং বেরোবির ১০ বছর পরে প্রতিষ্ঠিত শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়, নেত্রকোনা প্রকল্প পেয়েছে ২,৬৩৭ কোটি ৪১ লক্ষ টাকা। দেশের এই বাজেট বরাদ্দের বৈষম্য বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি উৎকর্ষ প্রতিষ্ঠান (Center of Excellence) হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়।

১২ অক্টোবর, ২০২৪ উদ্বোধনের অপেক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক

৩৬ দিনের জুলাই বিপ্লবে এই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাইদ বুক পেতে দিয়েছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে। তাঁর শাহাদত বিশ্বকে আলোড়িত করেছিল। তাঁর এই বৈষম্য বিরোধী অবস্থান আবু সাইদের সহযোদ্ধাদের আজীবন জিবন্ত করে রাখবে, কিন্তু জিবন্ত করতে পারছে না শুধু বেরোবিকে। সরকারী উন্নয়ন প্রকল্পের বৈষম্যের স্বীকার বেরোবি মাথা উচু করে দাঁড়াতে চায় ।

বেরোবি এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে একটি উচ্চকণ্ঠ স্লোগান নির্ধারণ করেছে: “ধন্য বেরোবি; গড়বো দেশ; আবু সাইদের বাংলাদেশ।” এই স্লোগান কেবল একটি আদর্শ নয়, এটি একটি প্রতিজ্ঞা, যা বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠা এবং শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী অবস্থানের প্রতিফলন। এ বছর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আবু সাইদের সহযোদ্ধারা তাঁদের বৈষম্য বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করবেন, যা বেরোবির বিপ্লবোত্তর শিক্ষার্থীদের মাঝে নতুন উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য যোগদানের পর থেকে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাথে নিবিড়ভাবে সমন্বয় করছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতির জন্য প্রতিদিন নিবেদিতভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে এই প্রচেষ্টা তখনই সার্থকতা লাভ করবে, যখন সরকারের পক্ষ থেকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন এবং এর শিক্ষার্থীদের প্রতি প্রয়োজনীয় গুরুত্বারোপ করা হবে।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বেরোবি পরিবারের প্রত্যাশা, আবু সাইদের আত্মত্যাগ যেন অনুপ্রেরণা হয়ে জাগ্রত করে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে থাকা সংকল্প ও সাহস যেন গড়ে তুলে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। আমরা সবাই একত্রিত হয়ে উচ্চারণ করি—"ধন্য বেরোবি; গড়বো দেশ; আবু সাইদের বাংলাদেশ!" এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে চলুন, আমাদের অধ্যয়নের মাধ্যমে ও সমাজের কল্যাণে অবদান রেখে, বেরোবিকে একটি উৎকর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করি। সরকারের সুদৃষ্টি ও সমর্থন আমাদের এই যাত্রার অপরিহার্য অংশ; একসাথে আমরা এগিয়ে যাব, আলোয় আলোকিত করব আমাদের স্বপ্নের ক্যাম্পাস।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান

কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

[email protected]

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে