৮১ বছর পরে কুমিল্লার ময়নামতি ‘ওয়ার সেমেটারি’তে কবর দেওয়া জাপানি সৈন্যদের দেহাবশেষ ফিরিয়ে নেওয়ার কাজ শেষ হয়েছে। এই সেমেটারিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিহত জাপানি ২৪ জন সৈন্যের রেকর্ড থাকলেও পাওয়া গেছে ২৩ জনের দেহাবশেষ। ১০ দিন ধরে কবর খনন ও দেহাবশেষ উদ্ধারের কাজ করা হয়। যে ২৩ জনের দেহাবশেষ পাওয়া গেছে তাদের কঙ্কালগুলোর মাথা, চোয়ালের অংশ এবং দাঁত ভালো পাওয়া গেছে। অনেক মাথায় গোল চিহ্ন পাওয়া গেছে এবং এ কারণে সন্দেহ করা হচ্ছে, যে তাদের মাথায় গুলি করা হয়েছিল।
কীভাবে জাপানের সৈন্যদের বাংলাদেশের মাটিতে কবর হলো, কীভাবে তাদের দেহাবশেষ ফিরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হলো এবং আর কীভাবেই বা কাজটি সম্পাদন হলো; এ বিষয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন খনন কাজে বিশেষজ্ঞ লেফটেনেন্ট কর্নেল (অব) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (বীর প্রতীক)। তিনি খনন কাজ এবং দেহাবশেষ ফিরিয়ে নেওয়ার কার্যক্রমে ‘ফোকাল পয়েন্ট’ হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন।
জাপানি সৈন্যদের মরদেহ কীভাবে কুমিল্লায় এলো
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বার্মাতে (বর্তমানে মিয়ানমার) যখন জাপানিরা আক্রমণ করে তখন প্রতিরোধ করছিল ব্রিটিশ সৈন্যরা। ওই সময় এই অঞ্চলে কয়েকটি ক্যান্টনমেন্টও বানিয়েছিল ব্রিটিশরা। এরমধ্যে বাংলাদেশে চট্টগ্রাম এবং কুমিল্লায় দুটি ক্যান্টনমেন্ট তৈরি করা হয়। এ অঞ্চলে সামরিক বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন ফিল্ড মার্শাল স্লিম (কমান্ডার অব দি ফোর্সেস)। তিনি ময়নামতিতে একটি আন্ডারগ্রাউন্ড কমান্ড পোস্ট বানিয়েছিলেন।
‘বার্মা ফ্রন্টে’ অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটছিল এবং তাদের অনেককেই কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হতো। আহতদের মধ্যে ছিল ব্রিটিশ, আমেরিকান, জাপানিজ, আফ্রিকান, ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের তৎকালীন ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান। ধর্ম অনুযায়ী এদের বেশিরভাগই ছিলেন মুসলিম ও খ্রিষ্টান। তবে নিহত আফ্রিকানদের ধর্ম সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ফিল্ড মার্শাল স্লিম চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় দুটি ব্রিটিশ জেনারেল হাসপাতাল বানিয়েছিলেন। এর কার্যক্রম ১৯৪১ সালে শুরু হয়। যখন অনেক সৈন্য এই অঞ্চলে মারা যাওয়া শুরু হলো তখন তিনি ১৯৪৩ সালের দিকে ‘আর্মি গ্রেভ সার্ভিস’ চালু করেন এবং নিহতদের কবরস্থান খুঁজে বের করার জন্য একটি কমিটি করে দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েট বাঙালি কাজী আব্দুল মোতালেব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বার্মা ফ্রন্টে যুদ্ধ করেছেন। পরবর্তী সময়ে আব্দুল মোতালেব কবরস্থান অনুসন্ধান কমিটির সদস্য হন। আব্দুল মোতালেবের সন্তান হলেন লেফটেনেন্ট কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির।
কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বলেন, ‘বাবা বলতেন, এই জায়গাটি নির্বাচন করা হয়েছিল কয়েকটি কারণে। প্রথমত এই জায়গাটি খুব সুন্দর। চারপাশে ফুলের গাছসহ বিভিন্ন গাছপালায় আচ্ছাদিত ছিল। এটি ছিল পাহাড়ি এলাকা।’
তিনি জানান, এখানে কবরস্থান তৈরির কাজ শেষ হয় ১৯৪৩ সালে এবং কবর দেওয়া শুরু হয় ১৯৪৪ থেকে। এই গোরস্থানে মোট কবর রয়েছে ৭৩৬টি। এরমধ্যে ১৭০টিরও বেশি মুসলমানের কবর। জাপানিজদের কবর আছে ২৪টি। আর ব্রিটিশ সৈন্যদের কবর আছে ৫০৩টি। এরমধ্যে সর্ব্বোচ্চ পদধারী রয়েছে একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, যিনি দুটি পদক পেয়েছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানিজরা ছিলেন বিরোধীপক্ষে। তাই তাদের মরদেহ কী করা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বলেন, ‘জাপানিজরা যখন মারা যাচ্ছিল তখন তাদের যথাযথভাবে সমাহিত করার জন্য বাবা তার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, ডেড শ্যুড হ্যাভ নো এনিমিস (মৃতদেহের কোনও শত্রু থাকা উচিৎ নয়)। পরে সেখানেই তাদের কবরস্থ করা হয়।
দেহাবশেষ ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ
২০১৩ সালে জাপান দেহাবশেষ ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়। কাজী সাজ্জাদ আলী বলেন, ‘আমার সঙ্গে ২০১৩ সালে জাপানিজদের প্রথম কথা হয়। ওই সময়ে কথাবার্তা কিছু এগুলোও হোলি আর্টিজানের কারণে এটি পিছিয়ে যায়। আবার এ বিষয়ে নতুন করে উদ্যোগ নেওয়া হলে দেহাবশেষ উদ্ধারের কাজ শুরু হয়।’
কবর খননকাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছে কমনওয়েলথ। কবর খননের আগে তারা কিছু শর্ত দিয়েছিল। এরমধ্যে রয়েছে অন্য কবরগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে, কমনওয়েলথের লোক কবরস্থান পরিদর্শন করবে, সবচেয়ে কম ক্ষতি করে কবর খনন করতে হবে এবং যা ক্ষতি হবে সেটি পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে হবে।
কাজী সাজ্জাদ আলী বলেন, ’এরমধ্যে আগের অবস্থায় ফেরত আনার কাজ শুরু হয়েছে। কবরগুলো পূরণ করা হয়েছে এবং এরপরে হেডস্টোনগুলো লাগিয়ে দেওয়া হবে।’
দেহাবশেষ উদ্ধার
প্রথম অবস্থায় কবরগুলোতে নির্দেশনা হিসেবে শুধু একটি কাঠের ক্রস লাগানো ছিলে, যা পরে ভেঙে যায়। ১৯৫১ সালে কমনওয়েলথের উদ্যোগে কবরগুলোতে হেডস্টোন লাগানো হয়। জাপানিজ সৈন্যদের মধ্যে ২০ জনের নাম পাওয়া গেছে এবং চার জনের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
জাপানিজরা বিরোধীপক্ষে থাকায় তাদের কবর দেওয়ার সময়ে কোনও আনুষ্ঠানিকতা করা হতো না। স্থানীয় যেসব কন্ট্রাক্টর ছিল, তাদেরই বলা হতো কবর দিয়ে দেওয়ার জন্য।
কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বলেন, ‘আমরা এক জায়গা দুটি কঙ্কাল পেয়েছি, যা প্রায় একসঙ্গে লেগে আছে। আরেকটি ক্ষেত্রে মাথা উল্টো দিকে করা পাওয়া গেছে। কিছু ক্ষেত্রে একটি হাত ও পা পাওয়া গেছে এবং অন্য হাত ও পা পাওয়া যায়নি। এর একটি অর্থ হতে পারে যে হাত ও পা কেটে ফেলা অবস্থায় কবর দেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘মাথা, চোয়ালের অংশ এবং দাত ভালো পাওয়া গেছে। অনেক মাথায় গোল চিহ্ন পাওয়া গেছে এবং সন্দেহ করা হয় যে তাদের মাথায় গুলি করা হয়েছিল।’
প্রাথমিক কবর খনন ধাতব যন্ত্রাংশ দিয়ে করলেও দেহাবশেষ উদ্ধারের সময়ে মাটি সরানোর ক্ষেত্রে বাশের কঞ্চি এবং ব্রাশ ব্যবহার করা হয়েছিল। এর কারণ হচ্ছে লোহা বা ধাতব জিনিস দিয়ে করলে দেহাবশেষের ক্ষতি হতে পারতো।
দেহাবশেষ উদ্ধার প্রক্রিয়া যেমন জটিল ছিল, তেমনি এটি বিমানে করে নিয়ে যাওয়াও ছিল আরেকটি জটিল প্রক্রিয়া। যে বাক্স করে দেহাবশেষ নিয়ে যাওয়া হয়েছে, বিমানবন্দরে সেটির কোনও স্ক্যানিং করা হয়নি। শুধু তাই নয়, বাক্সগুলোকে কনভেয়ার বেল্টে দেওয়ার সময়ে কোনও ফর্কলিফ্ট ব্যবহার না করে হাতে করে বহন করে কনভেয়ার বেল্টে দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, দেহাবশেষগুলো দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার পর তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেবে জাপান সরকার। পরে তাদের ইচ্ছানুযায়ী স্থানে যথাযথ মর্যাদায় সমাহিত করা হবে।
যাযাদি/এসএস