২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়েও কমেনি বায়ুদূষণ 

প্রকাশ | ০১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:২৮

আলতাব হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর হচ্ছে রাজধানী ঢাকা। প্রায় দুই দশক ধরে বায়ুদূষণ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে ঢাকা। বায়ুদূষণের কারণে রাজধানী ঢাকায় গড় আয়ু কমছে ৭ বছর ৭ মাস। আর সারাদেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস। বায়ুদূষণের কারণে শিশুমৃত্যুর হার বিশ্বে সর্বোচ্চ বাংলাদেশে। বায়ুদূষণে জিডিপির ৫ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। মানুষের মৃত্যুর ক্ষেত্রে চতুর্থ প্রধান কারণ এখন বায়ুদূষণ। বয়স্ক ও শিশুদের অ্যাজমা বেড়ে যাচ্ছে, অসুস্থ বাচ্চার জন্ম হচ্ছে। আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বায়ুদূষণ বন্ধে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার পরও রাজধানী ও আশপাশের জেলার মানুষ পায়নি নির্মল বায়ু। বছরের আট মাসই বিপজ্জনক অবস্থায় বসবাস করছে নগরবাসী। এমনকি বৃষ্টির দিনেও বায়ুদূষণে বিশ্বে শীর্ষে থাকে ঢাকা। 

পরিবেশ দূষণ বন্ধে পরিবেশবাদী সংগঠন ও নাগরিক কমিটির আন্দোলনের মধ্যে হাইকোর্ট একাধিকবার সরকার ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে বায়ুদূষণ বন্ধে কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেন। এরপর পরিবেশ অধিদপ্তরের মাধ্যমে ‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ’ বা ‘বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল সাসটেইনেবল ট্রান্সফরমেশন’ (বেস্ট) শীর্ষক একটি মেঘা প্রকল্প করে পরিবেশ মন্ত্রণালয়। 

২০০৯ সালে রাজধানীর বায়ুদূষণ বন্ধে সরকারের বাজেট বরাদ্দ ও জলবায়ু তহবিলসহ অন্যান্য খাত থেকে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেই অর্থে মাঝে মধ্যে শহরের প্রধান প্রধান সড়কে পানি ছিটানো হতো এবং ঢাকার আশপাশের শিল্প কারখানার থেকে নির্গত বায়ুদূষণ বন্ধে ইটিপি স্থাপন কর্মসূচিতে ব্যয় হয়। কিছু কারখানা ইটিপি স্থাপন করলেও বেশিরভাগ কারখানা তা বাস্তবায়ন করেনি। এতে নির্মল বায়ু পায়নি রাজধানীবাসী।

এরপর ২০১৪ সালে ‘বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল সাসটেইনেবল ট্রান্সফরমেশন’ (বেস্ট) শীর্ষক মেঘা প্রকল্পে আট হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয় বিশ্বব্যাংক। সেই টাকা দিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ১৪তলা নিজস্ব ভবন, আন্তর্জাতিকমানের অডিটরিয়াম এবং আধুনিক ল্যাবরেটরি নির্মাণ, বায়ুমান নির্ধারণী কেন্দ্র ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ করেছে। প্রকল্পের ৮০২ কোটি টাকার মধ্যে ৫০ ভাগ ব্যয় করা হয়েছে নন মেটেলিয়ালস খাতে, ২৫ ভাগ ব্যয় হয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা ও অভিজ্ঞতার নামে বিদেশ ভ্রমণে। নয় ছয় করে বায়ুদূষণরোধ প্রকল্পের অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, প্রকল্পটি বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কোনো ভ‚মিকা রাখতে পারেনি।

২০২০ সালে বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পে (আট মিলিয়ন মার্কিন ডলার) প্রায় ছয় হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা ঋণ দেয়। এই অর্থ প্রতিষ্ঠানিক অবকাঠামো, দূষণ নিয়ন্ত্রণে আইনের প্রয়োগ, জনবল বৃদ্ধি ও দক্ষতা উন্নয়নের কাজেই খরচ হয়েছে। লোক দেখানো পানি ছিটানো আর মাঝে-মধ্যে দূষণকারী ইটভাটা বন্ধ করা হয়েছে। সার্বক্ষণিক বায়ুমান নির্ধারণী কেন্দ্র স্থাপন এ নিয়েও নয়-ছয়ের অভিযোগ রয়েছে। 

এরপরও রাজধানী ঢাকায় বায়ুদূষণরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় একাধিকবার হাইকোর্ট হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সচিবদের তলব পর্যন্ত করেন হাইকোর্ট। জলবায়ুর তহবিলের টাকা অপাত্রে অর্থ ব্যয় নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। 

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের মেঘা কেস প্রকল্পের সাবেক প্রকল্প পরিচালক ড. এস এম মনজুরুল হান্নান খান বলেন, বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতায় ৮০২ কোটি টাকার কেস প্রকল্প পরিবেশ অধিদপ্তর ঢাকা সিটি করপোরেশন এবং ডিটিসিএ এর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়। এর মধ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে ৪৬৩ কোটি টাকা, পরিবেশ অধদপ্তরকে ২৮৪ কোটি টাকা এবং ডিটিসিএ কে ৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয় এবং প্রত্যেকটি অঙ্গের জন্য আলাদা আলাদা প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করা হয়। প্রকল্পটি ১০ বছর ধরে বাস্তবায়ন করা হয়েছে, তবে তিনি শেষের তিন বছর প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এই প্রকল্পের অর্থ ভাগভাটোয়ারা করে নেওয়ার অভিযোগ আছে। এত বড় মেঘা প্রকল্প শেষ হলেও  বায়ুদূষণ কমেনি। বরং দিনের পর দিন দূষণ বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজধানী থেকে মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী পর্যন্ত দূষণ বেড়েছে। 

শুষ্ক মৌসুমের শুরু থেকে (অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত) ঢাকায় বায়ুদূষণ ভয়াবহ হয়ে ওঠে। বাতাসের গুণমান বছরের প্রায় অর্ধেক সময় ধরেই খুব খারাপ থাকে এবং শীতকালে তা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হয়ে দাঁড়ায়। গত দুই দশক ধরে বায়ুদূষণ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে ঢাকা। এই সময় শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি, চুলকানিসহ বিভিন্ন চর্মরোগে আক্রান্ত হয় মানুষ। এই সময়টায় উত্তরের হিমেল বাতাস প্রবাহিত হয়। তখন বিষাক্ত বাতাস শ্বাস নেওয়ার সময় ফুসফুসে ঢুকে পড়ে। এ কারণে মানুষ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়। বায়ুদূষণের কারণে মানুষের শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে ক্যানসার, অ্যাজমা, অ্যালার্জি, চুলকানিসহ বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ বৃদ্ধি পায়। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশু এবং বয়স্করা।

পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণা দেখা যায়, সারাদেশে ইটভাটা আছে প্রায় আট হাজার। আর ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোতে রয়েছে সাড়ে ৭০০টির বেশি ইটভাটা। ইটভাটাগুলো প্রতি মৌসুমে ২৫ লাখ টন কয়লা ও ২২ লাখ টন জ্বালানি কাঠ পোড়ায়। ইটভাটার দূষণে ৮৮ লাখ ৮৬ হাজার টন গ্রিন হাউস গ্যাস হয়। ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা প্রায় ৫৮ শতাংশ দায়ী। এ ছাড়া নির্মাণকাজ, যানবাহন, সড়ক ও মাটি থেকে সৃষ্ট ধুলার মাধ্যমে ১৩ শতাংশ, বিভিন্ন জিনিসপত্রসহ প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে ৫ শতাংশ এবং প্রতিবেশী দেশ ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের দূষিত বায়ু পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার হয়ে দূষিত বায়ুর স্তর ঢাকার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে ২৪ শতাংশ দূষণে ভুগছে ঢাকা। নাসার তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা বেড়েছে ৮৫ শতাংশ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার বাতাসে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সালফার ডাই অক্সাইডের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। ঢাকার বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ২৫০ মাইক্রোগ্রাম ধুলিকণা ভেসে বেড়ায়। সহনীয় মাত্রার চেয়ে এই পরিমাণ পাঁচ গুণ বেশি। বায়ুদূষণে রাজধানীর ৭১ শতাংশ মানুষ বিষণ্নতায় ভুগছেন। বায়ুদূষণজনিত ক্যানসারসহ শ্বাসযন্ত্রের নানা রোগ বাড়ছে। 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ শামসুল কবীর চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের বাতাসে এই বস্তুকণা ২.৫ এর পরিমাণ ৭৭.১ মাইক্রোগ্রাম পার কিউবিক মিটার, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডের চেয়ে সাত গুণ বেশি। দেশের ৬৪টি জেলার প্রত্যেকটিতেই বায়ুদূষণের হার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী তিন গুণ বেশি। শহরে বস্তুকণার মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতি বলা হয়, অতিসূক্ষè বস্তুকণা ২.৫। যা মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ঢুকে যায়। বেঁচে থাকার জন্য শ্বাস নিতে গিয়ে মানুষ প্রতিদিন ফুসফুসের মাধম্যে দুই হাজার লিটারের বেশি বাতাস গ্রহণ করে থাকেন। এই শ্বাস গ্রহণের সময়েই ফুসফুসে ঢুকছে দূষিত বস্তুকণা। দূষিত বায়ুর এই বস্তুকণা মানুষের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করছে। 

নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকা একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দূষণের জন্য দায়ী পুরনো ইটভাটা, দূষণকারী যানবাহন ও শিল্পকারখানার বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। বায়ুদূষণ বেশি হয় এমন স্পটগুলোতে বায়ুমান পরিবীক্ষণ যন্ত্র বসানো হয়েছে। প্রতিবেশী দেশের দূষণের কারণে আমরা ২৪ শতাংশ দূষণে ভুগছি, এ ছাড়াও জেলাগুলোর উন্নয়ন কাজের দূষণ ঢাকায় আসছে। গ্রামাঞ্চলে লাকড়ির চুলার ধোয়ায় দূষণ বাড়ছে। বছরে একাধিকবার ফসল উৎপাদনের কারণে বায়ুদূষণ বাড়ছে। শিল্পকারখানার দূষণ ও সিমেন্ট কারখানার দূষণ মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
এ দিকে রোববার বাংলাদেশ ক্লিন এয়ার প্রজেক্টে আবার ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা দেওয়ার কথা জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ও পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এ তথ্য জানান।

যাযাদি/ এসএম