লাইনচ্যুত ট্রেনের চাকা বা দেবে যাওয়া রেললাইন ওপরের দিকে তোলার কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র ‘লিফটিং জ্যাক’ ভারত থেকে আমদানি করলে খরচ পড়ে মাত্র ১৯ হাজার টাকা। কিন্তু এই যন্ত্র ঠিকাদারের কাছ থেকে রেলওয়ে কিনেছে ৩ লাখ টাকায়। ৬৫ হাজার টাকার একটি ড্রিলিং মেশিন কেনা হয়েছে ৯ লাখ ৬৫ হাজার ৬০০ টাকায়। ‘কাটিং ডিস্ক’ নামের আরেকটি যন্ত্র কেনা হয়েছে বাজারমূল্যের চেয়ে ৮ গুণ বেশি দামে। ঠিকাদারের মাধ্যমে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের (চট্টগ্রাম) অধীন ট্রাক সাপ্লাই কর্মকর্তার (টিএসও) কার্যালয় চার ধরনের মোট ২৮টি যন্ত্র কিনেছে। এসব যন্ত্রের প্রকৃত বাজারমূল্য সাড়ে ১৮ লাখ টাকা। অথচ এগুলো কিনতে ব্যয় করা হয়েছে ২ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রেলওয়ের কেনাকাটায় এ ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে হরহামেশাই। মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় গত জুনে যে প্রতিবেদন দিয়েছে তাতে দেখা গেছে বাজারের চেয়ে ১৫-২০ গুণ বেশি দাম দিয়ে রেলওয়ে নানা যন্ত্রপাতি কিনেছে।
শুধু কেনাকাটাতেই নয়, রেলের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নেও ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। দুর্নীতির কারণে প্রায় প্রতিটি প্রকল্পের খরচ দ্বিগুণ বেড়েছে। কোনো কোনো প্রকল্পের খরচ ১০ গুণও বেড়েছে।
২০১০ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন হওয়ার সময় চট্টগ্রামের দোহাজারি থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার ও রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার আগেই ২০১৬ সালে বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন শেষে প্রকল্প ব্যয় এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। নির্মাণ শুরুর আগেই প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায় ১০ গুণ বা ১৬ হাজার ১৮২ কোটি টাকা। অস্বাভাবিক ব্যয় বাড়ানোর পরও এই প্রকল্পে নিম্নমানের কাজ ও নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।
রেল খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, দুর্নীতিমুক্ত সেবা খাত বাস্তবায়নে লোক দেখানো নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও গত ১৫ বছরে রেলের দুর্নীতি সামান্য কমানো যায়নি। বরং এ সময়ে তা হু হু করে বেড়েছে। তবে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে যার দোষী প্রমাণিত হয়েছে তারা বরাবরই থেকেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেউ কেউ আবার দুর্নীতির মামলায় জেল খেটেও আসীন হয়েছেন রেলের স্বপদে। দুর্নীতিবাজ রাঘববোয়ালদের সাজা না হওয়ায় মন্ত্রণালয় থেকে নথি গায়েব করার মতো দুঃসাহসও দেখিয়েছেন কেউ কেউ। যদি আওয়ামী লীগ সরকারের রেলমন্ত্রীরা সবাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
তবে এতে যে কাজের কাজ কিছুই হয়নি তা মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের প্রায় প্রতি বছরের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। দুদকের তদন্তেও ব্যাপক দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের হিসেবেই ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেলের আয় ছিল ১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা আর ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। এ অর্থবছরে রেলের মোট লোকসান হয় ১ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। দুর্নীতির কারণেই সিংহভাগ লোকশান হয়েছে বলেও প্রমাণ মিলেছে। অতি সম্প্রতি দুদকের এক তদন্তে শত কোটি টাকা হরিলুটের প্রমাণ মিলেছে। দেখা গেছে, চট্টগ্রাম রেলওয়ের বৈদ্যুতিক প্রকৌশলীর কার্যালয়ের জন্য একেকটি এলইডি লাইট কেনা হয়েছে পাঁচ গুণেরও বেশি দামে ২৭ হাজার সাতশ’ টাকায়। যার বাজার মূল্য পাঁচ হাজার টাকার বেশি নয়।
দুদক সূত্র জানায়, রেল খাতে গত ১৫ বছরে ১০টি খাতে বেশি দুর্নীতি হয়েছে। সেগুলো হলো- রেলওয়ের অধীনে ওয়াগন, কোচ, লোকোমোটিভ ক্রয় ও সংগ্রহ; স্টেশন সিগনালিং ব্যবস্থার পুনর্বাসন ও আধুনিকায়ন; ডাবল লাইন, সিঙ্গেল লাইন, ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ; রেলওয়ের ভূমি অধিগ্রহণ, যাত্রীবাহী ক্যারেজ পুনর্বাসন নিলামে যন্ত্রাংশ বিক্রয়, রেলওয়ের অধীনে ওয়ার্কশপগুলো ও সিøপার ফ্যাক্টরি কার্যকর না করে আমদানির মাধ্যমে অনিয়ম। এছাড়া নিয়োগ এবং টিকিট বিক্রিতেও অনিয়মের কথা বলা হয়।
পরিচালন ব্যয়ের ক্ষেত্রে দুর্নীতির তথ্য প্রমাণ উঠে আসে রেলওয়ের নিজস্ব অডিটেও। এতে দেখা যায়, রেলের সেবার মান ও রাজস্ব আয় না বাড়লেও বছর বছর বাড়ছে সংস্থাটির পরিচালন ব্যয়। আয়ের চেয়ে ব্যয় দ্বিগুণ হওয়ায় ভারী হয়েছে রেলের লোকসানের পাল্লা। গত ১৪ বছরে শুধু রেলের পরিচালন খাতে লোকসান হয়েছে ১৮ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। এর সঙ্গে কোচ ও ইঞ্জিন কেনার টাকা, বিভিন্ন প্রকল্পে সরকারের বিনিয়োগ যুক্ত করলে লোকসানের পরিমাণ আরও কয়েকগুণ বেশি হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, স্বাধীনতার পর কখনো লাভের মুখ দেখেনি রেল। লোকসানের পাশাপাশি কমেছে রেলওয়ের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাও। ২৫ বছর আগে যেখানে ১ টাকা আয় করতে ৯৬ পয়সা ব্যয় করতে হতো, বর্তমানে সেখানে ১ টাকা আয় করতে রেলওয়ের ব্যয় হচ্ছে ২ টাকা ৭৮ পয়সা। অর্থাৎ আয়ের চেয়ে রেলের ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ। ফলে সরকারের বিনিয়োগ করা অর্থ ফেরত আসা তো দূরের কথা, ট্রেনের পরিচালন খরচের অর্ধেকও তুলতে পারছে না সংস্থাটি।
যোগাযোগ ও পরিবহণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় রেলে পরিচালন ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি লোকসানও বেড়েছে। অনিয়ম বন্ধ এবং সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করতে না পারার কারণে রেলওয়ের লোকসান কমানো সম্ভব হয়নি। লোকসান কমাতে দুর্নীতি কমিয়ে ব্যয় সংকোচনের পাশাপাশি পণ্যবাহী ট্রেন বাড়ানোর পরামর্শ দেন তারা।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেলের আয় ১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা হলেও পরিচালন ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে রেলের মোট পরিচালন লোকসান হয়েছে ১ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। এর আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে রেলে সরকারের খরচ হয়েছে ১৬ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে রেলপথ নির্মাণ ও বগি-ইঞ্জিন কেনায় বিনিয়োগ ১২ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। আর ট্রেন পরিচালন ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। বিপরীতে আয় হয়েছে ১ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। ওই বছর রেকর্ড ২ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা পরিচালন লোকসান হয়েছে।
২০২০-২১ অর্থবছরে রেলের পরিচালন লোকসান হয়েছে ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। অথচ ২৫ বছর আগেও বাংলাদেশ রেলওয়ে যাত্রী ও পণ্য পরিবহণের আয় দিয়ে ট্রেন পরিচালনার সব ব্যয় মিটিয়ে কিছু অর্থ উদ্বৃত্ত থাকত। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে রেলের পরিচালন উদ্বৃত্ত ছিল প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা। বর্তমানে উদ্বৃত্ত দূরের কথা, লোকসান ছাড়িয়েছে হাজার কোটি টাকা।
রেলের কর্মকর্তারা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৪টি বাজেটে রেলওয়ের জন্য ১ লাখ ২১ হাজার ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ট্রেন পরিচালনায় ১৪ বছরে রেলের গচ্চা গেছে ১৮ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা।
এদিকে রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে রেলের পরিচালন লোকসান দ্বিগুণেরও বেশি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রেলের ১ হাজার ৩৪ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে পরিচালনা ব্যয় হয়েছিল ২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ওই বছর পরিচালন লোকসান হয়েছে ১ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোট আয় হয়েছিল ৯৫৬ কোটি টাকা। ব্যয় হয়েছিল ১ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা। লোকসান ছিল ৯২২ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রেলের আয় হয়েছিল ৯৩১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। ব্যয় হয়েছিল ১ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। লোকসান হয়েছিল ৮০৩ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে আয় ছিল ৮০৪ কোটি টাকা। ব্যয় হয়েছিল ১ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। লোকসান হয়েছিল ৮৮১ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে আয় হয়েছিল ৬২৯ কোটি টাকা। ব্যয় হয়েছিল ১ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা। লোকসান হয়েছিল ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরেই রেলের লোকসান হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তার আগে ২০১০-১১ অর্থবছরে লোকসান হয়েছিল ৯৫৮ কোটি টাকা। এই লোকসান কমাতে ২০১২ সালের ১ অক্টোবর থেকে রেলে যাত্রী ও পণ্য পরিবহণের ভাড়া ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে কার্যকর করা হয়। এরপর অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল চালু হলে আয়-ব্যয়ের ব্যবধান বেড়ে যাবে এ যুক্তিতে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে রেলের ভাড়া আরেক দফায় ৭ থেকে ৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায় সরকার। তবে ভাড়া বাড়ানোয় আয় কিছুটা বাড়লেও শেষ পর্যন্ত লোকসান কমেনি।
যদিও লাগাতার লোকসান হলেও গত পাঁচ বছরে রেলের উন্নয়নে খরচ আরও বেড়েছে। এই সময়ে খরচ হয়েছে ৭৯ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা। আর উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৬১ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। বাকি ১৮ হাজার ৬৬ কোটি টাকা রেল পরিচালনায় খরচ করা হয়। এর বিপরীতে আয় হয়েছে ৬ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক ও পরিবহণ বিশেষজ্ঞ কাজী সাইফু নেওয়াজ বলেন, রেলের হচ্ছে লোকসান কমাতে হলে দুর্নীতি কমানোর পাশাপাশি অতিরিক্ত খরচ কমাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং আয় বৃদ্ধি করে ব্যয় সংকোচন নীতি অবলম্বন করতে হবে।
তিনি বলেন, রেলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০ টাকার কাজে ৫০ টাকা বিল করার একটি প্রবণতা রয়েছে। মেশিনারিজ ও পার্টসসহ কেনাকাটার ক্ষেত্রে ভালোভাবে অডিট করাতে হবে। কারণ কেনাকাটার ক্ষেত্রে বেশি দুর্নীতি হয়।
যাযাদি/ এস