কোটা আন্দোলনে নেতৃত্ব কারা?

প্রকাশ | ১২ জুলাই ২০২৪, ২০:৪২

যাযাদি ডেস্ক
ছবি-সংগৃহীত

ছয় বছর পর আবার দেশে একটি কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তৈরি হয়েছে। শিক্ষার্থীরা এবার ঐক্যবদ্ধ হয়েছে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নাম দিয়ে। সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে টানা এ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে তারা।

কোটা সংস্কারের এক দফা দাবিতে গড়ে ওঠা এই ছাত্র আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা দল-মত নির্বিশেষে এ আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন এবং তাদের পক্ষ থেকে ঘোষণা এসেছে দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে।

আন্দোলনরত এ সব শিক্ষার্থীদের একদফা দাবি সরকারের নির্বাহী বিভাগের কাছে। তাদের এই এক দফায় বলা হয়েছে, ‘সরকারি চাকরির সকল গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের জন্য কোটাকে ন্যায্যতার ভিত্তিতে ন্যূনতম পর্যায়ে এনে সংসদে আইন পাস করে কোটা পদ্ধতিকে সংস্কার করতে হবে।’ কিন্তু এই আন্দোলনটি সংগঠিত হচ্ছে কোন কৌশলে? আন্দোলনের নেতৃত্বেই বা কারা?

শিক্ষার্থীরা যেভাবে সংগঠিত

জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। আন্দোলনের প্রতিটি কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী। কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করে লাগাতার কর্মসূচি চলছে।

ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখা যায়, এ আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য ছাত্র-ছাত্রীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কাজে লাগিয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, আবাসিক হল ও বিভাগ ভিত্তিক নেটওয়ার্ক তৈরি করে ছাত্ররা সংগঠিত হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগের সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিজেরাই কোটাবিরোধী পোস্টার প্ল্যাকার্ড ও ব্যানার ছাপিয়ে আন্দোলনে শরিক হয়েছেন। আন্দোলনের প্রয়োজনে নিজেরাই ক্ষুদ্র তহবিল সৃষ্টি করেছেন।

ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে ক্যাম্পাসে অবস্থিত আবাসিক হলগুলোতে সমন্বয়কারীরা গণসংযোগ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আবাসিক হলগুলোতে আন্দোলনের সমর্থনে প্রচারপত্র বিলি করতেও দেখা গেছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনে প্রথম থেকেই সোচ্চার হয়েছে। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে সমন্বয় করে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে ধারাবাহিক অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করে যাচ্ছে তারা।

সরেজমিন গিয়ে জানা গেছে, ছাত্রছাত্রীদের সংগঠিত করতে গঠিত হয়েছে আহবায়ক কমিটি। আন্দোলনের প্রচারে নানা কৌশল তারা কাজে লাগিয়েছে। ক্যাম্পাসে মাইকিং, হলে হলে গণসংযোগ করা হয়েছে।

শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনে সড়ক অবরোধ এবং অবস্থান কর্মসূচির নাম দিয়েছে ‘বাংলা ব্লকেড’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে খুলনা থেকে চট্টগ্রামে, বরিশাল থেকে সিলেট, রাজশাহী-কুমিল্লাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম জানান, আন্দোলন পরিচালনা এবং কর্মসূচি জানাতে এবং সমন্বয় করতে অনলাইনে মিটিং এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গ্রæপের মাধ্যমে যোগাযোগ হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘ফেইসবুকসহ অনলাইন বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা মিটিং করছি এবং একসঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করছি। যারা ঢাকায় কর্মসূচি পালন করছে তাদের সঙ্গে সরাসরি বৈঠক করে আমরা বিভিন্ন পয়েন্টগুলো ভাগ করে দিচ্ছি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কোন কোন পয়েন্টে থাকবে, কোন হল কোন পয়েন্টে অবস্থান নেবে। এভাবে আমরা সমন্বয় করে আন্দোলন পরিচালনা করছি।’

ছাত্রীদের অংশগ্রহণ

কোটাবিরোধী আন্দোলনের প্রথমদিকে ছাত্রীদের উপস্থিতি কম দেখা গেলেও এখন ঢাকায় দলে দলে তাদের মিছিল সমাবেশে অংশ নিতে দেখা গেছে। মেয়েরা নারী কোটা চাই না এমন স্লোগানসংবলিত পোস্টার লিখে মিছিলে যোগ দিচ্ছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলের শিক্ষার্থী রাফিয়া রেহনুমা হৃদি এ আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক। হলের ছাত্রীদের অংশগ্রহণ কীভাবে বাড়ানো হয়েছে সে বিষয়ে তিনি বলেন, ছাত্রীদের আন্দোলনমুখী করতে তারা নানা তৎপরতা চালিয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, ‘শুরু থেকে নারী উপস্থিতি ততটা ছিল না। হলে হলে প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে যারা আসতে চায় আন্দোলনে কিন্তু বিভিন্ন বাধার কারণে আসতে পারেনি সেই বাধাগুলো পর্যালোচনা করা হয়। তাদেরকে সাহস দেওয়া হয়। হলের গ্রুপগুলোতে আন্দোলনের কর্মসূচি এবং কখন বের হতে হবে এগুলো যখন জানিয়ে দেওয়া হয়েছে তখন নারী শিক্ষার্থীরা স্বপ্রণোদিত হয়ে সেখানে অংশগ্রহণ করছেন।’

আন্দোলনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সংগঠক ফারহানা বিনতে জিগার জানান, জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে আবাসিক হলগুলোতে নারী প্রতিনিধিরা কাজ করেছেন। লাইব্রেরিতে আন্দোলনের ইস্যু এবং যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা এবং প্রচার করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শহর থেকে দূরে। এখানে শুধুই আমরা আছি। আমরা যতটা সম্ভব ওয়ার্ড অফ মাউথ দিয়ে ডাকার চেষ্টা করছি। মাইকিং করছি। প্রতিনিয়ত কর্মসূচি রাখছি। অবরোধ করে অবরোধ দেখেও অনেকে আমাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে কারা?

‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে এবার আন্দোলনে একক কাউকে মুখপাত্র নির্বাচন করা হয়নি। সারাদেশে আন্দোলনকে সুসংগঠিত করতে ৬৫ সদস্যের একটি সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়েছে। যেখানে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩ জন সমন্বয়ক রয়েছেন।

কমিটির এক নম্বর সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা কোনো একক নেতৃত্ব, একক মুখপাত্র রাখিনি। আমাদের এখানে যারা সমন্বয়ক আছেন তারা যে কেউ যে কোনো সময় সামনে আসতে পারেন, কথা বলতে পারেন। এখানে কোনো একক নেতৃত্ব নেই আসলে।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয় করছেন আরিফ সোহেল। তিনি এবার কোটা সংস্কার আন্দোলনে কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের একজন।

তিনি বলেন, ‘এইবার একটু সচেতন আমরা, এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা কিছু ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্ব আমরা পজিটিভলি দেখছি না। আমরা চাচ্ছি খুবই স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে আন্দোলনটি একটি গণতান্ত্রিক চরিত্র রেখেই তৈরি হোক, যেহেতু এটা একটা গণতান্ত্রিক দাবি এবং সারাদেশের জনগণের দাবি।’

কোটা আন্দোলনের সমন্বয় কমিটিতে যারা আছেন তাদের মধ্যে আঠারো সালের কোটাবিরোধী আন্দোলনের অভিজ্ঞতাসম্পন্নরা জায়গা পেয়েছেন। সমন্বয়কারীদের অনেকেই আছেন যারা ছাত্ররাজনীতি করেছেন কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের সদস্য।

আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে থাকা এবং কমিটির এক নম্বর সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকে বেরিয়ে গঠিত গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তির কেন্দ্রীয় নেতা। দুই নম্বর সমন্বয়ক সারজিদ আলম ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্যানেলে নির্বাচিত হল সংসদের সদস্য ছিলেন। এছাড়া কমিটিতে সমন্বয়ক হিসেবে রয়েছেন বাম ছাত্র সংগঠনের কর্মীও।

বিতর্ক এড়ানোর চেষ্টা

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা দাবি করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোনো সরকার বিরোধী রাজনীতির প্ল্যাটফরম না এবং এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে।

সমন্বয় কমিটি তৈরি থেকে শুরু করে কর্মসূচি দেওয়া এবং কারো কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার ক্ষেত্রেও বাড়তি সতর্কতা রয়েছে বলে জানান সমন্বয়কারীরা। অতীতের কোটা আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে তারা বেশ কিছু সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছেন।
প্রথমত কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের কাউকে রাখা হয়নি। এমনকি এ আন্দোলনে কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের সুযোগ যেন কেউ না পায় সেটি নিশ্চিত করতেও ছাত্ররা সচেতন বলে জানান।
অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, যেহেতু সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলন এখানে বিভিন্ন মতাদর্শের যে কেউ অংশগ্রহণ করতে পারে। তবে কোনো রাজনৈতিক স্বার্থে এ আন্দোলন ব্যবহার করার সুযোগ নেই।

তিনি আরও বলেন, ‘কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যানারে এসে সেটির পরিচয় দেওয়ার কিংবা ব্যবহার করার সুযোগ নেই, কিংবা ওই রাজনৈতিক দলের যে এজেন্ডা সেগুলো তুলে ধরার, প্রকাশ করার কোনো সুযোগ নেই। এবং যেদিন আমাদের আন্দোলন শেষ হবে আমাদের এই যে ব্যানার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সেদিন থেকে সেটির ব্যবহার শেষ হয়ে যাবে।’

বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে এমন কাউকে আন্দোলনের সমন্বয় কমিটিতে রাখা হয়নি বলেও জানান সারজিস আলম। তিনি বলেন, ‘আমাদের একটা পলিসি ছিল যারা আসলে পরিচিত ফেইস এবং যাদের আসলে রাজনৈতিক বিতর্ক আছে তাদেরকে আমরা এই প্ল্যাটফরমের সামনে রাখিনি।’ 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয় কমিটিতে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি বা জামায়াতের ছাত্র সংগঠনের কোনো প্রতিনিধি রাখা হয়নি বলেও জানান সমন্বয়করা।

দেশে এবার কোটা আন্দোলনের সূচনা হয় ৫ই জুন হাইকোর্ট ২০১৮ সালের সরকারি পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের রায় দেওয়ার পর। ২০১৮ সালে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধাসহ সবরকম কোটা পদ্ধতি বাতিল করে একটি পরিপত্র জারি করেছিল সরকার।

শুরুতে কোটা বাতিলের পরিপত্র বহালসহ চার দফা দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদমুখর হয়। জুলাই মাসের শুরু থেকে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ডাক দিয়ে লাগাতার আন্দোলনে যায় ছাত্ররা। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে কোটা নিয়ে আদালতের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত এমন বক্তব্য আসার পর ছাত্র আন্দোলন একদফার আন্দোলনে রূপ নেয়। আদালত নয় বরং সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে সরকারি চাকরির সব ক্যাডারে কোটা সংস্কারের দাবি করছেন এই শিক্ষার্থীরা।

আন্দোলনকারীরা বলছেন, বাংলাদেশে কোটা ব্যবস্থায় ত্রুটির কারণেই আরেকটি ছাত্র আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছে এবং এর একটি স্থায়ী সমাধান দরকার। আর এবার ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে কোটা ব্যবস্থার চূড়ান্ত সংস্কার নিশ্চিত করতে চান এই শিক্ষার্থীরা।

সূত্র : বিবিসি বাংলা

যাযাদি/ এসএম