রাজধানী ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থার ক্রমেই অবনতি ঘটছে। বাস-মিনিবাসসহ বিভিন্ন গণপরিবহণে ৩০ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগছে। তীব্র যানজটে আটকা পড়ে কখনো এ সময় আড়াই থেকে তিন ঘণ্টায়ও গিয়ে ঠেকছে। এ ভোগান্তিতে নগরবাসীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। করোনা মহামারির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে মানুষ প্রাণপণে কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করলেও যানজটের ফাঁদে অনেক ক্ষেত্রেই সে উদ্যোগ ভেস্তে যাচ্ছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণায় বলা হয়, সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছাড়া যে কোনো কর্মদিবসে ঢাকায় গড় ট্রাফিকের গতি প্রতি ঘণ্টায় ৬.৪ কিলোমিটার। যা পায়ে হাঁটার গতির চেয়ে সামান্য কিছু বেশি। অথচ মাত্র ১২ বছর আগেও শহরে মোটর গাড়ির গড় গতি ছিল প্রায় ২১ কিলোমিটার। পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যদি বর্তমান গতিতে যানবাহনের সংখ্যা বাড়তে থাকে, তাহলে ২০৩৫ সাল নাগাদ তা ৪ দশমিক ৭ কিলোমিটারে নেমে যেতে পারে। অথচ ঢাকায় যানজট নিরসনে গত এক দশকে সরকার প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে। বুয়েটের গবেষণায় আরও বলা হয়, রাজধানী ঢাকার যানজট ৬০ শতাংশ কমাতে পারলে দেশের উৎপাদনশীলতার দিক থেকে বছরে ২২ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হতো। প্রকল্পগুলো যথাসময়ে সম্পন্ন হলে অবকাঠামোতে সরকারের বিপুল বিনিয়োগের ফল আরও ভালো পাওয়া যেত। গত এক দশকে মেট্রো রেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো নতুন পরিকাঠামোতে যে কাজ শুরু হয়েছে, তা থেকে যে সুবিধাগুলো পাওয়া যাবে তা আগামী বছরের শুরু থেকে পরবর্তী দশকে আসবে। নগর পরিকল্পনাবিদরা জানান, বর্তমান ভারী যানজটের একটি অংশ মেট্রো রেল ব্যবস্থা নির্মাণের জন্য দায়ী। এর কারণে অনেক রাস্তা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। আবার কোনো কোনো রাস্তা আংশিকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ট্রাফিক ব্যবস্থা পরিচালনায় সরকারের ব্যর্থতা, প্রয়োজনের তুলনায় রাস্তা কম, ১৫ ভাগ যাত্রীর দখলে ৭০ ভাগ সড়ক, ঢাকার বাস-মিনিবাসগুলোর বেপরোয়া চলাচল ও যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি তীব্র যানজটের কয়েকটি অন্যতম কারণ। পাশাপাশি ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ি পার্কিং, শহরের মধ্যে রেল ক্রসিং, ভিআইপি মুভমেন্ট, একই রাস্তায় ঠেলাগাড়ি-বাস চলাচল এবং চালকদের আইন না মানার প্রবণতায় যানজট পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ করে তুলছে। সাপ্তাহিক কর্মদিবসের দ্বিতীয় দিন সোমবার সাড়ে ৩টায় গুগল ম্যাপে ঢাকার রাজপথের স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নগরীর বেশির ভাগ রাস্তা যানবাহনে ঠাসা। উত্তরা থেকে গুলিস্তান জিরো পয়েন্টের দূরত্ব ২২ কিলোমিটার। এই দূরত্বের রাস্তা পাড়ি দিতে বাস-মিনিবাসের যাত্রীদের সময় লাগছে নূ্যনতম দেড় ঘণ্টা থেকে ১ ঘণ্টা ৫২ মিনিট। একই সময় গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ড থেকে পুরানো ঢাকার চকবাজার পর্যন্ত ২.৯ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করতে ৩২ থেকে ৩৭ মিনিট সময় লাগছে। মতিঝিল থেকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত দূরত্ব ৯ দশমিক ২ কিলোমিটার। এ রাস্তা পাড়ি দিতে নূ্যনতম ৫৩ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা ৫ মিনিট সময় লাগছে। সেগুনবাগিচা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত মাত্র ৪.২ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করতে সময় লাগছে ৩৭ মিনিট থেকে ৪৬ মিনিট। বাড্ডা থেকে যাত্রাবাড়ী বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত ৯.৮ কিলোমিটার রাস্তায় সময় লেগেছে ৫১ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা ৫ মিনিট। মালিবাগ থেকে সদরঘাট পর্যন্ত ৮.৮ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করতে ৪৫ মিনিট থেকে ৫৭ মিনিট সময় লেগেছে। ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের সহকারী কমিশনার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তার দাবি, এ সময়টুকু অফ-পিক আওয়ার হিসাবেই ধরে নেওয়া যায়। বিকালের পিক-আওয়ার শুরু হয় সাড়ে ৪টা থেকে ৫টায়। সাধারণত অফপিক-আওয়ারে গণপরিবহণ চলাচলে যে সময় লাগে, পিক-আওয়ারে তার চেয়ে প্রায় দেড়গুণ সময় বেশি ব্যয় হয়। নগরীতে রাজনৈতিক দল কিংবা সংগঠনের কোনো কর্মসূচি থাকলে এ সময় আরও কিছুটা বাড়ে। ট্রাফিক পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও জানান, মাঝেমধ্যেই মহানগরীর বিভিন্ন ব্যস্ততম সড়কে এমন জট লেগে যায় তা নিয়ন্ত্রণে আনতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। নগরীর বেশির ভাগ সড়কের সঙ্গেই ইন্টারলিংক থাকায় এর প্রভাব সবখানে ছড়িয়ে পড়ে। গণপরিবহণ শ্রমিকদের দাবি, অপ্রশস্ত রাস্তা, যত্রতত্র পার্কিং, ফুটপাতের সঙ্গে রাস্তার একাংশ হকারদের দখলে থাকার জন্য সব সময় ছোটখাটো বিশৃঙ্খলা লেগে থাকলেও শহরের একই রাস্তায় দ্রম্নতগামী যানবাহনের সঙ্গে ধীরগতির যানবাহন চলাচল করায় বড় ধরনের যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। আবাবিল পরিবহণের চালক মোজ্জামেল হোসেন বলেন, সিগন্যালে গাড়ি থামলেই আশপাশ থেকে ভ্যান-রিকশা-ঠেলাগাড়ি সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। গ্রিন সিগন্যাল জ্বলে ওঠার পর এ সব ধীরগতির গাড়ির সামান্য সামনে এগোতেই এক-দেড় মিনিট সময় লাগছে। এতে দ্রম্নতগামী যানবাহনগুলোর সময় অপচয় হচ্ছে। অনেক সময় ধীরগতির গাড়ি রাস্তা পার হতেই গ্রিন সিগন্যাল নিভে রেড সিগন্যাল জ্বলে উঠছে। একই সড়কে ধীর ও দ্রম্নতগতির গাড়ি চলাচল বন্ধ না হলে নগরীর যানজট কোনোভাবেই কমবে না বলে মনে করেন এই বাসচালক। অন্যদিকে কার, মাইক্রোবাস ও জিপসহ ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ির আধিক্যও যানজটের কারণ বলে মনে করেন নগর বিশেষজ্ঞরা। তাদের দাবি, গণপরিবহণের সংখ্যা না বাড়িয়ে এ হারে ব্যক্তিগত যানবাহনের সংখ্যা বাড়তে থাকলে আগামীতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট পস্ন্যানের (এসটিপি) হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরীতে চলাচলকারী মাত্র ১৫ ভাগ যাত্রী দখল করে আছে মোট সড়কের ৭০ ভাগ। বর্তমানে ঢাকায় কম-বেশি ১৫ ভাগ যাত্রী প্রাইভেট গাড়িতে যাতায়াত করেন। এই প্রাইভেট কারের দখলে ৭০ ভাগেরও বেশি রাস্তা। বাকি ৮৫ ভাগ যাত্রী অন্য কোনো ধরনের পরিবহণ ব্যবহার করেন। অর্থাৎ তাদের বহনকারী গণপরিবহণ সড়কের মাত্র ৩০ ভাগ এলাকা ব্যবহারের সুযোগ পান।? রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি বা বিআরটিএর হিসাব অনুয়ায়ী, বর্তমানে ঢাকায় ৯ লাখ ১৩ হাজার ৬২২টি নিবন্ধিত মোটরযান রয়েছে। এর মধ্যে বাস ২৩ হাজার ১১৯টি এবং মিনিবাস ১০ হাজার ৭টি। অন্যদিকে প্রাইভেট কার রয়েছে ২ লাখ ১৬ হাজার ৭২২টি। ঢাকা মহানগরীতে বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় পৌনে দুই কোটি। এর অর্থ, জনসংখ্যার হিসাবে শতকরা এক ভাগেরও কম মানুষের প্রাইভেট কার রয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ সড়ক চলে গেছে প্রাইভেট কারের দখলে। গণপরিবহণে চলাচলকারী যাত্রীদের অভিযোগ, যানজটের কারণে পিক-আওয়ারে তারা প্রায়ই গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছেন না। এ কারণে অনেককে প্রায়ই কর্মক্ষেত্রে জবাবদিহি করতে হচ্ছে। তীব্র যানজটের কারণে কখনো কখনো কর্মস্থলে পৌঁছতে এক-দেড় ঘণ্টা দেরি হওয়ায় অনেকে চাকরিচু্যত হয়েছেন- এমন নজিরও রয়েছে। ভুক্তভোগীদের দাবি, করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে আসার পর থেকে ঢাকা মহানগরীতে যানজট পরিস্থিতি এতটাই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে, যারা অফিসে চাকরির পাশাপাশি ছোটখাটো ব্যবসা-বাণিজ্য করেন- তাদের তা গুটিয়ে নিতে হয়েছে। গণপরিবহণে নির্ধারিত সময় গন্তব্যে পৌঁছানোর নিশ্চয়তা না থাকায় অনেকে পায়ে হেঁটে কর্মস্থলে আসা-যাওয়া করছেন। শামীম আহম্মেদ নামের একজন গণমাধ্যমকর্মী জানান, তার খিলগাঁওয়ের বাসা থেকে বাসে মহাখালী এলাকার কর্মস্থলে পৌঁছতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগে। অথচ তিনি পায়ে হেঁটে অনায়াসে ৪০ থেকে ৫০ মিনিটে অফিসে পৌঁছাতে পারেন। তাই বিশেষ কোনো সমস্যা না থাকলে তিনি পায়ে হেঁটেই অফিসে যাতায়াত করেন। রামপুরার বাসিন্দা শামছুন নাহার জানান, তিনি তার মেয়েকে সপ্তাহে ৫ দিন শান্তিনগর উদ্ভাস কোচিং সেন্টারে ক্লাস করাতে নিয়ে যান। বাসা থেকে শান্তিনগর পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার রাস্তা বাসে যেতে তার ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট সময় লাগে। অথচ তিনি ৪০ মিনিটে হেঁটে অনায়াসে সেখানে পৌঁছাতে পারেন। পরিবহণ বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ঢাকার যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। তা না হলে এলোমেলোভাবে যে পদক্ষেপ নেওয়াই হোক না কেন এই সংকটময় সময় তা কাজে লাগবে না। এ প্রসঙ্গে ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটির সাবেক চেয়ারম্যান এবং আন্তর্জাতিক ট্রান্সপোর্ট বিশেষজ্ঞ ডক্টর এস এম সালেহউদ্দিন বলেন, 'রাজধানীর যানজট বা ট্রাফিক সমস্যাটা তলাবিহীন ঝুড়ির মতো। এখানে যা-ই প্রয়োগ করা হোক না কেন তা কোনো কাজে আসে না। এর প্রধান কারণ, সমস্যা সমাধানে সমন্বয়হীনতা। যে যার মতো সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন। ফলে তা কাজে না এসে উল্টো আরও সংকট সৃষ্টি করছে।