বাংলা বর্ষপঞ্জি কিভাবে এলো

প্রকাশ | ০৫ মে ২০২৪, ১১:১৬

যাযাদি ডেস্ক
বাংলার মুসলিম শাসকদের মধ্যে বাংলা বর্ষপঞ্জি তৈরির ব্যাপারে মুঘল সম্রাট আকবরের নামও শোনা যায়। ছবি : সংগৃহীত

বাংলা বর্ষপঞ্জি বা বঙ্গাব্দ হলো দক্ষিণ এশিয়ার বঙ্গ অঞ্চলে ব্যবহৃত একটি সৌর বর্ষপঞ্জি। বর্ষপঞ্জিটির একটি সংশোধিত সংস্করণ বাংলাদেশের জাতীয় ও সরকারি বর্ষপঞ্জি হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসাম রাজ্যে বর্ষপঞ্জিটির পূর্ববর্তী সংস্করণ অনুসরণ করা হয়। 

বাংলা বর্ষপঞ্জিতে নববর্ষ পহেলা বৈশাখ নামে পরিচিত। প্রাচীনকাল থেকে তদানীন্তন পদ্ধতিগুলোর স্পর্শে বাঙালির দিনলিপির গণনা সমূহ বিবর্তনের সাক্ষী হয়েছে। জুড়ে গেছে নানা অঞ্চলের নানা রীতি। জীবনের বিশেষ দিবসগুলোর হিসাব রাখার তাগিদে ভিন্ন রূপ পেয়েছে বাংলা পঞ্জিকা।

কিন্তু এর শুরুটা কোথায়, কীভাবে এলো বাংলা ক্যালেন্ডার! চলুন, বিবর্তনের সময়রেখা থেকে খুঁজে নেওয়া যাক সেই বাংলা বর্ষপঞ্জির ইতিহাস।

বাংলা বর্ষপঞ্জি ধারণার প্রাচীনতম বিকাশ

জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ করার জন্য সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ছিল স্বতন্ত্র বর্ষপঞ্জি পদ্ধতি। তাদের ছয়টি বেদাঙ্গের একটির নাম ছিল জ্যোতিষ। এই শাস্ত্র মতে বৈদিক প্রথাগত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা হতো।

রাজা বিক্রমাদিত্য প্রবর্তিত বিক্রমীয় বর্ষ পঞ্জিকা চালু হয়েছিল ৫৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে। বিক্রমাদিত্য নামের এই ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হতো ভারত ও নেপালের বিভিন্ন রাজ্যের গ্রামগুলোতে।

একদম প্রথম দিকে হিন্দু পণ্ডিতদের মধ্যে সময় গণনার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ পদ্ধতি ছিল চাঁদ-সূর্য ও গ্রহ পর্যবেক্ষণ। সংস্কৃতের জ্যোতির্বিদ্যার বিভিন্ন গ্রন্থে এর নিদর্শন পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- পঞ্চম শতাব্দীতে আর্যভট্টের আর্যভট্টিয়া, ষষ্ঠ শতকে লতাদেবের রোমাক ও বরাহমিহিরের পঞ্চ সিদ্ধান্তিক, সপ্তম শতাব্দীতে ব্রহ্মগুপ্তের খন্ডখ্যাদ্যাক এবং অষ্টম শতাব্দীতে সিদ্ধাধিশ্যাক।

পৃথকভাবে বাংলা ভাষায় ক্যালেন্ডারের ধারণাটির সূত্রপাত ঘটেছিল সপ্তম শতাব্দীর হিন্দু রাজা শশাঙ্কের শাসনামলে। প্রাচীন নিদর্শন স্বরূপ দুটি শিব মন্দিরে পাওয়া যায় “বঙ্গাব্দ” শব্দটি, যার শাব্দিক অর্থ “বাংলা সন”। মন্দির দুটির বয়স মুঘল আমলের থেকেও বহু শতাব্দীর পুরনো।

দশম শতাব্দীর মাঝামাঝিতে সম্পন্ন হয়েছিল সূর্যসিদ্ধান্ত গ্রন্থটি। এটি গ্রহ-নক্ষত্রের মাধ্যমে সময় গণনা পদ্ধতির গ্রন্থগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী। এই সংস্কৃত গ্রন্থে লিপিবদ্ধ পদ্ধতি এখনও অনুসরণ করা হয় পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও ঝাড়খণ্ডের মতো ভারতীয় রাজ্যগুলোতে।

এই সূর্যসিদ্ধান্তেই সর্বপ্রথম বাংলা বছরের প্রথম মাস হিসেবে বৈশাখ শব্দটি উল্লেখ করা হয়।

অবশ্য ত্রয়োদশ শতাব্দীর আগে বাংলার রাজবংশগুলোর মধ্যে দেখা যায় বিক্রমাদিত্যের ব্যবহার। পালদের শাসনামলে বৌদ্ধ গ্রন্থ ও শিলালিপিতে পাওয়া যায় আশ্বিন ও বিক্রম নামের মাসগুলো।

বর্তমান বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রবর্তন

বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের রাজত্বকাল ছিল ১৪৯৪ থেকে ১৫১৯ সাল পর্যন্ত। বাংলার মুসলিম শাসকদের মধ্যে বাংলা বর্ষপঞ্জি তৈরির ব্যাপারে মুঘল সম্রাট আকবরের পাশাপাশি তার নামটিও শোনা যায়।

হিজরি অনুসারে বাঙালিদের থেকে ভ‚মি কর আদায়ের রীতিটি ছিল মুঘল শাসনামলেও। চান্দ্র বর্ষপঞ্জি ও সৌর কৃষি চক্রের মাঝে বেশ অসঙ্গতি ছিল। মুঘল সম্রাট আকবর ফসল কাটার কর বছরের সমস্যা সমাধানের জোর তাগিদ অনুভব করেন। তিনি চান্দ্র বর্ষপঞ্জি ও সৌর বর্ষপঞ্জির সমন্বয়ে নতুন বর্ষ পঞ্জিকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। এই কাজের দায়িত্ব অর্পণ করা হয় রাজ্যের প্রধান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতুল্লাহ শিরাজির ওপর।

নতুন নির্মিত পঞ্জিকার নাম ছিল তারিখ-ই-ইলাহি। এখানে জুলাই থেকে পরবর্তী বছরের জুন মাস পর্যন্ত ১২ বছরের সময়ের নাম দেওয়া হয় ফসলি সন। আর এরই ভিত্তিতে তারিখ-ই-ইলাহিকে ফসলি বর্ষপঞ্জিও বলা হতো।

পরে মুঘল গভর্নর নবাব মুর্শিদ কুলি খান সম্রাট আকবরের এই নীতি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন পুণ্যাহের হিসাব পরিচালনার জন্য। পুণ্যাহ হচ্ছে প্রজাদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভ‚মি কর আদায়ের দিন।

এখানে চান্দ্র ও সৌর বর্ষপঞ্জির সংমিশ্রণটি আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ও আকবরের মধ্যে আসলে কে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন- তা নিয়ে বেশ দ্বিমত আছে। অবশ্য আকবরের মুঘল দরবার ছাড়া ভারতের অন্যত্র এই পদ্ধতি তেমন একটা ব্যবহৃত হয়নি। এমনকি তার মৃত্যুর পর বর্ষপঞ্জিটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়।

মাসের দিনগুলোর প্রতিটির আলাদা আলাদা নাম ছিল তারিখ-ই-ইলাহি’র একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। মাসগুলোর নামও ছিল বর্তমান নাম থেকে ভিন্ন।

আকবরের নাতি শাহজাহান গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারের মতো রবিবার থেকে সপ্তাহ শুরুর প্রক্রিয়াটি প্রচলন করেন। এ সময় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সংস্কার আসে তারিখ-ই-ইলাহিতে। সৌরচান্দ্রিক বা শক বর্ষপঞ্জির মাসের নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এখানকার মাসগুলোর নামে পরিবর্তন আনা হয়। শক পঞ্জি মূলত সৌর ও চান্দ্র বর্ষপঞ্জির সমন্বিত রূপ, যার প্রতিটি বছরকে বলা হয় শক সাল বা শকাব্দ।

প্রতিটি দিনের ভিন্ন নামের বদলে গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারের মতো শুধুমাত্র সাত দিনের সপ্তাহ ঠিক করা হয়। আর এটিই হচ্ছে বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যবহৃত বাংলা ক্যালেন্ডারের মূল ভিত্তি।

সময়ের সঙ্গে বাংলা বর্ষপঞ্জির বিবর্তন

১৯৫৭ সালের ২২ মার্চ ভারতে নতুনভাবে সংস্কার করা জাতীয় বর্ষপঞ্জির প্রচলন হয়। বিভিন্ন রাজ্যসহ কেন্দ্রের সর্বত্রে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীর সঙ্গে এটি ব্যবহার করা হতে থাকে। এতে সূর্য সিদ্ধান্ত-এর নিরয়ণ বর্ষ গণনা রীতির বদলে আনা হয় সায়ন সৌর পদ্ধতি এবং প্রতিটি মাসের দৈর্ঘ্য স্থির রাখা হয়। সেই সঙ্গে জ্যোতি পদার্থবিদ্যার ভিত্তিতে রাখা হয় কিছু প্রস্তাবনা।

সেগুলো ছিল- বৈশাখ থেকে ভাদ্র প্রথম পাঁচ মাসের জন্য ৩১ দিন করার। পরবর্তী সাত মাস, তথা- আশ্বিন থেকে চৈত্র মাসের জন্য ৩০ দিন করার এবং লিপ-ইয়ার বা অধিবর্ষের বেলায় ৩১ দিনে চৈত্র মাস গণনার।

প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়িত না হওয়ায় এগুলোর ভিত্তিতেই নতুন আরেকটি প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। সেখানে ১৪ এপ্রিলকে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন নির্ধারণ করার কথা উল্লেখ ছিল।

বাংলাদেশে বাংলা ক্যালেন্ডার সংস্কার

১৯৬৩ সালে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত শহীদুল্লাহ কমিটির পক্ষ থেকে রাত ১২টার পর থেকে তারিখ পরিবর্তনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এর আগে নতুন তারিখ হিসাব করা হতো সূর্যোদয়ের সঙ্গে। প্রস্তাবটি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশ কর্তৃক গৃহীত হয় ১৯৮৭ সালে। সে অনুসারে ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে নির্দেশনাও দেওয়া হয় বাংলা দিনপঞ্জিকা বানানোর। কিন্তু কিছু জটিলতার কারণে তা বাধাগ্রস্ত হয়।

বাংলা ক্যালেন্ডারকে আরও বিজ্ঞানভিত্তিক করার উদ্দেশ্যে ১৯৯৫ সালের ২৬ জুলাই একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। ভাষা, গণিতজ্ঞ, পদার্থবিজ্ঞানী ও বিভিন্ন সংস্কৃতিজনদের এই কমিটির প্রধান ছিলেন বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক হারুন-উর-রশিদ। এই কমিটির পক্ষ থেকে আরও ২০টি প্রস্তাবনা দেওয়া হয়।

এগুলোর মধ্যে একটি ছিল চৈত্রের বদলে ফাল্গুন মাসকে লিপ-ইয়ারের মাস হিসেবে ঠিক করা। সেখানে উল্লেখ ছিল যে, গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারে লিপ-ইয়ারের ফেব্রুয়ারি মাসকে অনুসরণ করে বাংলা বর্ষ পঞ্জিকার ফাল্গুন মাসে ৩০ দিনের জায়গায় হবে ৩১ দিন।

এতে দেখা যায়- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২১ ফেব্রæয়ারি ১৯৫২ সালে ৮ ফাল্গুন হলেও, ২০১৫ সালে তা হয়ে যাচ্ছে ৯ ফাল্গুন। এছাড়া আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিবস নিয়ে অসমাঞ্জস্যতা ধরা পড়ে। ফলে জাতীয় দিবসগুলোকে ঠিক করার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে তৃতীয়বারের মতো গঠিত হয় আরও একটি কমিটি। এখানে সভাপতি হিসেবে ছিলেন বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান।

কমিটির অন্যরা ছিলেন- একাডেমির পরিচালক অপরেশ কুমার ব্যানার্জি, পদার্থবিজ্ঞানী জামিল চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক অজয় রায়, অধ্যাপক আলী আসগর।

তাদের প্রস্তাব ছিল-

* প্রথম ছয় মাস; তথা- বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাস হবে ৩১ দিনে।

* কার্তিক থেকে মাঘ এবং চৈত্র এই পাঁচ মাস হবে ৩০ দিনে।

* শুধু ফাল্গুন মাস গণনা হবে ২৯ দিনে।

* অধিবর্ষের বছরে ফাল্গুন মাসে একদিন যোগ করে গণনা করা হবে ৩০ দিনে।

এই প্রস্তাবটি চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়ে সে অনুসারে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে তৈরি হয় সরকারি বর্ষপঞ্জি। আর এটিই বর্তমানে চালু আছে বাংলা বর্ষপঞ্জি হিসেবে।

পরিশিষ্ট

দেয়ালে ঝুলানো কাগুজে দিনপঞ্জির প্রতিটি সংখ্যা ও শব্দ মনে করিয়ে দেয় বাংলা বর্ষপঞ্জির ইতিহাস ও স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা। দিনলিপি গণনার এই ইতিবৃত্ত জানিয়ে দিল যে, ওগুলো নিজেরাই এক সমৃদ্ধ ইতিহাসের ধারক। ভারতের ত্রিপুরা, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে এখনও অনুসরণ করা হয় পুরনো বাংলা বর্ষপঞ্জি পদ্ধতি। যুগে যুগে ভিন্ন নাম পেলেও বাঙালি সম্প্রদায়ে সরব ছিল বাংলা বছর, মাস ও দিনের ধারণা। এর প্রভাব এখনও অটুট আছে ধর্মীয়, সামাজিক ও জাতীয় আনুষ্ঠানিকতায়। দিন ও সপ্তাহ সর্বস্ব বৈশাখ থেকে চৈত্র মাস এখন দ্বিধাহীন সময় হিসেবের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম।

যাযাদি/ এসএম