আদালত বিচারক ও আইনজীবীদের নিরাপত্তা জোরদার

বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি

প্রকাশ | ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৩০

গাফফার খান চৌধুরী
ফাইল ছবি

সারাদেশের আদালত, বিচারক ও আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাড়তি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ বিশেষ বিশেষ আদালতের প্রবেশ পথে বসানো হচ্ছে আর্চওয়ে মেটাল ডিটেক্টর। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। আদালত ও বিচারকদের বাসভবনের আশপাশের এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাড়তি চেকপোস্ট বসছে। সেই সঙ্গে সীমান্তে টহল ব্যবস্থা জোরদার করেছে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ)। প্রস্তুত রয়েছে বাহিনীটি। 

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, গত ২৭ নভেম্বর চট্টগ্রাম আদালতে আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা ঘটে। পরদিন ২৮ নভেম্বর ঢাকায় হাইকোর্টের বিচারপতি মহম্মদ আশরাফুল কামালকে এজলাসেই ডিম ছুঁড়ে মারেন একদল আইনজীবী। ঘটনা দুটি সারাদেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। প্রশ্ন ওঠেছে, আদালত-সংশ্নিষ্টদের নিরাপত্তা নিয়ে। এমন ঘটনার পর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ দেশের সব আদালত, বিচারক ও আইনজীবীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন।  

সূত্র বলছে, প্রধান বিচারপতির নির্দেশনার পর সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্টার জেনারেল ড. আজিজ আহমেদ ভ‚ঞা স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে দেশের সব আদালত, বিচারক ও আইনজীবীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিচার প্রশাসনের সব বিভাগ এবং সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়।   

জানা গেছে, এমন নির্দেশনার পর দেশের সব আদালত ও বিচারক এবং আইনজীবীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আদালত প্রাঙ্গণের আশপাশে বাড়তি চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। একই ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বিচারকদের সরকারি ও বেসরকারি বাসভবন ঘিরে। যেসব বাসভবনে সিসি ক্যামেরা নেই, সেখানে নতুন করে সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। আর সরকারি বাসভবনে থাকা সিসি ক্যামেরা সচল আছে কিনা, সেটা সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, যেসব ক্যামেরা নষ্ট ছিল, সেটা সরিয়ে নতুন ক্যামেরা বসানো হয়েছে। আর যেসব পুরনো ক্যামেরায় ছবি অস্পষ্ট বা ঘোলা আসতো, সেসব ক্যামেরা সরিয়ে নতুন ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। ক্যামেরাগুলো ২৪ ঘণ্টা মনিটরিং করা হচ্ছে। বাসভবনের আশপাশেও বাড়তি চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি কার্যক্রম চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এসব স্থাপনায় বাড়তি ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারিও। 

সূত্র বলছে, ইতোমধ্যেই ঢাকা বার কাউন্সিল থেকে আইনজীবীদের নাম-ঠিকানা যোগাড় করা হয়েছে। এ ছাড়া দেশের মেট্রোপলিটন বার অ্যাসোসিয়েশন থেকেও সংগ্রহ করা হয়েছে আইনজীবীদের নামীয় তালিকা। আর জেলা আদালত থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে আইনজীবীদের তালিকা। আইনজীবীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কয়েক ধাপে নিরাপত্তা সাজানো হয়েছে। যেসব আইনজীবীরা রাজনৈতিক ও স্পর্শকাতর মামলার পক্ষে বা বিপক্ষে আইনি লড়াই করেন, তাদের নিরাপত্তা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া কোনো আইনজীবী যদি মনে করেন, তিনি নানা কারণে অনিরাপদ বোধ করছেন, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে লিখিত বা মৌখিকভাবে জানাতে বলা হয়েছে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। 

সূত্রটি বলছে, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট ছাড়াও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থাকবে বিশেষ নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে। হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রবেশ পথে আর্চওয়ে মেটাল ডিটেক্টর বসছে। ইতোমধ্যেই দেশের প্রায় সব আদালতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাড়তি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগের আদালতগুলো থাকছে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে। এসব আদালতের চারদিকে উঁচু ভবনে বসানো হয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। সেখান থেকে শক্তিশালী বাইন্যুকুলার দিয়ে আদালতের ওপর নজর রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বিচারকদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াতের ক্ষেত্রে আগাম গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। যাতে করে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয় বিচার-সংশ্লিষ্টদের। 

সূত্র বলছে, সেনাবাহিনীও বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে নিরাপত্তার বিষয়টি দেখছে। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহযোগিতা করতে বিজিবিও মাঠে নামবে। বিজিবিকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সীমান্তের সব পয়েন্ট সর্তক দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে। টহল বাড়াতে কড়া নির্দেশনা দিয়েছে বিজিবি সদর দপ্তর। 

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক ও পুলিশের মুখপাত্র ইনামুল হক সাগর যায়যায়দিনকে বলেন, আদালত, বিচারক ও আইনজীবীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। আদালত প্রাঙ্গণে বাড়তি ফোর্স মোতায়েন করা হচ্ছে। গুরুত্ব বিবেচনা করে হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট ছাড়াও কোনো কোনো আদালতের প্রবেশ পথে বসছে আর্চওয়ে মেটাল ডিটেক্টর। এ ছাড়া বিচারকদের বাসভবনের সিসি ক্যামেরা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আদালত প্রাঙ্গণের আশপাশে ও বিচারকদের বাসভবনের আশপাশে বাড়তি চেকপোস্ট বসিয়ে নিরাপত্তা তল্লাশি অব্যাহত রাখতে বলা হয়েছে। পুলিশের সব ইউনিটকে ইস্যুটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সর্বোচ্চ সর্তক থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে।

প্রসঙ্গত, চলতি বছরের অক্টোবরের শেষ দিকে আট দফা দাবিতে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে সমাবেশ করে ইসকনপন্থি সনাতনী জাগরণ জোট। সমাবেশ থেকে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও নিপীড়নের বিচার, জড়িতদের গ্রেপ্তার, শাস্তি, ক্ষতিপূরণ দেওয়া ও সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন করার দাবি জানানো হয়। ওই ঘটনায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মামলা হয়। ওই মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় সন্ন্যাসী চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে। এমন ঘটনায় হিন্দু ধর্মের সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকা ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস বা আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘকে (ইসকন) নিয়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম হয়। তাকে গ্রেপ্তার করে প্রিজন ভ্যানে তোলার পর প্রায় তিন ঘণ্টা পুরো এলাকা অবরোধ করে রাখে ইসকন ও হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। ইসকনকে নিষিদ্ধ করতে আবেদন করলে হাইকোর্ট তা আমলে নেননি। 

সূত্র বলছে, ইসকন নেতা গ্রেপ্তার এবং এরই জেরে আইনজীবীকে হত্যা এবং ২০১৬ সালে বাংলাদেশের সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করার সূত্র ধরে হাইকোর্টের এক বিচারপতিকে ডিম ছুঁড়ে মারার ঘটনায় আদালত, বিচারক ও আইনজীবীদের নিরাপত্তার বিষয়টি নতুন করে সামনে আসে।  

গত ২৮ নভেম্বর গণমাধ্যমে পাঠানো বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আমিরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, শঙ্কামুক্ত পরিবেশে বিচারকার্য পরিচালনা এবং আদালত চত্বরে আইনজীবী ও জনসাধারণের স্থায়ী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিচার বিভাগের অধীন বিশেষায়িত নিরাপত্তা বাহিনী গঠন প্রয়োজন।

 বিবৃতিতে আইনজীবীর পরিবারের প্রতি শোক জানিয়ে আরও বলা হয়, গত ২১ নভেম্বর দিনাজপুর জেলা জজ আদালতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনেই উচ্ছৃখল জনতার তাণ্ডব, আদালতের কার্যক্রমে বাধা দেওয়া এবং এজলাসে নৈরাজ্য সৃষ্টি বিচার বিভাগের নিরাপত্তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। আদালতের মতো পবিত্র জায়গা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিচার বিভাগের অধীনে বিশেষায়িত বাহিনী গঠন এখন সময়ের দাবি।

যাযাদি/ এসএম