রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

চাকুরি দিতে না পেরে ৩ যুবককে হত্যা  

স্টাফ রিপোর্টার, টাঙ্গাইল
  ১৮ জুলাই ২০২৪, ১৩:৩৪
ছবি-যায়যায়দিন

টাঙ্গাইলের ঘাটাইল, গোপালপুর ও জামালপুরের তিন যুবককে সেনাবাহিনীতে চাকুরি দেওয়ার কথা বলে ২৪ লাখ টাকা নিয়েছিলেন চাকুরিচ্যূত সেনা সদস্য মো. কনক। কিন্তু কাউকে চাকুরি দিতে পারেননি। যাতে টাকা ফেরত দিতে না হয়- সেজন্য তিনজনকেই হত্যার পরিকল্পনা করেন তিনি। পরে এক সহযোগীকে নিয়ে তিনজনকেই শ^াসরোধে হত্যা করে মরদেহ গুম করেন চাকুরিচ্যূত সেনা সদস্য মো. কনক। তিনি টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার মুশুদ্দি দক্ষিণ পাড়ার তালেব আলীর ছেলে। কনক ঢাকা সেনানিবাসে সৈনিক পদে চাকুরি করতেন, পরে তাকে চাকরিচ্যূত করা হয়। তিন যুবককে হত্যার কথা স্বীকার করে বুধবার (১৭ জুলাই) বিকালে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন কনক। টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মিনহাজ উদ্দিন ফরাজি তার জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন। পরে আদালত তাকে জেল হাজতে পাঠিয়ে দেন।

হত্যার শিকার তিন যুবক হচ্ছেন- টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার রসুলপুর গ্রামের আব্দুল আজিজের ছেলে সামাদ সজীব(১৮), গোপালপুর উপজেলার মজিদপুর গ্রামের নাসিম উদ্দিনের ছেলে আতিক হাসান(১৮) এবং জামালপুর সদর উপজেলার জুনায়েদপাড়া গ্রামের ঠাণ্ডা মিয়ার ছেলে মো. রাহাদ হোসেন ওরফে উজ্জ্বল (১৮)।

নিহতদের মধ্যে সামাদ সজীবের মরদেহ গত ১ ফেব্রুয়ারি বাসাইল উপজেলার পাটখাগুড়ি গ্রামের বঙ্গবন্ধু সেতু-ঢাকা মহাসড়কের পাশের ভুট্টা ক্ষেত থেকে উদ্ধার করা হয়। আতিক হাসানের মরদেহ গত ৩ মার্চ উদ্ধার করা হয় মধুপুর গড় এলাকার একটি আনারস বাগান থেকে। এবং সর্বশেষ ১২ মার্চ রাহাত হোসেন উজ্জ্বলের মরদেহ বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব প্রান্তের সংযোগ সড়কের পাশে মীরহামজানি গ্রামের একটি বালুর স্তুপ থেকে উদ্ধার করা হয়।

তিনজনের মরদেহ উদ্ধারের পর পরিচয় না পেয়ে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করে। এতে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। পরিচয়বিহীন মরদেহ হিসেবে তাদের দাফন করে পুলিশ। তিনটি মামলারই তদন্ত করছে টাঙ্গাইল পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

এদিকে, বুধবার(১৭ জুলাই) সন্ধ্যায় টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার মো. গোলাম সবুর তার কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জানান, নিহত ওই তিন যুবককে সেনাবাহিনীতে চাকুরি দেওয়ার কথা বলে প্রত্যেকের কাছ থেকে আট লাখ টাকা করে নেন কনক। কিন্তু পরে তাদের চাকুরি দিতে পারেননি তিনি। আর ঘুষের টাকা ফেরত দেওয়ার ভয়ে ওই তিনজনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন কনক। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সজীবকে চাকুরিতে যোগদানের কথা বলে কনক গত ৩১ জানুয়ারি তার টাঙ্গাইল শহরের আটপুকুরপাড় এলাকার বাসায় নিয়ে যান। পরে একজনের সহযোগিতায় রাতে শ্বাসরোধে তাকে হত্যা করেন কনক। হত্যার পর মোটরসাইকেলে কনক ও তার সহযোগী হেলমেট পরিয়ে সজীবের মরদেহ মাঝখানে বসিয়ে মহাসড়কের পাশে একটি ভুট্টা ক্ষেতে ফেলে দেন। পরে মোটরসাইকেল থেকে পেট্রোল ঢেলে সজীবের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

পরে বাসাইল থানার পুলিশ ৪ ফেব্রুয়ারি ওই মরদেহ উদ্ধার করে। একইভাবে গত ২ মার্চ গোপালপুরের মজিদপুর গ্রামের আতিক হাসানকে চাকুরিচ্যূত সেনা সদস্য মো. কনক ও তার সহযোগী মধুপুর গড়ের পীরগাছা রাবার বাগান এলাকায় নিয়ে যান। সেখানে স্থানীয় এক পাহাড়ি ব্যক্তির বাড়িতে তারা মদ্যপান করেন। আতিক হাসান মাতাল হয়ে যান। পরে রাত সাড়ে ৮টার দিকে তাকে পার্শ্ববর্তী একটি আনারস বাগানে নিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে একইভাবে মরদেহে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পরদিন মধুপুর থানা পুলিশ অজ্ঞাত পরিচয় হিসেবে ওই মরদেহ উদ্ধার করে। পরদিন ৩ মার্চ চাকুরিতে যোগদানের জন্য উজ্জ্বলের বাবার কাছে খবর পাঠান মো. কনক। ওই দিন উজ্জ্বলের বাবা টাঙ্গাইল শহর বাইপাস এলাকায় এসে কনকের কাছে তার ছেলে উজ্জ্বলকে দিয়ে যান। পরে উজ্জ্বলকে নিজের আটপুকুরপাড় বাসায় নিয়ে গলা টিপে হত্যা করেন কনক ও তার সহযোগী। পরে মরদেহ হেলমেট পড়িয়ে মোটরসাইকেলে বসিয়ে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব প্রান্তের সংযোগ সড়কে নিয়ে যান। সেখানে রাস্তার পাশে চারলেন কাজের জন্য রাখা বালুর স্তূপের নিচে মরদেহ চাপা দিয়ে রাখেন। গত ১২ মার্চ মরদেহটি পুলিশ উদ্ধার করে।

পুলিশ সুপার জানান, তিন যুবকের খোঁজ না পেয়ে তাদের পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি সেনা কর্তৃপক্ষকে জানালে সো. কনকের চাকুরি চলে যায়। এদিকে সজীবের বাবা বাদী হয়ে কনকসহ পাঁচজনের নামে টাঙ্গাইল আদালতে একটি মামলা করেন। আদালতের নির্দেশে গত ১ জুন মামলাটি ঘাটাইল থানায় তালিকাভুক্ত করা হয়।

অপরদিকে নিহত আতিক হাসানের বাবা বাদী হয়ে কনকসহ চারজনের নামে গোপালপুর থানায় গত ২১ জুন একটি মামলা করেন। উজ্জ্বলের বাবা বাদী হয়ে কনকের নামে গত ১৪ এপ্রিল জামালপুর সদর থানায় আরও একটি মামলা করেন। ঘাটাইল থানার মামলাটি তদন্তকালে পুলিশ জানতে পারে- জামালপুর সদর থানায় দায়ের করা মামলায় কনক কিছুদিন আগে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তিনি জামালপুর কারাগারে আছেন।

ঘাটাইল থানার অফিসার ইনচার্জ(ওসি) আবু ছালাম মিয়া জানান, আদালতের মাধ্যমে আসামি কনককে ঘাটাইল থানায় সজীবের বাবার করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তার রিমান্ড চেয়ে গত মঙ্গলবার(১৬ জুলাই) আদালতে আবেদন করা হয়। আদালত দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মঙ্গলবার রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সময় কনক তিন যুবককে হত্যার কথা স্বীকার করেন। তিনি এক সহযোগীর নামও বলেন। তদন্তের স্বার্থে পুলিশ তার সহযোগীর নাম প্রকাশ থেকে বিরত থাকে।

পুলিশ সুপার মো. গোলাম সবুর জানান, পরে মো. কনক আদালতে জবানবন্দি দিতে সম্মত হন। বুধবার টাঙ্গাইলের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তাকে হাজির করা হয়। তিনি তিনটি হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে জবানবন্দি দেন।

কনকের স্বীকারোক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে পুলিশ সুপার জানান, তিনি চাকরি দেওয়ার কথা বলে যে ২৪ লাখ টাকা নিয়েছিলেন- তার মধ্যে নয় লাখ টাকা তার সহযোগীকে দিয়েছেন এবং বাকি টাকা অনলাইনে জুয়া খেলে হেরেছেন।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে