রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

আজ পবিত্র আশুরা

যাযাদি ডেস্ক
  ১৭ জুলাই ২০২৪, ০০:১৯
প্রতীকী ছবি

নীল সিয়া আসমান, লালে লাল দুনিয়া/আম্মা গো লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া/কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে/সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারের ছোরাতে..আজ ১০ মহরম। পবিত্র আশুরা। ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম হৃদয়বিদারক ও মর্মস্পর্শী ঘটনার দিন। বিশ্ব ইতিহাসেও দিনটি স্বীকৃত নির্মমতার জন্য।

ইতিহাস ছাপিয়ে কারবালার মর্মান্তিক বেদনাদায়ক ঘটনা এ দিবসকে আত্মোৎসর্গ আর ন্যায়নীতির সত্য-সুন্দর প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের চেতনায় সমুজ্জ্বল করে রেখেছে। সেই সঙ্গে অন্যায়-অনাচার-অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে দিবসটি। মুসলিম জাতির কাছে নানাবিধ কারণে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এ দিবস। বিশ্বনবী হজরত মুহম্মদ (সা.) ওফাতের বহু বছর পর ফোরাত নদীতীরে তারই প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র এবং হজরত আলী (রা.) ও মা ফাতেমার (রা.) দ্বিতীয় পুত্র হজরত ইমাম হোসেনের (রা.) শাহাদাত বরণের ঘটনা এ দিবসকে দিয়েছে নতুন মাত্রা, নতুন মর্যাদা। সৃষ্টি করেছে অনন্য ইতিহাস।

৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের মোতাবেক ৬১ হিজরির এই সেই দিবস যেদিন অপশক্তি-অন্যায়-অসত্যের কাছে মাথানত না করে সত্য-সুন্দর-ন্যায়ের পথে লড়াই করে বীরের মতো পরিবারের অনেক সদস্য ও সহচরকে নিয়ে শাহাদাতবরণ করেন হজরত ইমাম হোসেন (রা.)। সেই দুঃখময় স্মৃতি আজও বিশ্ব মুসলিমকে কাঁদায়। সেই সঙ্গে প্রেরণা জোগায় ত্যাগের মহিমায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অন্যায়-অনাচার অসত্য-অসুন্দরের বিরুদ্ধে আমরণ সংগ্রাম করার। কবির ভাষায় 'ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না'।

আশুরা নামকরণ নিয়ে ওলামাদের মধ্যে বিভিন্ন মত রয়েছে। অধিকাংশের মতে, মহরম মাসের ১০ তারিখ বিধায় এ নামকরণ। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় দশমি। কারও মতে, এ তারিখে মহান রাব্বুল আলামিন দশজন পয়গম্বরকে তার অনুগ্রহের দ্বারা ধন্য করেছেন বলেই এ নামকরণ। এদিন হজরত আদমের (আ.) তওবা কবুল হয়, মহাপস্নাবনের পর নূহ নবীর কিশতী সর্বপ্রথম মাটির সংস্পর্শ লাভ করে, হজরত ইব্রাহীম (আ.) ভূমিষ্ঠ হন, হজরত দাউদ নবীর তওবা কবুল হয়, হজরত আইয়ুব নবীর রোগ-যাতনা উপশম হয়, মুসা নবীকে আলস্নাহ উদ্ধার করেন, ইউনুছ নবীকে মাছের পেট থেকে মুক্তি দান করেন, ঈশা নবীকে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়। মহানবী (সা.) এরশাদ করেন, রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা ফরজ হিসেবে রাখা হতো। অতঃপর যখন রমজান মাসের রোজার হুকুম অবতীর্ণ হলো তখন তা নফলরূপে গণ্য হয়। রাসুলে করিম (সা.) আরও এরশাদ করেন, রমজান মাসের ফরজ রোজার পর মহরম মাসের রোজা সর্বোত্তম (মুসলিম)। তিনি আরও এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আশুরার দিন নিজ পরিবার-পরিজনের জন্য মুক্ত হাতে ব্যয় করবে, আলস্নাহ তাকে সারাবছর সচ্ছলতা দান করবেন।

বরাবরের মতো যথাযথ মর্যাদায় ধর্মীয় পরিবেশে আজ পালিত হবে পবিত্র আশুরা। নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে বের হবে বর্ণাঢ্য তাজিয়া। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা পবিত্র কোরআনখানি, ওয়াজ-মিলাদ মাহফিল, জিকির আজকার, আলোচনা সভা, নফল নামাজ, মাজার-কবর জিয়ারত, দান-খয়রাত প্রভৃতির মাধ্যমে পবিত্র দিবসটি অতিবাহিত করবেন। অনেকে একাধিক রোজা রাখবেন। দিবসটি পালনে ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংগঠন পৃথক পৃথক কর্মসূচি প্রণয়ন করেছে। পবিত্র আশুরা উপলক্ষে আজ সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীও।

আশুরার ইতিহাস: এই দিনে হজরত ইমাম হোসেন (রা.) এবং হজরত আলী (রা.)-এর পরিবারের সতেরোজন শিশু-কিশোর যুবকসহ মোট ৭৭ জন মর্দে মুজাহিদ কারবালার প্রান্তরে ফোয়াতের দু'কূল ছাপা নদীর কিনারায় এক বিন্দু পানি থেকে বঞ্চিত হয়ে শাহাদাতের পেয়ালা পান করেছিলেন। রাসুল (সা.)-এর দৌহিত্র হোসেন (রা.)-এর পবিত্র মস্তক নিষ্ঠুর নরাধম শিমার ছিন্ন করে কুফার দুরাচার ওবায়দুলস্নাহ বিন জিয়াদের দরবারে প্রেরণ করেছিল। কেন এ মহান ত্যাগ ও শাহাদাত? এটা কি ছিল এজিদের হাত থেকে খেলাফত কেড়ে নেওয়ার জন্য? তা নয়। হজরত হোসেন (রা.)-এর শিবিরে মাত্র ৪০ জন লোক ছিল তরবারি চালানোর মতো।

পক্ষান্তরে এজিদের নির্দেশে কুফার গভর্নর ৪ হাজার রণনিপুণ সৈন্য পাঠিয়েছিল। এ অসম যুদ্ধে পরাজয় ও মৃতু্য ছিল নিশ্চিত। তারপরও কেন স্বেচ্ছায় আত্মত্যাগ? কারণ, শর্ত ছিল, 'হয় এজিদের আনুগত্য স্বীকার কর, না হয় যুদ্ধ কর'। রাসুল (সা.)-এর কলিজার টুকরাসম হোসেন (রা.) একটি মুহূর্তের জন্য এ এজিদের আনুগত্য স্বীকার করে ইসলামি খেলাফতের মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করতে চাননি। পূর্বে উম্মাহর মধ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপনের জন্য একটি লিখিত চুক্তি হয়। সেখানে বলা হয়, হজরত মুয়াবিয়ার পর হজরত হোসেন (রা.) খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। কিন্তু মুয়াবিয়া তার খেলাফত পরিচালনার শেষ সময় নিজের ছেলে এজিদকে খেলাফতের দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব দেন।

এজিদ জনমতের কোনো তোয়াক্কা না করে নিজেই খেলাফতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হয়। তখন সর্বত্র বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ইসলামি খেলাফতের মর্যাদাকে ধ্বংস করে রাজতন্ত্রের সূত্রপাতকে বেশিরভাগ মুসলমান সে সময় মানতে পারেননি। যার কারণে বিদ্রোহ দানা বাঁধতে শুরু করে এজিদের বিরুদ্ধে। এজিদ তখন ভাবল, চারদিকে বিদ্রোহ দমন করার চেয়ে বরং হোসেনকে (রা.) যদি দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া যায় তাহলে সব মামলা চুকে যায়। সঙ্গে সঙ্গে নিজের নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব অনায়াসে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। ইসলামি খেলাফতে কলঙ্ক সৃষ্টিকারী এজিদ সেই হোসেন (রা.)-কে হত্যা করার পরিকল্পনা করল যিনি বেহেশতের সব যুবকের সরদার হবেন।

হুসাইনকে হত্যা করতে এজিদের নির্দেশে কুফার গভর্নর ওবায়দুলস্নাহ বিন জিয়াদের সৈন্যরা সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করল। সেদিন ছিল ১০ মহরম ৬১ হিজরি ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ, ১৯ অক্টোবর। সকালে একটি লাল সূর্যের উদয় হলো পশ্চিম আকাশে। ফজরের নামাজের পরই হজরত হোসেন (রা.) তার সাথীদের দাঁড় করালেন। মাত্র ৩২ জন ঘোড় সওয়ার ও ৪০ জন পদাতিক সৈন্য নিয়ে গঠিত তার ক্ষুদ্র বাহিনী। ডানদিকে জুহাইর বিন কাইন এবং বামদিকে হাবীব বিন মুজাইর নিজ নিজ দলের অধিনায়ক নিযুক্ত হলেন।

বাহিনীকে এভাবে সাজালেন যে পেছনে তাঁবুগুলো। আর পেছনের দিকটাকে অধিকতর নিরাপদ করার জন্য পরীখাসদৃশ গভীর গর্তগুলোয় আগুন জ্বালিয়ে দিলেন। যাতে শক্রুরা পেছন দিক থেকে আক্রমণ করতে না পারে। আর ফোরাতের পানির দখল নিজেদের জন্য নিয়ে নিলেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রারম্ভে হজরত হোসেন (রা.) একটি মর্মস্পর্শী ভাষণ দিলেন, হে জনমন্ডলী!

তাড়াহুড়ো করো না। আগে আমার কয়েকটি কথা শোনো। আমার কথা যদি তোমরা মেনে নাও এবং আমার প্রতি যদি সুবিচার করো, তাহলে তোমরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মানুষ বলে পরিগণিত হবে। তোমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করে আমার সঙ্গে যে আচরণ করতে চাও তা করে নাও। আলস্নাহই আমার একমাত্র সহায়। তিনিই তার সৎ বান্দাদের সাহায্য করে থাকেন। হজরত হুসাইনের এ কথা শুনে তার শিবিরে কান্নার রোল পড়ে গেল। তখন হোসেন (রা.) হয়তো মনে মনে বলছিলেন, এখনো তো কান্নার অনেক বাকি। যথারীতি যুদ্ধ শুরু হলো। প্রবল বীরবিক্রমে মুসলিম সৈনিকরা শাহাদাতের পেয়ালা হাতে নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রায় দুই হাজার শত্রম্ন সৈন্য খতম করে দিলেন। কিন্তু মুসলিম বাহিনী থেকেও ঝরে পড়ল অনেক তরতাজা প্রাণ। ওবায়দুলস্নাহ বিন জিয়াদের বা এজিদের বাহিনী পানির দখল নিয়ে নিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই হোসেন শিবিরে পানির জন্য হাহাকার পড়ে গেল। কাসেমকে কোলে নিয়ে শত্রম্নদের কাছে এক কাতরা পানি প্রার্থনা করলেন।

কিন্তু শিশুপুত্র আলী আকবর ও কাসেমের মৃতু্য হজরত হোসেনকে আবারও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করল। তিনি অনেক শত্রম্ন নিধন করলেন। অবশেষে একটি তীর এসে তার শরীরে বিদ্ধ হলো। সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ার পিঠ থেকে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। একটানে তীরটি বের করে ফেললেন ও শক্রদের ওপর আক্রমণ চালাতে থাকলেন। কিন্তু গন্ডদেশ থেকে রক্তক্ষরণ তাকে দুর্বল করে ফেলল। এ অবস্থায় পরপর কয়েকটি তীর বিদ্ধ হলেন হোসেন (রা.)। অবশেষে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। কাফেররা তার মস্তক কাটার জন্য ইতস্তত করতেছিল। কিন্তু নিষ্ঠুর পাষন্ড নরখাদক শিমার হজরত হোসেন (রা.)-এর মস্তক কর্তন করে খন্ডিত মস্তক নিয়ে এজিদের দরবারে পৌঁছাল। এই যুদ্ধে হজরত হোসেন (রা.)-এর ছেলে জয়নাল আবেদীন ছাড়া সবাই শাহাদাতবরণ করেন।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে