ইতিহাস ও ঐতিহ্য বহনকারী প্রবাজপুর শাহী জামে মসজিদটি বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সুন্দরবনবেষ্ঠিত সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার একটি অতি প্রাচীন মসজিদ এবং যা ১৬৯৩ সালে নির্মিত হয়। এটি একটি সংরক্ষিত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা।
বিভিন্ন সুত্র ও তথ্যানুসন্ধানে জানা যায় মসজিদটি ১১০৪ হিজরির ১৯ রমজান ২ মে ১৬৯৩ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত। সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় তার ফৌজদার নবাব নুরুল্লাহ খাঁ এ মসজিদের নামে লাখে রাজে ৫০ বিঘা জমি দান করেন।
প্রবাজপুর শাহী মসজিদটি একটি মুসলিম কীর্তি অতীত ঐতিহ্য এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন। এই মসজিদ সম্পর্কে একটি প্রচলিত কিংবদন্তি হচ্ছে জিনেরা জঙ্গল কেঁটে পরিষ্কার করে রাতারাতি নাকি মসজিদটি তৈরী করেছিল। আরো জনশ্রুতি আছে যে, এই মসজিদে এসে কেউ কোন মানত করলে তা নাকি বিফলে যেতো না।
প্রত্নতাত্ত্বিক বিশারদদের মতে, ১১০৪ হিজরিতে ২৪ মে ১৬৯৩ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেব এই এলাকায় তার রক্ষিত মুসলমান সৈন্যদের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার জন্য সুবেদার পরবাজ খাঁকে একটি মসজিদ নির্মাণ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই নির্দেশ পাওয়ার পর তিনি এই এলাকায় একটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ নির্মাণ করেন। যে গ্রামটিতে তার সৈন্যরা থাকতো সেই গ্রামটির নাম করণ তার নাম অনুসারে করা হয়েছিল প্রবাজপুর গ্রাম। পরবর্তীতে মসজিদ নির্মাণ করার পর মসজিদটির নাম করণ করা হয় তার নাম অনুসারে প্রবাজ শাহী মসজিদ। এছাড়া বিশেষজ্ঞরা মসজিদটির স্থাপত্য নিদর্শন যেমন কুডী মসজিদ (খুলনা), মসজিদ বাডী এবং বাগের হাট অঞ্চলের মুদ্রা অন্যান্য প্রমাণাদী বিশেষ করে বাঘের হাটের ৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দের (১৪৫৯) শিলালিপি এবং সুলতান বারবাগ সাহেব আমলে মসজিদ বাডতি মসজিদের ৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের (১১৬৫) শীলালিপি ইত্যাদি থেকে যে সিদ্ধান্ত এসেছেন তা হলো মসজিদ বাঘের হাট, কালিগঞ্জ উপজেলার প্রবাজপুর গ্রামসহ ভারতের হুগলী নদীর বর্তমানে ইছামতির পূর্বাঞ্চল পঞ্চদশ শতাব্দীর পূর্বে না হলেও উক্ত শতাব্দীর মধ্যভাগে মুসলিম শাসনাধীন ছিল। বিশেষজ্ঞদের এই ধারণা থেকে এবং সুবেদার প্রবাজ খাঁর নাম অনুসারে গ্রাম ও মসজিদটির নাম করণ হওয়ার কারণে একথা স্বীকৃত হয়ে আসছে যে, প্রবাজপুর শাহী মসজিদটি নির্মাতা ছিলেন সুবেদার প্রবাজ খাঁ। পরবর্তীতে মসজিদটি প্রত্বতত্ত্ব বিভাগের দৃষ্টি আনা হলে এই বিভাগ ঐতিহাসিক মসজিদটির সংস্কার কাজে হাত দেওয়া হয়।
মসজিদের বহির্ভাগস্থ আয়তাকারের আয়তন ৪৬ফুট ৯ ইঞ্চি ৩৩ফুট ৯ ইঞ্চি মসজিদটিতে ২১ফুট ৬ ইঞ্চি ২১ফুট ৬ ইঞ্চি মাপের একটি বর্গাকৃতির নামাজ ঘর রয়েছে। ৬ফুট৯ ইঞ্চি মাপের একটি প্রশস্ত বারান্দা ছিল। কিন্তু বর্তমান বারান্দাটি আর নেই। প্রত্বতত্ত¡ববিদদের মতে প্রবাজপুর শাহী মসজিদটি টাঙ্গাইলের আতিয়া জামে মসজিদ, নারায়নণগঞ্জের শাহী মসজিদ এবং পশ্চিম লট্রন ও চামকাটি মসজিদের অনুরূপ এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ।
অন্যদিকে বারান্দায় ছিল তিন গম্বুজ। বাংলা ১৩৬২ সনে মসজিদ সংস্কার করার সময় মসজিদের মূল পূর্ব দেয়ালের দিকে একটি ছোট দেয়াল জুড়ে মূল বারান্দার এলাকাসহ আয়তাকার বাধন উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ তৈরী করা হয়েছিল শুক্রবারের জুম্মার নামাজ আদায় করার জন্য। মসজিদের মূল কক্ষ বারান্দার উপর ও দক্ষিণ দেয়াল এবং বারান্দার প্রতি অংশে একটি করে মোট ৪টি দরজা ছিল। এছাড়াা সম্মুখ দেয়ালে এবং বারান্দার ও মূল কক্ষের মধ্যবর্তী দেয়ালের প্রত্যেকটিতে ৩টি করে ৬টি মোট ১০টি দরজা ছিল। উত্তর ও দক্ষিণ অংশের ৪টি দরজার নিম্নভাগ সম্প্রতি ছোট পাতলা প্রাচীর দ্বারা আংশিকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মসজিদের প্রধান দরজাটি ৪.৭ ইঞ্চি প্রশস্ত। মসজিদের পশ্চিম দিকের দেয়ালে ৩টি অলঙ্কৃত মেহরাব রয়েছে। মাঝ খানের মেহরাবটি প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী কিছুটা বহিবর্ধিত এবং পার্শ্ববর্তী দুটি থেকে আকারে বড়। এর অলংকরনগুলো সুন্দর।
তিনটি মেহরাবের খিলানই বহু ফলিযুক্ত এবং বহু পার্শ্ববিশিষ্ট স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। এছাড়া মেহরাবের বহিঃপ্রান্তে রেখায় ফলির সংযোগস্থলে পতাকা আকারে বড় নকশা রয়েছে। এবং স্প্যান্ড্রলে দুটি করে প্রস্ফুটিত পদ্মের বুটি আছে। মেহরাবের তিনটিতেই খিলানের কাঠামোর প্রান্তে খাড়া ও লম্বভাবে প্রচলন অনুযায়ী বক্রাকার গুল্মের নকশা রয়েছে। এ নকশা তিনটি এক এক রকম। উত্তর পার্শ্বেরটিতে পালানুযায়ী প্রস্ফুটিত বড় পদ্ম এবং ডিজাইন রয়েছে। কেন্দ্রেরটিতে বক্রলতার ভাজের মধ্যে উভয়দিকে বড় পতাকার নকশা করা হয়েছে। এবং দক্ষিণ পার্শ্বেরটিতে প্রস্ফুটিত সুন্দর বড় পদ্মের সমাবেশ দেখা যায়। একটি সুত্রে জানা যায় মসজিদটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৫০ একর জমি দান করা হয়েছিল। কিন্ত বর্তমান মসজিদের দখলে মাত্র ৩ একর জমি রয়েছে।