নাটকীয় পরিস্থিতিতে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়ে বাংলাদেশের সদ্য-সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অবতরণ করেছেন, তাও দিনদশেকের ওপর হয়ে গেল। ভারত সরকার প্রথমে ইঙ্গিত দিয়েছিল মধ্যপ্রাচ্য বা ইউরোপের তৃতীয় কোনো দেশই তার চূড়ান্ত গন্তব্য হতে যাচ্ছে, কিন্তু সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়নের এখনো কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।
ঠিক কোন ‘ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাসে’ শেখ হাসিনা এই মুহূর্তে ভারতে রয়েছেন, স্পষ্ট করা হয়নি সেটাও।
তবে ভারতে অনেক পর্যবেক্ষকই বলছেন, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে ভারতকে হয়তো শেষ পর্যন্ত দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’ দেয়ার জন্যই প্রস্তুত থাকতে হবে। আর সেটাও হতে পারে বেশ লম্বা সময়ের জন্যই।
আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত সরকার অবশ্য এখনো এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
গত ৬ আগস্ট ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর দেশটির পার্লামেন্টে জানিয়েছিলেন, শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে তার আগের দিন (৫ অগাস্ট) ‘সাময়িকভাবে’ বা তখনকার মতো ভারতে আসার অনুমোদন চাওয়া হয়, যেটা মঞ্জুর করা হয়েছিল।
এখন পর্যন্ত ওটাই শেখ হাসিনার এ দেশে থাকার ব্যাপারে ভারত সরকারের শেষ ঘোষিত অবস্থান। শেখ হাসিনার দিল্লিতে থাকার মেয়াদ কত দীর্ঘায়িত হতে পারে, এ বিষয়ে সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা নিজেরাও অন্ধকারে, স্বভাবতই তারা এটা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাইছেন না।
শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে এখন কী করা হবে তা নিয়ে এখনো অস্পষ্টতা থাকলেও অতীতে কিন্তু বিভিন্ন দেশের একাধিক নেতা, রাজনীতিবিদ বা তাদের পরিবারকে ভারত রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে।
সেই যাত্রায় স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে প্রায় দীর্ঘ ছয় বছর ভারতে কাটিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। যদিও নিরাপত্তার স্বার্থে দিল্লির পান্ডারা পার্কে তাদের সেই বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল ভিন্ন নাম ও পরিচয়ে।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে বাঙালি কংগ্রেস নেতা প্রণব মুখার্জি তখন শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের স্থানীয় অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতেন, সেই সুবাদে তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল নিবিড় ব্যক্তিগত হৃদ্যতাও। যে কারণে আজীবন প্রণব মুখার্জিকে ‘কাকাবাবু’ বলেই সম্বোধন করে এসেছেন শেখ হাসিনা।
তারও কয়েক বছর আগে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাজউদ্দিন আহমেদ-সহ আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতা ভারতে পালিয়ে চলে গেলে তাদেরও আশ্রয় দেয়া হয়েছিল।
তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামদের নেতৃত্বে এরপর গড়ে তোলা হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকার, যার কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো মূলত কলকাতা থেকেই।
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন পর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীও ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় পান।
এরপর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান শহরের একটি সরকারি ‘সেফ হাউসে’ বহু বছর কাটিয়েছিলেন ‘বাঘা সিদ্দিকী’ নামে পরিচিত এই নেতা।
কিন্তু শুধু শেখ হাসিনা বা বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতানেত্রীরাই নন, ভারতে বিভিন্ন সরকারের আমলে আরো বহু দেশের অনেক নেতা বা তাদের পরিবারও কিন্তু আশ্রয় পেয়েছেন।
তাদের মধ্যে কেউ বছর কয়েক পরে নিজ দেশে বা অন্যত্র ফিরে গেছেন, কাউকে আবার পাকাপাকিভাবে ভারতেই থেকে যেতে হয়েছে।
ইতিহাসের পাতা উল্টে এই প্রতিবেদনে ফিরে তাকানো হয়েছে এমনই কয়েকটি দৃষ্টান্তের দিকে।
দালাই লামা (১৯৫৯) ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ তার আকরগ্রন্থ ‘ইন্ডিয়া আফটার গান্ধী’তে লিখেছেন, “১৯৫৯ সালের মার্চ মাসের শেষ দিনটিতে দালাই লামা ম্যাকমোহন লাইন অতিক্রম করে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ভূখণ্ডের প্রবেশ করেন। তার আগে বেশ কয়েক বছর ধরে তিব্বতের এই ‘ঈশ্বর-রাজা’ লাসা-য় তার পোটালা প্যালেসের সিংহাসনে দিন কাটাচ্ছিলেন চরম অস্বস্তির মধ্যে, কারণ তিব্বতের ওপর চীনের কব্জা ক্রমশ এঁটে বসছিল। একটি সূত্র জানাচ্ছে, তখনই অন্তত পাঁচ লাখ চীনা সৈন্য তিব্বতে মোতায়েন ছিল, পাশাপাশি আরো ছিল তার অন্তত ১০ গুণ হুন বসতি স্থাপনকারী।”
১০ মার্চ ১৯৫৯ তিব্বতে মোতায়েন চীনের একজন জেনারেল একটি নাচের অনুষ্ঠানে দালাই লামাকে আসার আমন্ত্রণ জানান, কিন্তু এটাও বলে দেয়া হয় যে তার দেহরক্ষীরা সেখানে ঢুকতে পারবে না। অনুষ্ঠানের দিন হাজার হাজার তিব্বতি দালাই লামার প্রাসাদের সামনে জড়ো হয়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন।
তিব্বতিরা বহুদিন ধরেই সন্দেহ করছিলেন যে তাদের ধর্মগুরুকে চীনারা অপহরণ করার ষড়যন্ত্র আঁটছে, এই ঘটনায় তাদের সেই ধারণা আরো বদ্ধমূল হয়।
এর ঠিক আগের বছরই (১৯৫৮) পূর্ব তিব্বতের খাম্পা জনজাতি এই চীনা ‘দখলদার’দের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থান করেছিল। খাম্পারা শুরুতে কিছুটা সাফল্য পেলেও চীনা বাহিনী খুব শক্ত হাতে সেই বিদ্রোহ দমন করে এবং এরপর দালাই লামাকে পর্যন্ত নিশানা করার ইঙ্গিত দিতে থাকে।
ইতোমধ্যে লাসায় নিযুক্ত ভারতীয় কনসালের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন তিব্বতি নেতৃত্ব। ২৩ বছর বয়সী দালাই লামাকে ভারত রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে প্রস্তুত, এই আশ্বাস মেলার পর গোপনে রাতের অন্ধকারে কয়েকজন বাছাই-করা বিশ্বস্ত সঙ্গীকে নিয়ে তিনি ছদ্মবেশে লাসা ত্যাগ করেন।
রামচন্দ্র গুহ আলো লেখেন, “ভারতের মাটিতে দালাই লামা তার প্রথম রাতটি কাটান তাওয়াং-এর একটি বৌদ্ধ মনাস্টারিতে। তারপর তিনি ক্রমশ পাহাড় থেকে নেমে আসেন সমতলে, পৌঁছান আসামের শহর তেজপুরে। সেখানে ভারতের কর্মকর্তারা লম্বা সময় ধরে তাকে ‘ডিব্রিফ’ করেন। ঠিক তিন সপ্তাহ পর প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করিয়ে দেয়ার জন্য তাকে নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লিতে।”
৩ এপ্রিলই প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু পার্লামেন্টে ঘোষণা করেছিলেন, তিব্বতি ধর্মগুরু দালাই লামা- যাকে তার অনুগামীরা ভগবান বুদ্ধের জীবন্ত অবতার বলে মনে করেন, তিনি ভারতে চলে এসেছেন এবং ভারত সরকার তাকে ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’ দিয়েছে।
পন্ডিত নেহরু সে দিন সভায় আরো জানান, দালাই লামা শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন এবং ভারত এই অতিথিকে তার যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা দেবে।
পরদিন দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, একমাত্র কমিউনিস্ট বা বামপন্থীরা ছাড়া ভারতের সব দল ও মতের মানুষজন এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিল।
তারা আরো জানায়, ‘দিল্লিতে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত প্যান সে-লিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে পার্লামেন্টে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির একটি প্রতিলিপিও ধরিয়ে দেয়া হয়।’
সেই থেকে আজ ৬৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে দালাই লামা ভারতের রাজনৈতিক আশ্রয়েই রয়েছেন।
হিমাচল প্রদেশের জোড়া শৈলশহর ধরমশালা ও ম্যাকলিয়ডগঞ্জে হাজার হাজার তিব্বতি সেই তখন থেকে আজও বসবাস করেন, তিব্বতের ‘প্রবাসী সরকার’ও (গভর্নমেন্ট ইন এক্সাইল) সেখান থেকেই পরিচালিত হয়।
তিব্বত গবেষক টিম লি-র কথায়, ‘ভারতে দালাই লামার উপস্থিতি বিগত বহু দশক ধরে ভারত ও চীনের সম্পর্ককে প্রভাবিত করে এসেছে, কিন্তু ভারতের কোনো সরকারই তিব্বতিদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া নিয়ে কখনো দ্বিতীয়বার ভাবেনি।’
বস্তুত তিব্বতের সাথে ভারতের আবহমান কাল থেকেই সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক বন্ধন ছিল খুবই শক্তিশালী। ভারত চিরকালই তিব্বতকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবেই গণ্য করত, সীমান্তও ছিল শান্তিপূর্ণ।
টিম লি জানাচ্ছেন, “এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে ১৯৫৪ সালে, যখন ভারত চীনের সাথে ‘পঞ্চশীল চুক্তি’তে স্বাক্ষর করে এবং তিব্বতকে ‘চীনের একটি অঞ্চল’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।”
কিন্তু এরপর যখন থেকে হাজার হাজার তিব্বতি চীনের নিপীড়ণে ভারতে পালিয়ে আসতে শুরু করেন এবং চীনও জানিয়ে দেয় দু’দেশের আন্তর্জাতিক সীমানা বলে স্বীকৃত ‘ম্যাকমোহন লাইন’কে তারা মানে না, তিব্বত নিয়ে ভারত তাদের নীতি পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হয়।
এরই পরিণতিতে জওহরলাল নেহরুর সরকার দালাই লামাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, যেটা ছিল স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে কোনো বিদেশি ধর্মীয় নেতাকে এভাবে আতিথেয়তা দেয়ার প্রথম ঘটনা।
মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ্ (১৯৯২) মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ্ আহমদজাই, যিনি শুধু ‘নাজিবুল্লাহ’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন, তিনি ১৯৮৬ সালে সোভিয়েতের সমর্থনে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন।
প্রায় ছয় বছর প্রেসিডেন্ট পদে থাকার পর ইসলামি মুজাহিদিনরা যখন ১৯৯২ সালের এপ্রিলে কাবুল দখল করে, তখন প্রেসিডেন্ট পদে ইস্তফা দিয়ে নাজিবুল্লাহ্ ভারতের কাছে আশ্রয় চান, তা মঞ্জুরও হয় সাথে সাথেই।
ভারতের সাথে আফগান রাজনীতিক নাজিবুল্লাহর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কিশোর বয়স থেকেই, ভারত-শাসিত কাশ্মিরের বারামুলার একটি সেকেন্ডারি স্কুলে তিনি নিজে পড়াশোনাও করেছেন।
তবে ১৯৯২ সালে ভারতে যাওয়ার চেষ্টায় এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর পথেই আফগান নিরাপত্তারক্ষীরা নাজিবুল্লাহকে আটকে দেন, তার আর দিল্লির বিমানে ওঠা সম্ভব হয়নি।
নিজের জীবন বাঁচাতে নাজিবুল্লাহ এরপর গিয়ে আশ্রয় নেন কাবুলে জাতিসঙ্ঘের কার্যালয়ে, যেখানে মুজাহদিনরা চট করে ঢুকতে পারবে না বলে তিনি ধারণা করেছিলেন।
এই ঘটনার কয়েক মাস আগেই বিপদ আঁচ করে প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাহ তার স্ত্রী ও তিন কন্যা সন্তানকে গোপনে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু সেই তথ্য তখন প্রকাশ করা হয়নি।
অনেক পরে ভারত সরকার জানিয়েছিল, নাজিবুল্লাহর পরিবারকে মধ্য দিল্লির ল্যুটিয়েন্স জোনে একটি বাড়িতে সরকারি আতিথেয়তায় রাখা হয়েছে। তাদের খরচ নির্বাহের জন্য ভারত সরকার মাসে এক লাখ রুপির ভাতা দিচ্ছে, ব্যবস্থা করা হয়েছে নিরাপত্তারও।
১৯৯৬ সালে ভারতের তদানীন্তন যুক্তফ্রন্ট সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইন্দ্রকুমার গুজরাল দেশের পার্লামেন্টে জানান, ‘প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাহর পরিবার ১৯৯২ থেকেই ভারতে রয়েছেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি মিসেস নাজিবুল্লাহকে বলেছি, ভবিষ্যতে আপনি বা আপনার পরিবারের সদস্যরা কী করবেন সেই সিদ্ধান্ত অবশ্যই আপনাদের। কিন্তু আপনারা যতদিন খুশি ভারতের সম্মানিত অতিথি হিসেবে আমাদের মাঝে থাকতে পারেন এবং আপনাদের পরিবারের দেখাশুনার জন্য যা করতে হয় তা আমরা সব সময় করতে প্রস্তুত থাকব।’
নাজিবুল্লাহর স্ত্রী ও সাবেক আফগান ফার্স্ট লেডি ফাতানা নাজিব ও তার তিন কিশোরী মেয়ে হিলা, মোসকা ও ওনাই এরপর বহু বছর দিল্লিতেই পড়াশুনা করেছেন, কাটিয়েছেন ভারতের রাজধানীতেই।
মোসকা নাজিব এখন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক ও আলোকচিত্রী, দিল্লিতে থাকাকালীন বেশ কিছুদিন তিনি বিবিসির দিল্লি ব্যুরোতেও কাজ করেছেন। তার অন্য বোনরাও সবাই অবশ্য এখন বিদেশে থাকেন, কেউ সুইটজারল্যান্ডে, কেউ সিঙ্গাপুরে।
তবে ১৯৯২ সালে কাবুল ছেড়ে দিল্লি চলে আসার পর ফাতানা নাজিব বা তার মেয়েদের সাথে নাজিবুল্লাহর আর জীবনে কখনো দেখা হয়নি।
১৯৯৬ সালে নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের হাত থেকে তালেবান যখন কাবুল দখল করে নেয়, অ্যালায়েন্সের নেতা আহমেদ শাহ মাসুদ নাজিবুল্লাহও শহর থেকে পালানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন।
কিন্তু নাজিবুল্লাহ্-র ধারণা ছিল, তিনি নিজে যেহেতু একজন পাশতুন এবং তালেবানের মধ্যে পাশতুনদেরই প্রাধান্য বেশি, তাই তাকে অন্তত তালেবান কিছু করবে না।
সেই ধারণা অচিরেই ভুল প্রমাণিত হয়। ১৯৯৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তালেবান যোদ্ধারা কাবুলে জাতিসঙ্ঘের কম্পাউন্ডে ঢুকে সাবেক প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাহকে হিড়হিড় করে টেনে বের করে আনে।
এরপর প্রকাশ্য তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়, গুলি করে মারা হয় এবং কাবুলে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের ঠিক বাইরে একটি ল্যাম্পপোস্টের পোল থেকে তার লাশটি ঝুলিয়ে দেয়া হয়।
কাবুলের রাজপথে নাজিবুল্লাহর সেই ঝুলন্ত লাশের ছবি তালেবানের নির্মমতার নিদর্শন হিসেবে পরে বহু জায়গায় প্রদর্শিত হয়েছে।
নাজিবুল্লাহ্ ছিলেন এমন একজন আফগান নেতা, ভারতের কাছ থেকে রাজনৈতিক আশ্রয়ের নিশ্চয়তা পেয়েও যিনি শেষ পর্যন্ত ভারতে এসে পৌঁছাতেই পারেননি এবং নিজের জীবনও রক্ষা করতে পারেননি।
তার পরিবারের বাকি সদস্যরা অবশ্য ভারতের আশ্রয়েই নতুন করে নিজেদের জীবন গড়ে তুলতে পেরেছিলেন।
মোহামেদ নাশিদ (২০১৩) মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট তথা রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্ট মোহামেদ নাশিদকে ভারত রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিল এক বিচিত্র পরিস্থিতিতে।
মোহামেদ নাশিদ এর আগে ২০০৮ সালে মালদ্বীপে প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গায়ুমের একটানা ৩০ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশের ক্ষমতায় এসেছিলেন।
২০১২ সালে দেশটির এক রাজনৈতিক সঙ্কটের জেরে অবশ্য তাকে পদত্যাগ করতে হয়।
অপসারিত প্রেসিডেন্ট মোহামেদ নাশিদের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি দেশটির আদালত একটি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে।
সেই ওয়ারেন্টের ভিত্তিতে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করার আগেই নাশিদ সটান চলে যান রাজধানী মালের ভারতীয় হাই কমিশন ভবনে।
ভারতের সাথে তার অবশ্য আগে থেকেই সুসম্পর্ক ছিল, কিন্তু তিনি যে সোজা ভারতীয় দূতাবাসে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতে পারেন এটা ভারতের কর্মকর্তারাও অনেকে ভাবতে পারেননি।
দিল্লির সাথে পরিস্থিতি নিয়ে দ্রুত আলোচনা করেন তদানীন্তন ভারতীয় হাই কমিশনার, এরপর সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহামেদ নাশিদকে রাজনৈতিক আশ্রয় মঞ্জুর করে মনমোহন সিং সরকার।
তবে এই পরিস্থিতি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, কয়েক দিন পরেই অভ্যন্তরীণ সমঝোতার ভিত্তিতে নাশিদ গ্রেফতারি থেকে অব্যাহতি পান, এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ওই বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও। ভারতও মুক্তি পায় একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে।
পরে অবশ্য ভিন্ন পরিস্থিতিতে মোহামেদ নাশিদকে ২০১৬ সাথে যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক আশ্রয়ও নিতে হয়েছিল, আবার তিন বছর পর তিনি ফিরে এসেছিলেন মালদ্বীপের রাজনীতিতেও। হয়েছিলেন দেশের পার্লামেন্টের স্পিকারও।
তবে মোহামেদ নাশিদ ভারতের কাছ থেকে বিপদের সময় যে সাহায্য পেয়েছিলেন, মালদ্বীপের সাবেক ভাইস-প্রেসিডেন্ট আহমেদ আদিব আবদুল গফুরের কিন্তু সেই সৌভাগ্য হয়নি!
২০১৯ সালে মালদ্বীপের এই রাজনীতিবিদ একটি কার্গো ভেসেল বা মালবাহী জাহাজে চেপে ভারতের তামিলনাডু উপকূলে এসে ভেড়েন।
ওই জাহাজে তিনি ছাড়াও আরো নয়জন ক্রু সদস্য ছিলেন, তারা সবাই ভারতের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন।
কিন্তু গফুরকে জাহাজ থেকে নামতে দেয়া হয়নি, ভারতের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা জাহাজে উঠে সাবেক ভাইস-প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং শেষ পর্যন্ত তার আবেদন নাকচ করে দেয়া হয়।
পরে জাহাজটিকে ফিরিয়ে দেয়া হলে মালদ্বীপের পুলিশ তাদের সমুদ্রসীমায় আদিব আবদুল গফুরকে গ্রেফতার করে।
রাজা ত্রিভুবন শাহ (১৯৫০), রাজা জ্ঞানেন্দ্রকে প্রস্তাব (২০০৮) ১৯৫০ সালের নভেম্বরে নেপালের তখনকার মহারাজা ত্রিভুবন বীর বিক্রম শাহ তার ছেলে মহেন্দ্র, সব চেয়ে বড় নাতি বীরেন্দ্র ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে কাঠমান্ডুর ভারতীয় দূতাবাসে আশ্রয় নেন।
নেপালের রাজবংশের সাথে রানাদের (যাদের হাতে ছিল দেশের শাসনক্ষমতা) বহুদিন ধরে চলা সংঘাতের জেরেই একটা পর্যায়ে রাজা ত্রিভুবন ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
রাজা ত্রিভুবন শাহ ভারতের কাছে আশ্রয় চাওয়ায় চটে লাল হয়ে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোহন শামসের জং বাহাদুর রানা।
প্রায় সাথে সাথে সিংহ দরবারে জরুরি ক্যাবিনেট বৈঠক ডেকে প্রধানমন্ত্রী রানা সিদ্ধান্ত নেন, ত্রিভুবন শাহ্-এর চার বছর বয়সী বাচ্চা নাতি জ্ঞানেন্দ্র, যিনি দাদার সাথে ভারতীয় দূতাবাসে যেতে পারেননি। তাকেই নেপালের নতুন রাজা ঘোষণা করা হবে।
এর তিন দিন পর (১০ নভেম্বর ১৯৫০) নেপালের কাঠমান্ডুতে গোওচর বিমানবন্দরে দুটি ভারতীয় এয়ারক্র্যাফট এসে নামে, যাতে করে ত্রিভুবন শাহ ও পরিবারের অন্যরা (শিশু রাজা জ্ঞানেন্দ্রকে ফেলেই) দিল্লিতে রওনা হয়ে যান। ঘটনাচক্রে ওই এয়ারপোর্টের এখন নামকরণ করা হয়েছে রাজা ত্রিভুবন শাহ-এর নামেই।
দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও অন্য সরকারি কর্মকর্তারা তাদের স্বাগত জানান। রাজা ত্রিভুবন শাহ ও পরিবারের বাকি সবাইকে ভারত রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়।
তবে রাজা ত্রিভুবন শাহকে মাস তিনেকের বেশি ভারতে থাকতে হয়নি। রাজার দেশত্যাগে নেপাল জুড়ে রানাদের বিরুদ্ধে যে তীব্র বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, তাতে সরকার ত্রিভুবন শাহর সাথে সমঝোতা করতে বাধ্য হয়, যে আলোচনায় ভারতও মধ্যস্থতা করেছিল।
১৯৫১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি নেপালের ‘মনার্ক’ বা মহারাজা হিসেবে ত্রিভুবন বীর বিক্রম শাহ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
ঘটনাচক্রে সেই ঘটনার প্রায় ৫৭ বছর পর নেপাল থেকে যখন রাজতন্ত্রের বিলোপ ঘটছে, সে সময়কার ‘শিশু রাজা’ জ্ঞানেন্দ্র শাহ তখন দেশের সিংহাসনে!
রাজার ওপর তখন দেশ ছাড়ার জন্য প্রচণ্ড চাপ, নির্বাচনে জয়ী হয়ে মাওবাদীরাও জ্ঞানেন্দ্রকে প্রাসাদ ছাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন।
সম্প্রতি বিবিসি নেপালি বিভাগের একটি প্রতিবেদনে সে সময়কার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কমল থাপা জানিয়েছেন, রাজা জ্ঞানেন্দ্রকে আশ্রয় দিতে চেয়ে বাইরের অনেকগুলো দেশই তখন প্রস্তাব দিয়েছিল।
কমল থাপা বলেন, ‘আমি একাধিক দেশের কথাই তখন শুনেছিলাম, তবে ভারতও যে সেই তালিকায় ছিল সে কথা আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি।’
এদিকে ভারত নেপালের রাজা জ্ঞানেন্দ্র শাহকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিচ্ছে কিনা, ভারতের তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জিকেও বারবার সে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছিল।
প্রণব মুখার্জি অবশ্য প্রতিবারই সে প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছিলেন। তবে ভারত এই ধরনের প্রস্তাব দেয়নি, এ কথাও তিনি কখনো বলেননি।
ফলে ভারত রাজা জ্ঞানেন্দ্র শাহকে আশ্রয় দেয়ার প্রস্তাব দিয়ে রেখেছিল এটা মনে করার যথেষ্ঠ কারণ আছে, যদিও তিনি তা শেষ পর্যন্ত গ্রহণ করেননি।
নেপালের ইতিহাসে দু’দুবার সিংহাসনে বসা একমাত্র ব্যক্তি ও শাহ্ রাজবংশের শেষ শাসক জ্ঞানেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ শেষ পর্যন্ত নেপালেই রয়ে গিয়েছিলেন এবং ভারতের রাজনৈতিক আশ্রয় দানের তালিকাকে আর দীর্ঘ করেননি! সূত্র : বিবিসি
যাযাদি/ এস