রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

গভীর সমুদ্রে সত্যিকারের জলদস্যুরা

যাযাদি ডেস্ক
  ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২:০০
ছবি-সংগৃহীত

কয়েক শতাব্দী আগেও কোনো উপকূলীয় শহরের কোনো একটি ডানপিঠে ছেলের হঠাৎ করেই বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মানেই সবাই ধরে নিত ছেলেটি কোনো জলদস্যু দলের সঙ্গে ভিড়ে গেছে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, সে সময়ের জলদস্যুদের অভিযানগুলো ছিল দুর্দান্ত রোমাঞ্চকর আর বীরত্বপূর্ণ। আঠারো এবং ঊনবিংশ শতকের অনেক গল্প-উপন্যাসও এই সব রোমাঞ্চে ভরপুর হয়ে থাকত। আধুনিককালেও এর প্রভাব রয়ে গেছে। জলদস্যুদের কাহিনী অবলম্বনে তৈরি হচ্ছে বা হয়েছে সিনেমা।

সমুদ্রপথ যখন ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যম হয়ে উঠল, তখন থেকেই সমুদ্রে জলস্যুদের উৎপাত। অনেক কাল আগে থেকেই পৃথিবীর ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল সমুদ্রনির্ভর। খ্রিষ্টপূর্ব কয়েক শতাব্দী আগেও জলদস্যুদের বিচরণ ঐতিহাসিকভাবেই লিপিবদ্ধ আছে। তখনকার দিনে পণ্য ব্যবসায়ীরা সমুদ্রপথেই জাহাজে করে তাদের মালামাল এক দেশ থেকে অন্য দেশে নিয়ে যেত। তাই সওদাগরদের ওইসব জাহাজ সবসময়ই ধনরত্নে বোঝাই হয়ে থাকত। এই ধনরত্ন, টাকা-পয়সা এবং মালামাল ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য বিশাল সমুদ্র দাপিয়ে বেড়াত সমুদ্র ডাকাতরা।

শুধু সওদাগরদের জাহাজই নয়, অনেক সময় এসব দস্যুরা বিভিন্ন জনপদেও হানা দিত এবং মূল্যবান ধনসম্পত্তি লুট করে নিয়ে যেত। নিজ দেশে দস্যুরা তাই বীরের মর্যাদা পেত। পেত সরকারি আনুক‚ল্যও। সমুদ্রপথে দস্যুদলের নেতৃত্ব দেওয়া অসংখ্য নাবিকের কাহিনি বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে।

বছর কয়েক আগে ড্যাভ ব্যারি নামের এক পুৎলিজার বিজয়ী লেখক ও সাংবাদিক কালজয়ী জলদস্যুদের স্মরণে ‘জলদস্যু দিবস’ পালন করার দাবিটিকে জোড়ালোভাবে তুলে ধরেন। একইসঙ্গে তিনি কয়েকজন ঐতিহাসিক ডাকাত সর্দারের নামও উল্লেখ করেন। সে সব ডাকাত সর্দারদের মধ্যে বারব্যারোজা ব্রাদার্স, স্যার ফ্রান্সিস ড্র্যাক, ওলোনাইজ, হেনরি মরগান, ক্যাপ্টেন কিড, ব্ল্যাক বেয়ার্ড, ক্যালিকো জ্যাক, মাদামে চ্যাং এই নামগুলোই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সত্যিকারের এসব জলদস্যুদের কাহিনী অনেক রোমাঞ্চকর এবং উত্তেজনাকর। ডেভ ব্যারির দেওয়া তথ্য থেকে তাদের সম্পর্কে জানা যায়।

বারব্যারোজা ব্রাদার্স : আরুজ ও হিজির নামে দুই ভাই উত্তর আফ্রিকার বারব্যারি উপকূল থেকে তাদের জাহাজ সমুদ্রপথে যাত্রা করত। ভূমধ্যসাগরে চলাচলকারী ইউরোপীয় জাহাজগুলোতে তারা ডাকাতি এবং লুটপাট করত। জীবনের প্রথমদিকেই তারা দু’টি একতলা জাহাজ এবং একটি সার্ডেনিয়ান যুদ্ধজাহাজ নিজেদের অধিকারভুক্ত করতে সক্ষম হয়। স্প্যানিয়ার্ডদের জাহাজে ডাকাতি করতে গিয়ে এক সময় আরুজের একটি হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ১৫১৬ সালের দিকে এক জরুরি বিচারে অটোম্যান সুলতান সে সময় আরুজের মৃত্যুদণ্ড দেন। ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য হিজির সে সময় অনেক বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। হিজির তখন বেছে বেছে খ্রিষ্টান জাহাজগুলোতে আক্রমণ শুরু করেন। তাকে ধ্বংস করার জন্য সে সময় পোপের নির্দেশে একটি বিরাট বহর সমুদ্রে অভিযান চালায়।

স্যার ফ্রান্সিস ড্র্যাক : স্প্যানিশ জাহাজগুলোতে ডাকাতি করার জন্য ফ্রান্সিস ড্র্যাক ছিলেন সরকারিভাবে অনুমতিপ্রাপ্ত। রানি প্রথম এলিজাবেথ এই দস্যুকে আদর করে ‘মাই পাইরেট’ বা ‘দস্যু আমার’ বলে ডাকতেন। ড্র্যাক তার বিখ্যাত অভিযানগুলো ১৫৭৭ থেকে ১৫৮০ সাল পর্যন্ত সময়ে পরিচালনা করেন। সমুদ্রপথে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করা তিনি হলেন প্রথম ইংরেজ। অধঃস্তনদের বিশ্বাসঘাতকতায় এক অভিযানে তার পাঁচটি জাহাজের চারটিই হারালেও সে সময় বিভিন্ন স্প্যানিশ বন্দরে তিনি আক্রমণ করেন এবং মূল্যবান ধনসম্পদে পরিপূর্ণ স্প্যানিশ অনেক জাহাজ তিনি কব্জা করে দেশে ফেরেন এবং রানি তাকে ‘নাইট’ উপাধিতে র্ভষিত করেন।

এল’ ওলোনাইজ : তিনি একজন দুর্ধর্ষ জলদস্যু ছিলেন। বদরাগী আর খিটখিটে মেজাজের ওলোনাইজ সরকারি আনুক‚ল্য পাওয়া জলদস্যুদের একদম সহ্য করতে পারতেন না। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি বা এর কিছু পরে তিনি ক্যারিবিয়ান সাগরগুলোতে স্প্যানিশ জাহাজগুলোতে ডাকাতি করতেন। তখনকার সময় উপখূলীয় এলাকাগুলোতেও তিনি লুটপাট চালাতেন। নিষ্ঠুরতার জন্যই মূলত তিনি বিখ্যাত ছিলেন। তার অত্যাচারের বর্ণনা দিতে গিয়ে এক ঐতিহাসিক বলেন, ওলোনাইজ তার শিকারকে টুকরা টুকরা করে কাটতেন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না চোখ দু’টি বেড়িয়ে আসছে, ততক্ষণ পর্যন্ত রশি দিয়ে গলায় চেপে ধরে রাখতেন।

জানা যায়, তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, এমন একজনের হৃদপিÐটাকে হাতে নিয়ে তিনি তাতে কামড়ও বসিয়েছিলেন। তাকে নির্মুল করার জন্য ১৬৬৮ সালে একটি অভিযানও পরিচালনা করা হয় কিন্তু ঐতিহাসিকরা বলেন, তার আগেই তাকে নরখাদকরা বন্দি করে এবং খেয়ে ফেলে।

হেনরি মরগান : সম্ভবত সবচেয়ে বেশি পরিচিত জলদস্যু। কিউবা ও হাইতি উপক‚লে ডাকাতি করতেন। ১৬৭২ সালে একজন দস্যু হিসেবে গ্রেপ্তার হলেও ১৬৭৮ সালে তিনি জ্যামাইকার গভর্নর হন।

ক্যাপ্টেন কিড : জলদস্যু হিসেবে তিনি ছিলেন অনেক ‘সম্মানিত’। ১৬৯৫ সালে জলদস্যুদের নির্মুল করার জন্য ভারত মহাসাগরে পাঠানো হলেও ধীরে ধীরে তিনি নিজেই একজন জলদস্যুতে পরিণত হন। বিভিন্ন জাহাজে লুট করে দেশে ফেরার আগে তিনি বিপুল ধনসম্পদ কোনো দ্বীপে রেখে আসেন এবং তখনকার শক্তিশালী ব্রিটিশ ইস্ট ইনডিয়া কোম্পানির অবাধ্য হওয়ায় দেশে ফেরার আগেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচারের আওতায় এনে ফাঁসি দেওয়া হয়। অন্য দস্যুদের সতর্ক করার জন্য তার দেহটা অনেকদিন সাগরের কিনারায় ঝুলিয়ে রাখা হয়।

ব্ল্যাক বেয়ার্ড : কথিত আছে, মুখ ও মাথার লম্বা কোকড়ানো চুলে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া ব্যবহার করে এবং ঘাড় আর কোমরবন্ধনীতে নানা রকমের পিস্তল এবং ড্যাগার রেখে ব্ল্যাক বেয়ার্ড তার শত্রুদের ভয় দেখাতেন। ১৭১৭ সালে তিনি দাস বহনকারী ফরাসিদের একটি জাহাজ কব্জা করেন। পরে যার নাম দেওয়া হয় ‘কুইন অ্যানস রিভেঞ্জ’। তিনি এই জাহাজে ৪০টি গোলা নিক্ষেপকারী বন্দুক স্থাপন করেন। এই জাহাজ নিয়ে তিনি একবার চ্যারলেসটন বন্দর এবং দক্ষিণ ক্যারোলিনার বসতি এলাকায় ওষুধের জন্য হামলা করেন। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সঙ্গে এক যুদ্ধে তিনি নিহত হন।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, নিস্তেজ হওয়ার আগে তার শরীরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে ২০ বার বিদ্ধ করা হয় এবং অন্তত পাঁচটি গুলি করা হয়। জলদস্যুদের স্বর্ণযুগ খ্যাত অষ্টাদশ শতকের বিশাল একটি অংশজুড়ে তার প্রভাব ছিল। হলিউডের ‘পাইরেটস অব ক্যারিবিয়ান’ চলচ্চিত্রটিতে তাকে অন্যতম প্রধান চরিত্র হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।

ক্যালিকো জ্যাক : জন র‌্যাকম্যানই ‘ক্যালিকো জ্যাক’ নামে ব্যাপক পরিচিত। ১৭১৯ সালের আগে করা তার সব দস্যুতা ক্ষমা করে দেওয়া হয়। জানা যায়, ক্যালিকোর অনুসারী ১২ নৌকার মধ্যে দুইজন নারী জলদস্যুও ছিলেন। অ্যান বন্নি নামে তাদের একজন, ক্যালিকোর সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য যে তার স্বামীকে ছেড়ে আসেন এবং অন্যজন ম্যারি রিড পুরুষের পোশাকে যিনি নাবিকের কাজ করতেন। ১৭২০ সালের অক্টোবরে একটি দস্যু শিকারী জাহাজ ক্যালিকোকে সদলবলে আটক করে। অ্যান ও ম্যারির নাক কেটে দেওয়া হয়। কারণ তারা দু’জনই জাহাজে গর্ভধারণ করেছিলেন। এ ঘটনার কিছুদিন পরেই কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় ম্যারি মারা যান এবং অ্যানের খোঁজ কেউ কোনো দিন পায়নি।

মাদাম চ্যাং : মাদাম চ্যাং-এর স্বামী চ্যাং ইয়ির গঠন করা দস্যুবাহিনী ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হিসেবে স্বীকৃত। দুই বছর পর ইয়ির মৃত্যু হলে দস্যুবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নেন মাদাম চ্যাং। এই দুঃসাহসী নারী সেই বাহিনীকে আরও প্রসারিত করেন। এ সময় আনুমানিক ১৮০০ জাহাজ এবং প্রায় ৭০ হাজার জলদস্যু তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। তার স্বামীর দত্তক নেওয়া পুত্র এবং একই সঙ্গে তার গোপন প্রেমিক চ্যাং পো তাসির সহযোগিতায় সমুদ্র উপক‚লীয় এলাকাগুলোতে তিনি অর্থ দাবি করতেন।

জানা যায়, দক্ষিণ চীন সাগরে তার বাহিনী কয়েকটি জাহাজে আক্রমণ করে সাতজন ব্রিটিশ সেনাকে আটক করেন। পরে চীন সরকার দস্যুতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রাক্কালে ১৮১০ সালে তাকে সাধারণ ক্ষমা করা হয়। যৌবনের প্রারম্ভে তিনি ছিলেন একজন পতিতা। কিন্তু পরে তিনিই হয়ে যান নেশাদ্রব্য আফিমের চোরাচালানের সম্রাজ্ঞী।

তথ্যসূত্র : হিস্টোরি ডটকম

যাযাদি/ এসএম

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে