বদলে গেছে দৃশ্যপট, মধ্যপ্রাচ্যে কমছে মার্কিন সেনা

প্রকাশ | ৩০ জুন ২০২৪, ১০:০৫

যাযাদি ডেস্ক
ছবি-সংগৃহিত

গত কয়েক দশক ধরেই মধ্যপ্রাচ্যে সক্রিয় আমেরিকা। ইরাক আক্রমণ থেকে শুরু করে ইসলামিক স্টেট বা আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই কিংবা ইসরাইল ও সৌদি আরবকে অস্ত্র পাঠানো- এমন নানা বিষয়ে সম্পৃক্ত থেকেছে তারা। জ্বালানি সম্পদ, বাণিজ্য রুট, ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা এবং ইসরাইলের সঙ্গে দেশটির স্থায়ী মিত্রতার মতো বিষয়গুলোকেই অঞ্চলটির প্রতি আমেরিকার আগ্রহের কারণ হিসেবে দেখে থাকেন বিশ্লেষকরা।

তবে মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান করা মার্কিন সেনার সংখ্যা নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে। ২০০৭ সালে কেবল ইরাকেই যেখানে ১ লাখ ৬০ হাজার সেনা ছিল, সেখানে মিসর থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত সব মিলিয়ে বর্তমানে এই সংখ্যা ৪০ হাজারের কম। এর পুরোটাই মার্কিন সামরিক বাহিনীর সেন্ট্রাল কমান্ডের অধীনে রয়েছে। অঞ্চলটিতে মার্কিন সেনার উপস্থিতি আরও কমিয়ে আনা হবে কি-না, তা ওয়াশিংটনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে কিছু বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া যাক।

জ্বালানি
সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, কুয়েত এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল মজুত কয়েক দশক ধরেই মার্কিন নীতি নির্ধারণের একটি প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে। তবে আমেরিকার নিজ ভূমিতেই শেল গ্যাস (পাথুরে গ্যাস নামেও পরিচিত এই প্রাকৃতিক গ্যাস) বৃদ্ধি পাওয়ায় গত ১৫ বছরে দেশটিতে তেল ও গ্যাসের উৎপাদন বেড়েছে। ফলে এ ধরনের জ্বালানি আমদানির ক্ষেত্রে দেশটি আগের চেয়ে কম নির্ভরশীল। পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস উভয় ক্ষেত্রেই আমেরিকা নেট রপ্তানিকারক, অর্থাৎ আমদানির চেয়ে বেশি রপ্তানি করছে দেশটি।

বৈশ্বিক তেলের বাজার আন্তঃসম্পর্কিত; মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটলে তা তেলের দামের সঙ্গে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায়ও প্রভাব ফেলতে পারে। আমেরিকা যখন মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনছে, তখন চীন মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল বলে জানাচ্ছেন লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের (এসওএএস) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক গিলবার্ট আসকার। তিনি বলেন, ‘এর অর্থ হলো- মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ আমেরিকাকে চীনের বিষয়ে বেশ কিছু কৌশলগত সুবিধা দেয়।’ 

অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং পণ্য পরিবহণ
মধ্যপ্রাচ্য আমেরিকান পণ্য ও পরিষেবা বিশেষ করে সামরিক হার্ডওয়্যারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাজার। ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এই অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি মার্কিন অস্ত্র রপ্তানি করা হয়েছে। মোট মার্কিন অস্ত্র রপ্তানির ৩৮ শতাংশই গেছে মধ্যপ্রাচ্যে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র কিনেছে সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত এবং ইসরাইল। 
এছাড়াও সমুদ্রপথে বৈশ্বিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্য গুরুত্বপূর্ণ বলে জানান হিউ লোভাট। তিনি অঞ্চলটির ‘ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’র (ইসিএফআর) একজন বিশ্লেষক। গাজা যুদ্ধের ফলে লোহিত সাগরে চলাচল করা জাহাজে আক্রমণ শুরু করে ইয়েমেনের ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা। প্রতি বছর ১৭ হাজারের বেশি জাহাজ এই সাগর দিয়ে খাবার, ওষুধ, জ্বালানিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহণ করে থাকে, যা বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় ১২ শতাংশ। 

যুক্তরাজ্য ও তাদের অন্য আন্তর্জাতিক মিত্রদের নিয়ে ২০২৪ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে যৌথভাবে হুতিদের অবস্থান লক্ষ্য করে পাল্টা আক্রমণ চালায় আমেরিকা। এতে এটা স্পষ্ট যে, আমেরিকা বৈশ্বিক সমুদ্র রুটের মাধ্যমে নৌযান চলাচলের স্বাধীনতাকে অগ্রাধিকার দেয়। তিনি আরও বলেন, মিসরের সুয়েজ খাল এবং ইরানের অদূরে হরমুজের সরু প্রণালিও অত্যন্ত জরুরি। এই বৈশ্বিক সমুদ্রপথ মার্কিন অর্থনীতির জন্য এখনো গুরুত্বপূর্ণ।

ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকাকে সংযুক্ত করা মধ্যপ্রাচ্যে কৌশলগত অবস্থান মার্কিন বাণিজ্য ও সামরিক অভিযানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাহরাইন, কাতার এবং কুয়েতে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিও রয়েছে। ওয়াশিংটন ডিসির থিংক ট্যাংক ‘দ্য উইলসন সেন্টার’র মিডল ইস্ট প্রোগ্রামের ডিরেক্টর মেরিসা খুরমা বলেন, কোনো একক শক্তি যেন আধিপত্য বিস্তার করে এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে নিজেদের শক্তিশালী উপস্থিতি বজায় রেখেছে আমেরিকা।

তিনি বলেন, ঐতিহাসিকভাবে তেলের চাহিদা আর কমিউনিজমের প্রভাব রুখে দেওয়া- মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার মূল আগ্রহের কেন্দ্রে থাকলেও বর্তমানে এগুলোর বাইরে দেশটি তার প্রভাব এবং পরাশক্তি রক্ষা করতে চাইছে। অঞ্চলটি চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ক্ষমতা প্রতিযোগিতার মূল নাট্যমঞ্চ।

খুরমা আরও বলেন, অঞ্চলটি যে কী পরিমাণ অস্থিতিশীল গাজা-যুদ্ধ সেটাই স্মরণ করিয়ে দেয়, বিশেষ করে যখন ফিলিস্তিন-ইসরাইল দ্বন্দ্ব এবং এই অঞ্চলে ইরানের সামরিক সম্প্রসারণবাদদের মতো দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের সমাধানের ক্ষেত্রে আমেরিকা বিচ্ছিন্ন রয়েছে এবং রাজনৈতিকভাবেও নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্য ইনস্টিটিউটের (এমইআই) খালেদ এলগিন্ডি বলেন, এই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসী হুমকির প্রতিক্রিয়াতেই সাম্প্রতিক দশকগুলোতে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি দেখা গেছে। তবে ২০০১ সালে আমেরিকায় ৯/১১’র হামলা চালানোর কারণ হিসেবে সৌদি আরবে মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেছিল চরমপন্থি ইসলামী গোষ্ঠী আল-কায়েদা। ফলে হিংসাত্মক চরমপন্থার একটি প্রধান চালকও এটি বলে উল্লেখ করেন তিনি। যদিও আল-কায়েদাকে ধ্বংস করার জন্য মার্কিন যুদ্ধের বেশির ভাগই আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে কেন্দ্রীভূত থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যেও তারা তাদের কার্যক্রম ও জোটগত তৎপরতা চালিয়ে গেছে। আর অতি সম্প্রতি মার্কিন সমর্থিত একটি বৈশ্বিক জোট সিরিয়া ও ইরাকে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে ইসলামিক স্টেট (আইএস) গোষ্ঠীকে তাড়িয়ে দিতে স্থানীয় বাহিনীকে সমর্থন করেছে। ২০১৯ সালে দলটির প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদি উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় মার্কিন বিশেষ বাহিনীর অভিযানের সময় আত্মহত্যা করেন। এছাড়াও এই অঞ্চলটি হামাস ও হিজবুল্লাহসহ আমেরিকা ও অন্যান্য দেশ কর্তৃক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ আরও কয়েকটি গোষ্ঠীর আবাসস্থল। এলগিন্ডি বলেন, এই অঞ্চলে মার্কিন উপস্থিতি আইএস এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলোর জন্য ‘নিয়োগের একটি প্রধান হাতিয়ার’।

ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক থিংক ট্যাংক ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’র মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ নাতাশা হল বলেন, দুঃশাসন, আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাব আর মধ্যপ্রাচ্যে অত্যাচার ও সাম্রাজ্যবাদের ধারণার কারণেই সন্ত্রাসবাদ বিদ্যমান। আমেরিকা যখন সন্ত্রাসবাদের উপসর্গ দমনের চেষ্টা করে, কারণগুলোর সমাধান করে না। ফলে অনুমিতভাবেই তা অব্যাহত থাকে এবং বৃদ্ধি পায়।
ইসরাইল

গত ৬০ বছরের বেশির ভাগ সময়ই ইসরাইলের নিরাপত্তা আমেরিকার কাছে শীর্ষ-স্তরের অগ্রাধিকার পাচ্ছে বলে জানান এলগিন্ডি। আদর্শিক মিলের পাশাপাশি মার্কিন নেতাদের ওপর অভ্যন্তরীণ শক্তিশালী রাজনৈতিক চাপও ইসরাইলকে সমর্থনে ভূমিকা রেখেছে।

এসওএএসের আকসার বলেন, ইসরাইলের প্রতি ওয়াশিংটনের অব্যাহত সমর্থনও একটি ‘অত্যন্ত দক্ষ’ বিনিয়োগ। এতে করে আমেরিকা অঞ্চলটিতে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক মিত্র পেয়েছে। অবশ্য অতি সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন এবং তার আগে মিসরসহ ইসরাইলের প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ শান্তিচুক্তিতে মধ্যস্থতা করেছে আমেরিকা।
এলগিন্ডির মতে, বর্তমান ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ আমেরিকাকে আরও সরাসরিভাবে সম্পৃক্ত করেছে। যেমন ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে যুদ্ধজাহাজ পাঠানো কিংবা এপ্রিলে ইসরাইলের ওপর ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা প্রতিহত করা। তিনি আরও বলেন, ইসরাইলের প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ব্যক্তিগত এবং আদর্শিক প্রতিশ্রুতি ‘তর্কসাপেক্ষে ইতিহাসের যে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ছাড়িয়ে গেছে, যা তার নীতির দ্বন্দ্বকে ব্যাখ্যা করে।

বর্তমান গাজা যুদ্ধের আচরণ এবং লক্ষ্য- দুটো বিষয়ের কারণেই আমেরিকা ও ইসাইলের মধ্যে গুরুতর এবং ক্রমবর্ধমান পার্থক্য সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও বাইডেন প্রশাসন কার্যত প্রতিটি পর্যায়ে ইসরাইলের সামরিক অভিযানের জন্য প্রায় সীমাহীন সামরিক, রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সমর্থন প্রদান করে গেছে।

হল মনে করেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফিরে গেলে বর্তমান মার্কিন সমর্থনের পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন, ইসরাইলের প্রতি বর্তমান মার্কিন সমর্থনের কারণে আমেরিকাকে ‘ভণ্ডামির জন্য চ্যালেঞ্জ’ মোকাবিলা করে ‘আগামী বছর ও দশকগুলোতে ভূ-রাজনৈতিকভাবে চড়া মূল্য দিতে হবে’।
এরপর কী?

মধ্যপ্রাচ্যকে আমেরিকার কতটা অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত, তা নিয়ে ভিন্ন মত আছে। এলগিন্ডি বলেন, অদূর ভবিষ্যতের কোনো সময়ে অঞ্চলটি থেকে আমেরিকার সরে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এটি করার জন্য মার্কিন-ইসরাইল সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়নসহ ‘এক ধরনের প্যারাডাইম শিফট’ বা কাঠামোর পরিবর্তন প্রয়োজন।

এদিকে আকসারের মতে, আমেরিকার প্রস্থান যে শূন্যতা তৈরি করবে, চীন ও রাশিয়া তা পূরণ করতে পারে। তবে মধ্যপ্রাচ্যে সেনা মোতায়েনের বিষয়ে মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে সীমিত আগ্রহের কথা মাথায় রেখে অঞ্চলেটিতে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের মতো দূরবর্তী যুদ্ধের জন্য নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর দিকেই আমেরিকা নজর দিচ্ছে বলে মত এই বিশ্লেষকের।
ওয়াশিংটন ডিসির থিংক ট্যাংক ‘স্টিমসন সেন্টার’র কেলি এ গ্রিয়েকোর মতো কারও কারও মতে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহার করা উচিত। এতে করে ইন্দো-প্যাসিফিকের মতো যে জায়গাগুলোতে প্রয়োজন, সেখানে এই সম্পদ স্থানান্তর করা যাবে। তিনিও মনে করেন, মার্কিন হস্তক্ষেপের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা-বিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইসরাইলের প্রতি মার্কিন সমর্থন এই অঞ্চলে আমেরিকার ভাবমূর্তিকে আরও একটি ধাক্কা দিয়েছে। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ

যাযাদি/ এস