ভবিষ্যতে সৌর ঝড় বিপদের কারণ হতে পারে 

প্রকাশ | ২২ জুন ২০২৪, ১৬:২৯

যাযাদি ডেস্ক
সৌর ঝড়

আমরা যে গ্যালাক্সিতে বাস করি সেটি মিল্কিওয়ে। স্যার এডিংটনের মতে, এই মহাবিশ্বে প্রায় দশ সহস্রকোটি গ্যালাক্সি রয়েছে। এত এত গ্যালাক্সির সন্ধান পাওয়া আমাদের সাধ্যের আপাতত বাইরে। কারণ এই মহাবিশ্ব ক্রমাগত বাড়ছে। 

মহাবিশ্ব বৃদ্ধির এই রূপায়নটির নাম বিগ ব্যাং। যা আমরা পেয়েছি শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের কাছ থেকে। অতদূর না যাই, আমরা যেখানে বাস করি সেই পৃথিবী হলো সৌর জগতের একটি অংশ। আর সৌর জগতের কেন্দ্রবিন্দু হলো সূর্য। সূর্য হলো পৃথিবীর প্রাণের একমাত্র উৎস। 

এখন পর্যন্ত সূর্যের কোনো বিকল্প নক্ষত্র যা সূর্য কোনো কারণে নিভে গেলে বা ক্ষয়প্রাপ্ত হলে অথবা কোনো কারণে আলো দেওয়া বন্ধ করলে যে বিকল্প আমাদের সহায়তা করতে পারে তা আবিষ্কৃত হয়নি। কারণ নক্ষত্র তো একদিন ধ্বংস হয়। রূপ নেয় বস্ন্যাক হোলে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার তথ্য অনুযায়ী, সূর্যের ভেতরের বেশির ভাগটাই হাইড্রোজেন। 

পরমাণুর সংখ্যা হিসাবে এর পরিমাণ প্রায় ৯২ শতাংশ। সূর্যের কোর বা কেন্দ্রে হাইড্রোজেন নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ায় হিলিয়ামে রূপান্তরিত হয়। এ সময় বেরিয়ে আসে বিপুল শক্তি। সেই শক্তি চলে যায় সূর্যের বায়ুমন্ডলে। তারপর তাপ ও আলো হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে সৌরজগতে। বাইরে থেকে দেখতে সূর্য একটি জ্বলন্ত বলের মতো। 

সৌরপৃষ্ঠের তাপমাত্রা প্রায় সাড়ে ৫ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। যাই হোক আমাদের আজকের আলোচনা সৌর ঝড় নিয়ে। গত কিছুদিন ধরেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। চলতি বছরের মে মাসে সবচেয়ে শক্তিশালী সৌর ঝড় আঘাত করেছে। 

প্রায় ৪ লাখ বছর আগে, সূর্যের তিন-চতুর্থাংশ অংশ কিরণ পৃথিবীর বুকে এসে আলোকিত করে। নাসার বিজ্ঞানীদের একটি দল ২০১৬ সালে ২৩ মে নেচার পত্রিকায় প্রথম এই সৌর ঝড় নিয়ে গবেষণা। 

গত ৩ জুলাই প্রথম এই ভয়ংকর সৌর ঝড়ের ইঙ্গিত মেলে। বিজ্ঞানীরা দাবি করেন, ঘুম থেকে জেগে উঠেছে সূর্য। সেই সময় কয়েক লাখ টন প্রচন্ড গরম গ্যাস সূর্য থেকে ছড়িয়ে পড়েছে। সৌর ঝড়ের সময় সূর্য থেকে ছড়িয়ে পড়া গরম গ্যাসে ইলেকট্রিক চার্জ যুক্ত গ্যাস রয়েছে যেখান থেকে সৃষ্টি হয় চৌম্বকীয় তরঙ্গ। 

বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, এর জেরে বিশ্বের বেতার, জিপিএসের ওপর প্রভাব পড়তে পারে। ২০২০ সালে সূর্য এর ১১ বছরের নতুন সাইকেল শুরু করে। এই সাইকেল ২০২৫ সালে চরম পর্যায়ে পৌঁছবে। 

বেশ কয়েকটি করোনাল মাস ইজেকশনের (সিএমই) কারণে সূর্যের করোনা অঞ্চলে পস্নাজমা এবং চুম্বক ক্ষেত্রের বিস্ফোরণে বিপুল ভর ও শক্তি প্রবল বেগে মহাশূন্যের দিকে ছিটকে বেরিয়ে আসে। যার প্রথমটি গ্রিনিচ মান সময় ১৬০০টার পরে সূর্য থেকে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।

ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এনওএএ) স্পেস ওয়েদার প্রেডিকশন সেন্টার এ কথা জানায়। ২০০৩ সালের অক্টোবরের প্রথম ভূ-চৌম্বকীয় ঝড় 'হ্যালোইন স্টর্মস' সুইডেনে বিদু্যৎ সরবরাহ বিঘ্ন ঘটায় এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় বিদু্যৎ পরিকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরে এবারের এই ঝড়কে একটি 'চরম' ভূ-চৌম্বকীয় ঝড় হিসেবে উন্নীত করা হয়। 

সূর্যপৃষ্ঠ থেকে যখন বৈদু্যতিক ও চৌম্বকীয় বিকিরণ ছিটকে বেরোতে থাকে, তাকেই বলা হয় সৌরঝড়। তার সঙ্গে তীব্র শক্তি নির্গত হয়, যা পৃথিবীসহ গোটা সৌরজগতে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও এর সৌন্দর্য ধারণ করতে শত শত মানুষ ভিড় করেছে। 

সৌর ঝড়ের সময় আকাশজুড়ে এক ধরনের রঙিন আলোর দারুণ দৃশ্য তৈরি হয়। পৃথিবীতে মূলত উত্তর মেরুর দেশগুলোতে অরোরা দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু গত ১০ মে রাতে মেক্সিকো, দক্ষিণ ইউরোপ, এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকার আকাশেও দেখা গেছে রঙিন আলোর খেলা। 

সবুজ, গোলাপি, বেগুনি- নানা বর্ণের উজ্জ্বল অরোরার ছবিতে ছেয়ে গিয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়া পস্ন্যাটফর্মগুলো। এই অনিন্দ্য সুন্দর নর্দার্ন লাইট বা অরোরা দেখতে পর্যটকদের সাধারণত মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করতে হয়। এই চমৎকার অরোরা এর আগেও বহুবার দেখেছে বিশ্ববাসী। এর নাম অরোরা (অঁৎড়ৎধ), বাংলায় মেরুজ্যোতি। উত্তর গোলার্ধে এই মায়াবি আলোর নাম, অরোরা বোরিয়ালিস এবং দক্ষিণ গোলার্ধে এর নাম অরোরা অস্ট্রালিস। 

সৌরঝড় থেকে উৎপন্ন চার্জড পর্টিকেল, যেগুলো মূলত ইলেকট্রন এবং প্রোটন, পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের প্রভাবে দুই মেরুতেই আকর্ষিত হয়। তবে বিজ্ঞানীরা কিন্তু এই সৌর ঝড়ের পেছনে শুধু সুন্দর দৃশ্যই দেখছেন না বরং বিপদের আঁচও করেছেন।

অন্তত এবার বিজ্ঞানীরা জানিয়েছে কয়েকটি শংকার কথা। যুক্তরাষ্ট্রের স্পেস ওয়েদার প্রেডিকশন সেন্টারের মাইক বেটউইয়ের কথায়, আমরা সৌরঝড়ের আরও ভয়ংকর সম্ভাব্য প্রভাবের দিকে মনোনিবেশ করছি; যেমন- পাওয়ার গ্রিড ও স্যাটেলাইট অচল হয়ে যাওয়া বা নভোচারীরা বিপজ্জনক মাত্রায় বিকিরণের সম্মুখীন হওয়া। 

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওসেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনওএএ)-এর স্পেস ওয়েদার প্রেডিকশন সেন্টারের মতে, গত ১০ মে বাংলাদেশ সময় রাত ১০টার পর থেকে বেশ কয়েকটি করোনাল ম্যাস ইজেকশন (সিএমই)-এর ঘটনা ঘটে। পরে এটি 'মারাত্মক' ভূ-চৌম্বকীয় ঝড়ে রূপান্তরিত হয়। 

২০০৩ সালের অক্টোবরে তথাকথিত 'হ্যালোইন স্টর্মস'-এর পরে এ ধরনের ঘটনা ছিল এটিই প্রথম। ২১ বছর আগের ওই সৌরঝড়ে সুইডেনে বস্নযাকআউট এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় বিদু্যৎ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। 

সাম্প্রতিক সৌরঝড়টি এসেছিল পৃথিবীর আকার থেকে ১৭ গুণ বড় একটি সানস্পট ক্লাস্টার থেকে, যা এখনো সক্রিয় রয়েছে। গত মঙ্গলবার এটি বছরের মধ্যে দেখা সবচেয়ে শক্তিশালী সৌরশিখার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। সানস্পটটি সর্ুযের ডিস্কের প্রান্তের দিকে ঘুরছে। তাই আশা করা হচ্ছে, সাময়িকভাবে এর প্রভাব বন্ধ হবে। কারণ এর বিস্ফোরণগুলো আমাদের গ্রহ থেকে দূরে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। 

রেকর্ড বলছে, ২০১২ সালেও একটি শক্তিশালী সৌর ঝড় পৃথিবীতে আঘাত করেছিল। বিজ্ঞানীদের মতে, এই ঝড়ের সাথে বিপুল পরিমান সৌর কণা প্রতি সেকেন্ডে ১৬০০ কিলোমিটার বেগে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসে। যেহেতু সরাসরি মানুষর উপর সৌর ঝড়ের প্রভাব পরে না তাই মানুষ এই সম্পর্কে খুব কমই জানে। 

তবে অদূর ভবিষ্যতে যে সৌর ঝড়ের আরও মারাত্বক প্রভাব পড়বে না পৃথিবীর যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর বিশেষত টেলিকমিউনিকেশনস অথবা স্যাটেলাইট ইত্যাদির উপর তা কে বলতে পারে। তবে আপাতত এসব ঝড় ঠেকানোর উপায় জানা নেই বিজ্ঞানীদের।

যাযাদি/ এম