ডেঙ্গুতে নভেম্বরে বছরের সর্বোচ্চ ১৭০ জনের মৃত্যু 

আক্রান্ত প্রায় সাড়ে ৯১ হাজার

প্রকাশ | ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:২৮

পাঠান সোহাগ
ছবি: সংগৃহীত

দেশে বছরজুড়েই চলছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। বর্ষা মৌসুম পেরিয়ে শেষ হেমন্তে এসেও প্রতিদিন বাড়ছে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। সেই সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুও। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, চলতি বছর অক্টোবর মাসে সবচেয়ে বেশি ৩০ হাজার ৮৭৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আর চলতি নভেম্বরের ২৯ দিনেই সর্বোচ্চ ১৭০ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ডেঙ্গু। এছাড়া গত একদিনে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৫৪ জন এবং মারা গেছেন ৩ জন। 

তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে সবচেয়ে বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তির পাশাপাশি মৃত্যু হয় ১৩৫ জনের। এদিকে, নভেম্বরের ২৯ দিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৮ হাজার ৯৭৭ জন। এ সময়ে মৃত্যু হয়েছে ১৭০ জনের। যা এ বছরের সর্বোচ্চ। এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯০ হাজার ৭৯৪ জনে। এদের মধ্যে মারা গেছেন ৪৮৫ জন।
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশার আচরণগত পরিবর্তন এসেছে। এছাড়া ২০০০ সালে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হলেও দীর্ঘ দুই যুগে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জাতীয় পরিকল্পনা গড়ে না ওঠা এবং আক্রান্ত রোগীরা শেষ সময়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ায় মৃত্যু বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, সাধারণত দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বর্ষার আগে শুরু হয়। মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়কে ডেঙ্গুর মৌসুম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে গত কয়েক বছর ধরে সারা বছরই কম-বেশি ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সারা বছরই ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ডেঙ্গু মশা শীত-গ্রীষ্ম মানছে না, সারা বছর প্রজনন এবং বংশবিস্তার করছে। পাশাপাশি মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর সমন্বিত জাতীয় উদ্যোগ না থাকার ফলে দেশে বছরব্যাপী ডেঙ্গু সংক্রমণ চলছে।  

অতীতের বছরগুলোতে শহরের বাসা-বাড়িতে আবাসিক ধরনের মশা (এডিস ইজিপটাই) ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটালেও, বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের বুনো মশাও (এডিস এলবোপিকটাস) ডেঙ্গুর বাহক হিসেবে কাজ করছে। গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটলেও যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ না করায় ডেঙ্গু ভয়াবহ হয়ে উঠেছে বলেও দাবি করেছেন তারা। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৫৫ জন। তাদের মধ্যে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৩৯ জন এবং মারা গেছেন ৩ জন। মার্চ মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৩১১ জন এবং মারা গেছেন ৫ জন। এপ্রিলে আক্রান্ত হয়েছেন ৫০৪ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। মে মাসে ৬৪৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন ১২ জন। জুন মাসে ডেঙ্গুজ¦রে আক্রান্ত হয়েছেন ৭৯৮ জন এবং মারা গেছেন ৮ জন। জুলাই মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৬৩৯ জন এবং মারা গেছেন ১২ জন। জুলাই মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৬৬৯ জন রোগী এবং মারা গেছেন ১২ জন। আগস্টে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬ হাজার ৫২১ জন এবং মারা গেছেন ৩০ জন। সেপ্টেম্বরে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৮ হাজার ৯৭ জন। আর এ মাসে মারা গেছেন ৮৭ জন।  

তথ্য বলছে, পুরুষের তুলনায় নারীরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন কম। কিন্তু পুরুষের তুলনায় নারীর মৃত্যু হার বেশি। 
চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৬ দশমিক ৮ শতাংশ নারী। তবে আক্রান্তের মধ্যে মারা গেছেন ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ। পাশাপাশি ৬৩ দশমিক ২ শতাংশ পুরুষ আক্রান্ত হলেও মারা গেছেন ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ।

এ বিষয়ে কীটতত্তবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘আমরা আগেই বলেছি চলতি বছর ডেঙ্গুর মৌসুম দীর্ঘায়িত হবে। আমরা যে ফরকাস্টিং তৈরি করি, সেখানে এডিস মশার ঘনত্ব, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা মিলিয়ে করি। সেখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু থাকবে। এই প্রকোপ আগামী বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত চলবে।’

তিনি বলেন, ‘বছরের এই সময়টা সবচেয়ে বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এমনকি মারাও যাচ্ছেন বেশি। ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। পিক সিজনও বলা যেতে পারে। আক্রান্ত রোগীরা সঠিক সময়ে হাসপাতালে না আসায় মৃত্যু বাড়ছে।’   
রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) বর্তমান উপদেষ্টা এবং সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক ডা. মো. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘বছরব্যাপী ডেঙ্গুর সংক্রমণের কারণ প্রথমত প্রাকৃতিক। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেও বৃষ্টি এবং গরম অব্যাহত ছিল। বৃষ্টিপাতের পরেও ডেঙ্গু অন্তত দেড় থেকে দুই মাস থাকে। শেষ বৃষ্টির পরে পানি জমা থাকা অবস্থায় মশা যে ডিম পাড়ে, সেই ডিম থেকে পূর্ণ বয়স্ক মশা হয়ে কোনো ডেঙ্গুরোগীকে দংশন করলে ভাইরাসটি সেই মশার শরীরে ডেভেলপ করে। আবার যখন কোনো মানুষকে মশা দংশন করে তখনো ভাইরাস ডেভেলপ হয়, এই পুরো চক্রটি হতে প্রায় দেড় মাস সময় লাগে।’

তিনি বলেন, ‘রোগীরা শেষ মুহূর্তে চিকিৎসার আওতায় আসছে। এ কারণেও মৃত্যু বাড়ছে। আগামীতে ডেঙ্গু আরও মারাত্মক হতে পারে। আমাদের দেশে রোগী কম হলেও মৃত্যুহার বেশি।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য তথ্য ইউনিটের (এমআইএস) ইনচার্জ ডা. মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম জানান, ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ৪৮২ জনের মধ্যে ৩৩১ জনেরই মৃত্যু হয়েছে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে মৃত্যু হয়েছে ২০২ জনের। এছাড়া উত্তর সিটিতে ৮৯ জন ও ঢাকা জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ৪০ জন মারা গেছেন। ঢাকার বাইরে সর্বোচ্চ ৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে বরিশাল বিভাগে। তারপর চট্টগ্রাম বিভাগে ৪৮ জন রয়েছেন। এছাড়া খুলনা বিভাগে মৃত্যু হয়েছে ২৭ জনের। ময়মনসিংহ বিভাগে ১৩ জন, রাজশাহীতে ৬ জন এবং রংপুর বিভাগে ২ জন মারা গেছেন।

চলতি বছরে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ৪৮২ জনের মধ্যে শূন্য থেকে ১০ বছরের নিচে ৪২ জন, ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে ৩৯ জন, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ৯১ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ৮১ জন, ৪১ থেকে ৫০ মধ্যে ৭৪ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সের মধ্যে ৭৫ জন, ৬১ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে ৪৪ জন, ৭১ থেকে ৮০ বছরের মধ্যে ২৭ জন এবং ৮০ বছরের বেশি বয়সের ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।

যাযাদি/ এসএম