গত বছরের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভালো হলেও জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে এ চিত্রের বড় পরিবর্তনের আশঙ্কা রয়েছে। জনস্বাস্থ্যবিদ ও কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত বছর পিক-সিজনে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু যে হারে বেড়েছে, এ বছর একই সময়ে তা কয়েক গুণ বাড়তে পারে। অথচ এবারও ডেঙ্গু মোকাবিলার আগাম প্রস্তুতি বরাবরের মতোই দায়সারা।
কীটতত্ত্ববিদরা জানান, মশা প্রজননের জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা হচ্ছে ২৫-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা যদি ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে হয়, তখন যেকোনো মশার প্রজনন কমে যায়। তাপপ্রবাহে মশার প্রজনন কমলেও বৃষ্টিপাত হলেই মশার প্রজনন বাড়তে শুরু করে। দেশে সাধারণত জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর- এই তিন মাস ডেঙ্গুর জন্য উচ্চ ঝুঁকি থাকে। এ সময়টাতে বৃষ্টি হয়, মশার প্রজননের জন্যও তাপমাত্রা উপযুক্ত থাকে। এ বছর বৃষ্টির যে চলমান গতি-প্রকৃতি ও আগাম পূর্বাভাস তাতে এডিস মশার প্রজনন বহুগুণ বাড়বে।
এ পরিস্থিতিতে বর্ষার গতি-প্রকৃতির পূর্বাভাস, ডেঙ্গু মোকাবিলায় সিটি করপোরেশন-পৌরসভা, স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য বিভাগের দায়সারা প্রস্তুতি পর্যালোচনা করে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা জানান, ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েক দিন বৃষ্টি হওয়ায় এডিস মশার ঘনত্ব বেড়েছে। কীটতত্ত¡বিদদের মাঠপর্যায়ের পর্যবেক্ষণে এ তথ্যের প্রমাণ মিলেছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, চাঁদপুর, বরিশাল, বরগুনা, গাজীপুর ও ঢাকার মশার ঘনত্ব, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং বৃষ্টি- এই কয়েক প্যারামিটারকে বিশ্লেষণ করে ফোরকাস্টিং মডেল থেকে দেখা যাচ্ছে, ডেঙ্গু পরিস্থিতি গতবারের চেয়ে এবার আরও বেশি ভয়াবহ হতে পারে। বিশেষ করে আবহাওয়াবিদদের আশঙ্কা অনুযায়ী যদি এবার বর্ষায় বেশি বৃষ্টিপাত হয় এবং সময়মতো জোরালো পদক্ষেপ না নেওয়া হয়।
তবে কীটতত্ত্ববিদরা কেউ কেউ বলছেন, বর্ষায় বৃষ্টিপাত কেমন হবে তার ওপর ডেঙ্গু পরিস্থিতি অনেক খানি নির্ভর করছে। কেননা অতিবৃষ্টি এডিস মশার ঘনত্বকে কমিয়ে দেয়। আবার থেমে থেমে বৃষ্টি এডিস মশার ঘনত্বকে বাড়ায়। তাদের ভাষ্য, আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল এখন অনেক উন্নত ও আধুনিক হয়েছে। সেসব মডেল বিশ্লেষণ করে এবারের বৃষ্টিপাত কেমন হবে, সেই ধারণা থেকে ডেঙ্গু মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। অথচ বাস্তবে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি।
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার এ প্রসঙ্গে বলেন, এখনই যদি এডিসের বংশ বৃদ্ধি হওয়ার স্থানগুলো যথাযথ ব্যবস্থাপনায় না নেওয়া হয়, তাহলে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে তা চিন্তা করলেই শিউরে উঠতে হয়। সব পরিসংখ্যানের বিশ্লেষণে এটা খুব সহজেই বলা যায়, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে এ শ্রেণির ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করার যথাযথ কারণ আছে। এ নাজুক পরিস্থিতিতে সমন্বিত বাহক ব্যবস্থাপনার যথাযথ ব্যবহার ছাড়া আর কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ভয়ংকর গাণিতিক বৃদ্ধির বিপরীতে যতগুলো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা আছে তার সবগুলোরই উপযুক্ত প্রয়োগ আবশ্যক। নিশ্চিত করতে হবে ক্রমবর্ধমান মশার প্রজনন ক্ষেত্রের নিয়মিত ধ্বংস ও ম্যানেজমেন্ট। এটি কঠিন কাজ হলেও সবার সমন্বিত কার্যক্রমে অসম্ভব নয়।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারীরা জানান, মশক প্রজনন ক্ষেত্র এখন শুধু ঢাকা বা সিটি করপোরেশনেই সীমাবদ্ধ নয়। এটা এখন ৬৪ জেলারই সমস্যা। ঢাকার অবকাঠামো, লোকবল এবং প্রশাসনিক তৎপরতার চেয়ে গ্রামীণ বা জেলা, উপজেলাগুলোয় ব্যবস্থাপনা দুর্বল। তাই অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে জাতীয় স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা জরুরি। প্রতিটি স্থানে ভেক্টর সার্ভিল্যান্সের নিয়মিত তৎপরতার মাধ্যমেই নিতে হবে ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি। যেখানে লার্ভিসাইড স্প্রে করা প্রয়োজন সেখানে নিয়ম করে লার্ভা ধ্বংস প্রক্রিয়া সক্রিয়ভাবে চালু রাখতে হবে। যেখানে এডাল্টি সাইড প্রয়োগ করতে হবে সেখানে নিয়মিতভাবে সঠিক সময়ে সঠিক নিয়মে, সঠিক ডোজে যথাযথ তদারকির মাধ্যমে প্রয়োগ করতে হবে। যেখানে বায়োলজিক্যাল এজেন্ট বা বায়োকন্ট্রোল এজেন্ট ব্যবহার প্রয়োজন সেখানে অবশ্যই তা নিশ্চিত করতে হবে। মশার প্রাকৃতিক শত্রু সংরক্ষণ করে যেখানে প্রাকৃতিকভাবেই এডিস মশার বংশবিস্তার রোধ করা সম্ভব সেখানে কনজারভেটিভ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। নতুন প্রণীত জাতীয় স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানের মিশন ভিশন সামনে রেখে যতগুলো দায়িত্বপূর্ণ গ্রæপ আছে সবাইকে কাজে লাগানোর আগাম পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। অথচ এসব ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি।
কীটতত্ত্ব বিদদের দাবি, চলতি বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতির যে ভয়াবহ রূপ নেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তা মোকাবিলায় দেশের প্রতিটি এলাকায় দ্রুত সার্ভিল্যান্স, ভেক্টর কন্ট্রোল ও সুপারভিশন- এই তিনটি টিম গঠন করা উচিত। সার্ভিল্যান্স টিমের সদস্যরা নির্দিষ্ট সংখ্যক বাড়িতে যাবেন। সেখানে এডিস মশার ঘনত্ব পরীক্ষা করবেন। ভেক্টর কন্ট্রোল দলের সদস্যরা সার্ভিল্যান্স টিমের তথ্য কাজে লাগাবেন। এ ছাড়া তারা নির্মাণ এলাকায় কীটনাশক ছিটাবেন।
এছাড়া প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও রোগনির্ণয় কেন্দ্র ডেঙ্গু শনাক্তে কাজ করার জন্য একাধিক টিম গঠন করা জরুরি। যাতে কোনো রোগনির্ণয় কেন্দ্রে কোনো রোগীর ডেঙ্গু শনাক্ত হয়, তাহলে তাদের তথ্যের ভিত্তিতে ওই রোগীর বাড়িতে ও বাড়ির আশপাশের বাড়িগুলোয় মশার ওষুধ ছিটাবে। আর কোনো সম্ভাব্য রোগী আছে কিনা, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, ডেঙ্গু এখন আর কোনো মৌসুমি রোগ নয়। এটি সারা বছরের রোগ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, অভিবাসন- এসব কারণে সারা বছর ডেঙ্গু ঝুঁকি থাকে। সুতরাং কাজটি বছরজুড়ে চলমান রাখা উচিত। অথচ দেশে ডেঙ্গু মোকাবিলায় তৎপরতা শুরু হয় শুধুমাত্র যখন তা ভয়াবহ রূপ নেয়। ফলে তাৎক্ষণিক এ তৎপরতায় সফলতা অধরাই থাকে।
এদিকে ডেঙ্গু মোকাবিলায় সাধারণ জনগণকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুক্ত করতে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন ও লিফলেট ছাপানো ছাড়া তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। ফলে জনসচেতনতা তৈরি করা যায়নি। ডেঙ্গু মোকাবিলার কাজে জনপ্রতিনিধিদেরও জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করা হয়নি। এমনকি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সাধারণ মানুষের করণীয় কী তা স্পষ্ট করারও উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের।
অথচ কীটতত্ত্ববিদরা এ ব্যাপারে বারবার তাগিদ দিয়ে বলছেন, মানুষের ধারণা রাতে এডিস মশা কামড়ায় না এবং এ মশা শুধু স্বচ্ছ মিষ্টি পানিতেই বংশ বিস্তার করে। কিন্তু সম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, এডিস মশার স্বভাব বদলেছে। এরা রাতেও কামড়ায়; লোনা পানিতে, এমনকি নোংরা পানিতেও ডিম পাড়ে। তাই এসব বিষয়ে সাধারণ মানুষকে নতুনভাবে সচেতন করা জরুরি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার এ প্রসঙ্গে বলেন, এডিস মশা স্বভাব বদলেছে। তাই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে পরিবর্তন আনতে হবে। এ বছর গ্রামে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে।
এই কীটতত্ত্ববিদ আরও বলেন, গ্রামে ডেঙ্গু ছড়ায় মূলত এডিস অ্যালবোপিকটাস। এখন গবেষণা করে দেখা দরকার, এডিস অ্যালবোপিকটাস বেশি পরিমাণে ডেঙ্গুর জীবাণু বহন করার সক্ষমতা অর্জন করেছে কিনা। মশার ওষুধের অকার্যকারিতার তথ্য তুলে ধরে তিনি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নতুন পথে হাঁটার তাগিদ দেন।
এদিকে এডিস মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণে জলাবদ্ধতা দূরীকরণ সবচেয়ে বেশি জরুরি হলেও বরাবরের মতো এবারও এ ব্যাপারে দায়সারা প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ফলে গত কয়েক দিনের সামান্য বৃষ্টিতে বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে এডিস মশার প্রজনন বেড়েছে। অথচ এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন গালভরা বক্তব্য দিয়েই তাদের দায়িত্ব এড়াচ্ছেন।
জলাবদ্ধতার সমস্যা নিরসনে বিভিন্ন সময়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নেওয়া নানা ‘অকার্যকর’ উদ্যোগ ও ‘লোক দেখানো’ তৎপরতার সমালোচনা করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সত্যিকার অর্থে এই সমস্যার সমাধানে দুই সিটি করপোরেশনের সমন্বিত কোনো পরিকল্পনাই নেই। পরিকল্পনা ছাড়াই বিচ্ছিন্নভাবে তারা বিভিন্ন সময় যে উদ্যোগগুলো নিয়েছে, তাতে জনসম্পৃক্ততার কোনো জায়গা ছিল না। যদিও মাঝেমধ্যে একটি-দু’টি খাল কিংবা নালার আবর্জনা পরিষ্কার করে বারবার নগরবাসীকে সমস্যা সমাধানে আশ্বস্ত করেছেন মেয়ররা, কিন্তু বাস্তবে সমাধান হয়নি। এভাবে প্রতিনিয়ত দুই সিটির মেয়র নগরবাসীর সঙ্গে প্রতারণা ও প্রহসন করে চলেছেন। সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে ঢাকা সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকার জলাবদ্ধতা ৭০ থেকে ১০ ভাগে নেমে এসেছে- মেয়রদের এমন দাবির কোনো ভিত্তি নেই বলেও মন্তব্য করেন তারা।
জলাবদ্ধতার সমস্যা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে দুই মেয়রের সফলতার দাবি প্রসঙ্গে নগরবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, ‘এই সমস্ত অঙ্ক যারা দেন, তাদের উচিত এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া যে, তারা কোথা থেকে জানলেন ৯০ শতাংশ জলাবদ্ধতা কমে গেছে? এর ভিত্তি কী? রিসার্চটা কোথায়?’ বিভিন্ন সময় ঢাকঢোল পিটিয়ে দুই সিটি করপোরেশন খাল পরিষ্কার কিংবা দখলমুক্ত করার যে উদ্যোগগুলো নিয়েছে, তার কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন এই স্থপতি।
নগর পরিকল্পনাবিদদের এ তথ্যকে ভিত্তি করে জনস্বাস্থ্য ও কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, নগর-মহানগরের জলাবদ্ধতা দূরীকরণের যে চিত্র ওঠে এসেছে, তাতে এবারে পিক সিজনে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়ংকর রূপ নেওয়ার জোরালো আশঙ্কা রয়েছে।
যাযাদি/ এসএম