দেশে মানুষের রোগব্যাধি বাড়ছে, বেঁচে থাকার তাগিদে ওষুধের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। রোগব্যাধি নিরাময়ে প্রয়োজনীয় ওষুধের বাজার তৈরি হয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার। এই বিশাল টাকার অঙ্কের ওষুধের বাজার ধরতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে নতুন নতুন ছোট-বড় ব্যবসায়ী। ক্ষুদ্র পরিসরে ফার্মেসি দিয়ে শুরু হচ্ছে ওষুধের ব্যবসা। সরকারি হিসেবে দেশে এখন ফার্মেসি আছে ২ লাখ ৪০ হাজারের ওপরে। এর মধ্যে ঢাকায় আছে ১ লাখের ওপরে। বাকি ফার্মেসি আছে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ান পর্যায়ে। উপজেলা শহরে গড়ে ৩০০ ফার্মেসি রয়েছে। এমন কি গত দেড় বছরে ১ লাখ ২২ হাজার নতুন ফার্মেসি হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ২২০-এর ওপরে ফার্মেসি অনুমোদন দিচ্ছে সরকার। এসব ওষুধের দোকানে দেদার বিক্রি করছে অ্যান্টিবায়োটিক। তাদের কেউ মানছে না ওষুধ বিক্রির নীতিমালা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সায়েদুর রহমান খসরু যায়যায়দিনকে বলেন, ‘দেশে ২০২২ সালের শেষের দিকে ফার্মেসি ছিল ১ লাখ ১৮ হাজার। সেটা এখন গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৪০ হাজারের ওপরে। আমাদের শাহবাগে যত ফার্মেসি আছে, এক আমেরিকায় এত ফার্মেসি নেই।’
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আসরাফ হোসেনের কাছে লাইসেন্সপ্রাপ্ত মডেল ফার্মেসি ও মেডিসিন শপের প্রকৃত সংখ্যা জানতে চাইলে যায়যায়দিনকে তিনি বলেন, দেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত মডেল ফার্মেসি ও মেডিসিন শপ আছে ২ লাখের কিছু বেশি। এখন মডেল ফার্মেসি ছাড়া অন্য কোনো ওষুধের দোকানের অনুমোদন আর দেওয়া হচ্ছে না।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ওষুধের দোকান বেশি হওয়া ভালো না। কারণ দেশে যত ওষুধের ফার্মেসি হবে তাতে দোকানিরা দেদার বিক্রি করবে অ্যান্টিবায়োটিকসহ অন্যান্য ওষুধ। কিন্তু সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী চাইলেই কোনো ফার্মেসি ক্রেতার কাছে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করতে পারবে না। অ্যান্টিবায়োটিক কেনার জন্য অবশ্যই রেজিস্ট্রার চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন বা ব্যবস্থাপত্র থাকতে হবে। আমাদের দেশে যেটা হচ্ছে, ওষুধ বিক্রি করতে করতে তারাই পরবর্তীতে ডাক্তার হয়ে যাচ্ছেন। তারাই ক্রেতার কাছে তাদের পছন্দ মতো ওষুধ বিক্রি করছেন। এতে দেখা যায়, রোগীরা পরবর্তীতে অন্য জটিল রোগের ঝুঁকিতে পড়ছেন।’
ড. সায়েদুর রহমান খসরু বলেন, ‘উন্নত দেশে ফার্মেসি করতে গেলে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট লাগে। আমাদের দেশে তিন মাসের ট্রেনিংয়ে ফার্মেসি করছে। ফার্মাসিস্টের কাজ হলো ওষুধ রক্ষণাবেক্ষণ করা, বিপণন ও ওষুধের কার্যকরী তথ্য রোগীকে অবহিত করা। আমাদের এগুলো কয়জনে মানছেন। দেশে ফার্মেসি হচ্ছে না এগুলো মুদির দোকানে ওষুধ বিক্রি হচ্ছে।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী যায়যায়দিনকে বলেন, ‘দেশে এত ফার্মেসি হলো কিন্তু তাতে কি প্রশিক্ষিত জনবল আছে? ফার্মেসি চালাতে হলে নিয়মেই আছে গ্র্যাজুয়েট বা ডিপ্লোমা ডিগ্রিপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্টদের দ্বারা পরিচালনা করতে হবে। আমরা এমন জনবল তৈরি করতে পারছি না। দেখা যাচ্ছে টাকার বিনিময়ে এক ফার্মাসিস্টের নাম ব্যবহার করে তিন থেকে ছয়টা মডেল ফার্মেসির জন্য আবেদন করেন এবং অনুমোদনও পেয়ে যান। বাস্তবে কোথাও তাদের উপস্থিতি পাওয়া যায় না।’
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর বলছে, রাজধানীসহ সারাদেশে ‘এ’ ও ‘বি’ এই দুই ক্যাটাগরিতে ফার্মেসির লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। এ-ক্যাটাগরির মডেল ফার্মেসির আয়তন ১৫ ফুট বাই ১০ ফুট এবং বি-ক্যাটাগরির ফার্মেসির আয়তন হবে ১০ ফুট বাই ৯ ফুট। মডেল ফার্মেসিগুলো এই দুই ক্যাটাগরিতে রাখা ভালো। কোল্ড চেইন অনুসরণ করে ওষুধ সংরক্ষণ ও প্রতিটি বিক্রীত ওষুধের হিসাব রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। মডেল ফার্মেসি গ্র্যাজুয়েট বা ডিপ্লোমা ডিগ্রিপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্টদের দিয়ে পরিচালিত হয়। ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) ওষুধ ব্যতীত অন্য কোনো ওষুধ প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি করা নিষেধ।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, ছোট-বড় উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীদের আমদানিকৃত ও উৎপাদিত ওষুধ বিক্রি হয় পাড়া-মহল্লার ওষুধের ফার্মেসিতে। দেশব্যাপী মডেল ফার্মেসি সম্প্রসারণের মাধ্যমে ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে কাজ করছেন তারা। এছাড়াও মডেল ফার্মেসি থেকে নিরাপদ মানসম্পন্ন ওষুধ পাওয়ার বিষয়টা নিশ্চিত করতে তারা কাজ করছেন।
ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক খেলে কিংবা কোর্স সম্পন্ন না করলে পরবর্তীতে এই অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করে না। তাই ওষুধের দোকান থেকে এন্টিবায়োটিকের মতো কোনো ওষুধ কিনে না খাওয়াই ভালো।
ওষুধ ব্যবসায়ী ও ফার্মেসির দোকানিরা বলেছেন, ওষুধের ব্যবসায় ঝুঁকি কম। লাভও আছে। অন্য ব্যবসায় যেমন পুঁজি হারানোর ভয় থাকে এ ব্যবসায় সেটা নেই। তাই ওষুধের ব্যবসায় ঝুঁকছেন অনেকে। তাদের মতে, শুধু মাত্র রাজধানী ঢাকায়ই ফার্মেসি আছে ১ লাখের ওপরে। এসব বেশিরভাগ ওষুধের দোকানে ফার্মাসিস্ট নেই। যারা ওষুধ বিক্রি করেন তারা অন্য ফার্মেসি থেকে দেখতে দেখতে শিখেছেন, পরে নিজেরাই ফার্মেসি দিয়েছেন। সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন তারা। অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি প্রসঙ্গে তারা বলেন, ‘সবাই তো প্রেসক্রিপশন নিয়ে আসে না। যদি কেউ ওষুদের নাম বলতে পারেন তাহলে তাদের আমরা ওষুধ দেই।’
যাযাদি/ এসএম