বদলে যাওয়া মৌসুমী

২০১৩ সালে 'না মানুষ' নামের চলচ্চিত্রের মাধ্যমে অভিষেক হয়েছিল মৌসুমী হামিদের। কিন্তু চলচ্চিত্রটির নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চলচ্চিত্রটি আর মুক্তির আলোর মুখ দেখতে পারেনি। এবার যেন সেই 'না মানুষ' সিনেমা মুক্তি না পাওয়ার কষ্টটা ভুলতেই 'নয়া মানুষ' সিনেমায় অনেক খাটাখাটুনি করলেন মৌসুমী। যার মধ্য দিয়ে করা এমন একটি জীবনঘনিষ্ঠ সিনেমা তার ক্যারিয়ারে নতুন মাত্রার যোগ হতে পারে।

প্রকাশ | ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

মাতিয়ার রাফায়েল
অবশেষে সোহেল রানা বয়াতির পরিচালনায় নির্মিত 'নয়া মানুষ' সেন্সর সার্টিফিকেশন বোর্ড থেকে আনকাট সনদ পেল গত ২৩ অক্টোবর। পরিচালক জানিয়েছেন, মৌসুমী হামিদ ও রওনক হাসান অভিনীত সিনেমাটি এ বছরেই প্রেক্ষাগৃহে আসছে। চলতি বছরের এপ্রিলে শুটিং শেষ হওয়া চরের মেহনতি মানুষের জীবন ও প্রকৃতির খেয়ালিপনার বিভিন্ন দিক নিয়ে আ. মা. ম. হাসানুজ্জামানের 'বেদনার বালু চরে' গল্প অবলম্বনে মাসুম রেজার চিত্রনাট্যে নির্মিত এই সিনেমাটিতে মৌসুমী ধরা দিয়েছেন সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া অন্য এক মৌসুমী রূপে। চলচ্চিত্রটি নিয়ে বয়াতি বলেন, 'বানভাসি মানুষের গল্প 'নয়া মানুষ' গল্পের মতোই নানা দুর্যোগ মোকাবিলা করে চলচ্চিত্রটি আনকাট মুক্তির অনুমতি পেয়েছে। নির্মাণের বিভিন্ন পর্যায়ে যারা পাশে ছিলেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। দ্রম্নত সময়ে চলচ্চিত্রটি দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিতে চাই।' 'নয়া মানুষ' সিনেমাটিতে সুজলা চরিত্রে আসছেন মৌসুমী হামিদ। ছবিটি সম্পর্কে মৌসুমী বলেন, 'চরের মানুষের জীবনের গল্প নিয়ে 'নয়া মানুষ' সিনেমা। বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাহিনী। আমিও তাদেরই একজন। চরের মধ্যে অনেক কষ্ট করে শুটিং করেছি। সারা দিন শুটিং করতে হয়েছে। চরের মধ্যেই থেকেছি। তবে একজন অভিনেত্রী হিসেবে কষ্টটা উপভোগ করেছি। আশা করছি, সিনেমাটি মুক্তি পেলে সবার ভালো লাগবে।' বাংলাদেশে 'নয়া কৃষি' নামের একটি আন্দোলন শুরু হয়েছিল কয়েক দশক আগে। যে কৃষি ব্যবস্থায় থাকবে না কোনো পশ্চিমা ক্ষতিকারক কীটনাশক। সেই 'নয়া কৃষি'র নয়া মানুষ বা নয়া কৃষিজীবীদের কাজ এখনো অব্যাহত আছে। এই নয়া মানুষের নয়া কৃষিজীবীরা থাকেন মাঠে, চরে, ক্ষেতে-খামারে। এবার রুপালি পর্দায় ধরা দিল 'নয়া মানুষ'। ২০১৩ সালে 'না মানুষ' নামের চলচ্চিত্রের মাধ্যমে অভিষেক হয়েছিল মৌসুমী হামিদের। কিন্তু চলচ্চিত্রটির নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চলচ্চিত্রটি আর মুক্তির আলোর মুখ দেখতে পারেনি। এবার যেন সেই 'না মানুষ' সিনেমা মুক্তি না পাওয়ার কষ্টটা ভুলতেই 'নয়া মানুষ' সিনেমায় অনেক খাটাখাটুনি করলেন মৌসুমী। যার মধ্য দিয়ে করা এমন একটি জীবনঘনিষ্ঠ সিনেমা তার ক্যারিয়ারে নতুন মাত্রার যোগ হতে পারে। ৪০/৫০টি পরিবার নিয়ে বসতি গড়া এমন একটি প্রত্যন্ত এলাকায় কমল চন্দ্র দাসের চিত্রগ্রহণে তৈরি এই চলচ্চিত্রটি এখন প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনীর অপেক্ষায়। সিনেমাটির দৃশ্যায়নও দারুণ মনোহর। চাঁদপুরের মতলব উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের এক দুর্গম এলাকা কানুনদির চর। যেখানে বিদু্যতের ছোঁয়া নেই। মোবাইল নেটওয়ার্কও দুর্বল। নদীর এ কূল ভেঙে ও কূল গড়ে। ভাঙা এক কুলের মানুষ নতুন গড়া আরেক কূলের দিকে ভাসতে ভাসতে এক চর থেকে আরেক চরে চলে যায়। জীবন ঘনিষ্ঠ সিনেমায় এর আগেও অভিনয় করেছেন মৌসুমী। তবে, এই ছবিটি তার অন্যসব সিনেমা থেকে নানা কারণেই ব্যতিক্রম হয়ে থাকবে। যার মধ্যে আছে প্রেম, প্রকৃতি আর ভালোবাসার গল্পও। আর সেই প্রকৃতির সঙ্গে একেবারে জীবনঘনিষ্ঠভাবে মিশে যাওয়ারও চেষ্টা আছে এ শিল্পীর। মৌসুমী হামিদই জানান, ২০২২ সালের অক্টোবরে চাঁদপুরের কানুদির চরে শুটিং হচ্ছিল এই সিনেমার। একপর্যায়ে সুপার সাইক্লোন সিত্রাং-এর তান্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে যায় শুটিং সেট। কাজ শেষ না করে মাঝপথেই প্রাণ যায়-যায় এরকম অবস্থায় জীবন নিয়ে তড়িঘড়ি করে ফিরতে হয়েছিল তাদের। অবশেষে ২০২৩ সালের এপ্রিলে ফের সেই একই চরে গিয়ে নতুন সেট তৈরি করা হলো। ৬ এপ্রিল থেকে শুরু করে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত টানা শুটিং করা হয়। এর মধ্যে শেষ হয় সিনেমাটির পুরো শুটিং। সিনেমাটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে চিত্র নায়িকা মৌসুমী হামিদ যায়যায়দিনকে বলেন, 'আমাকে যখন সিনেমাটির গল্পটি পড়তে দেয়া হয় তখন আমি এটি পড়ে এতটাই অভিভূত হয়ে পড়ি যে, তাৎক্ষণিকই সিনেমাটিতে অভিনয় করতে রাজি হয়ে যাই। একমাত্র গল্পের কারণেই চাঁদপুরের কানুদির চরের মতো এত দুর্গম এলাকায় শুটিং করতে রাজি হয়েছি- নয়তো তাতে রাজি হতাম না।' মৌসুমী হামিদ বলেন, সিনেমাটিতে শুটিং করতে গিয়ে অনেক খাটাখাটুনি করতে হয়েছে। আগের লটে সিত্রাংয়ের মুখে পড়েছিলাম। সে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। সেই ঝড় মুখে নিয়ে আমরা মাইক্রোতে করে ঢাকায় ফিরি, প্রাণে বাঁচি। প্রান্তিক মানুষ যেভাবে ঝড়-বাদল, দুর্যোগ মোকাবিলা করে বাঁচে, আমাদেরও সেভাবে ঝড়-বাদল, কাঠফাটা রৌদ্র সব কষ্ট সহ্য করেই শুটিংয়ে অংশ নিতে হয়েছে। প্রথমে সিত্রাং ঝড়-বৃষ্টি, তারপরে তীব্র তাপদাহের মধ্যে কাজ করতে হয়েছে। রোজ সেহরির সময় আমাদের কাজ শেষ হতো। প্রতিদিন ১৮-১৯ ঘণ্টা তীব্র তাপদাহের মধ্যে কাজ করেছি। একটা সুন্দর ভালো সিনেমা হচ্ছে ভেবেই এমন বৈরী পরিবেশেও মনোবল হারাইনি। চেষ্টা করেছি এমন একটা ভালো গল্পে প্রাণ দিতে। চরের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার গল্প, মানুষ আর প্রকৃতির অবাধ সৌন্দর্যের লীলাতীর্থের মধ্যেই তরি আ. মা. ম. হাসানুজ্জামানের 'বেদনার বালু চরে' উপন্যাস অবলম্বনে ভিন্ন ধারার এ সিনেমাটি নির্মাণ করছেন সোহেল রানা বয়াতি। এটিই তার প্রথম সিনেমা বানানোর অভিজ্ঞতা। কমল চন্দ্র দাসের চিত্র গ্রহণে চলচ্চিত্রটিতে আরও অভিনয় করছেন আশীষ খন্দকার, ঝুনা চৌধুরী, নিলুফার ওয়াহিদ, বদরুদ্দোজা, স্মরণ সাহা, শিখা কর্মকার, মাহিন রহমান, মেহারান সানজানা, পারভীন পারু, মেরি, শিশুশিল্পী ঊষশী প্রমুখ। মৌসুমী হামিদ এর আগে যেসব জীবন ঘনিষ্ঠ সিনেমায় অভিনয় করেছেন তার মধ্যে গাজী রাকায়েত হোসেনের 'গোর' সিনেমা অন্যতম। সেই সিনেমাটি ১১টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলেও মৌসুমী হামিদ তার বিভাগে পুরস্কার লাভ করেননি। সেটাও ভেবেছে কিনা কে জানে, এবার এ সিনেমাটিতে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়েই একেবারে উজাড় করে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। যেহেতু এমন বিরল জীবনঘনিষ্ঠ গল্পের সিনেমাতেই সচরাচর পুরস্কার জোটে সেহেতু ছবিটিতে মৌসুমী একটা বাড়তি মনোযোগ দিয়ে থাকবেন- তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে মৌসুমী জানান, 'আমি অভিনয় করি আত্মতৃপ্তির জন্যই। অন্যকিছু ভেবে অভিনয় করি না।' কিন্তু অ্যাকশন সিনেমায় থিতু হয়েও কী ভেবে আবার সামাজিক ও জীবনঘনিষ্ঠ সিনেমায় ঝুঁকছেন এমন প্রশ্নে এ অভিনেত্রী জানান, 'আমার কাছে ভিন্নধারা বা কমার্শিয়াল সিনেমা বলে কিছু নেই। অভিনয় জানলে সব ধারাতে অভিনয় করেও তৃপ্তি পাওয়া যাবে। আমি মনে করি না ভিন্নধারার সিনেমায় বিশেষ কোনো গুণের প্রকাশ ঘটানো যাবে। ভিন্নধারার সিনেমার মাধ্যমে অভিনয়ের দক্ষতা প্রমাণ করা যায়- যারা এমন কথা বলেন তারা এটা ঠিক বলেননি। যোগ্যতা থাকলে দক্ষতা প্রমাণের সুযোগ সব ধারার সিনেমাতেই সম্ভব।' ১০ বছরের ক্যারিয়ারে মৌসুমী হামিদ মডেলিং, ছোটপর্দা. বড়পর্দা, ওটিটি- সব মাধ্যমে কাজ করে দর্শকের অন্যতম পছন্দের অভিনেত্রী হয়েছেন। অভিনয় করার ক্ষেত্রে এই যোগ্যতা প্রমাণে কোন বিষয়টিতে বেশি ঝোঁক দেন এমন কথায় মৌসুমী হামিদ বলেন, 'আমি আমার প্রতিটা কাজই যত্নের সঙ্গে করি। তবে অভিনয়টা করার আগে সেটা নিজের মনে লালন করি। সেজন্য অভিনয় আমার ভালোবাসার জায়গা হওয়ায় এর প্রতি আমার একটা বাড়তি মনোযোগ তো আছেই। তখন অভিনয়ের জন্য একটু বেশি যত্ন নিতে হয়। গল্পের চরিত্রগুলোকে আগে মনে ধারণ করে নিই। যখন যে চরিত্রে অভিনয় করি তা আগে থেকে নিজের মনে লালন করে নিই। তারপর পর্দার সামনে আমি হাজির হই। যাতে চরিত্রের সঙ্গে একেবারে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে যেতে পারি।'