সন্ধ্যা রায়

নিঃসঙ্গ এক অভিনেত্রীর গল্প

প্রকাশ | ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

সালেহ ইমরান
বাংলা সিনেমা জগতের একজন স্বনামধন্য অভিনেত্রী হলেন সন্ধ্যা রায়। আশি থেকে নব্বইয়ের দশকে বাংলা সিনেমার পর্দা কাঁপানো এই অভিনেত্রী এখন নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছেন। সদা-হাস্য, মিষ্টিভাষী এই অভিনেত্রী পা দিয়েছেন ৮৩ বছর বয়সে। দীর্ঘ ৫৫ বছর ধরে বাংলা সিনেমায় দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন তিনি। বাংলা সিনেমার কিংবদন্তি পরিচালক সত্যজিৎ রায় থেকে শুরু করে তপন সিনহা, অঞ্জন চৌধুরী কিংবা স্বামী তরুণ মজুমদারের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ অভিনেত্রীর অভিনয়ের ঝুলি। তার সাবলীল অভিনয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে গোটা বাংলা সিনেমা জগৎ। পরনে আটপৌরে শাড়ি পরা আর কপালে সিঁদুরের বড় টিপ। বরাবরই বাঙালিয়ানায় মোড়া অভিনেত্রীর এই রূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন বাংলা সিনেমাপ্রেমীরা। তবে, এখন আর বাংলা সিনেমায় অভিনয় করতে দেখা যায় না তাকে। এক সময় উত্তম কুমার পরবর্তীকালে বেশ কিছু সিনেমাতেও নায়কদের মায়ের চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যেত সন্ধ্যা রায়কে। বাংলা সিনেমার প্রথম সারির এই অভিনেত্রীর অভিনয় জীবন যতই বর্ণময় হোক না কেন ছোটবেলাটা ছিল কঠিন প্রতিকূলতায় মোড়া। জানা যায়, সন্ধ্যা রায় খুব ছোটবেলাতেই হারিয়েছিলেন নিজের মা-বাবা দুজনকেই। ১৯৪১ সালের নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই অভিনেত্রী। কিন্তু মাত্র ৭ বছর বয়সেই পিতৃহারা হন সন্ধ্যা রায়। আর তার দু'বছর যেতেই মাকে হারিয়ে জগতে অভিভাবকহীন হয়ে পড়েন তিনি। এরপর চলে এসেছিলেন বাংলাদেশে মামার বাড়িতে। কিন্তু সেখানেও চরম অর্থ কষ্টের মধ্যে দিয়ে দিন কাটাতে হয় তাকে। যার জন্য মাঝপথে লেখাপড়া ছাড়তে হয়েছিল এই অভিনেত্রীকে। পরে এক বস্তিতে শরণার্থী হিসেবে ঠাঁই হয়েছিল তার। সেখানে বস্তির মেয়েদের সঙ্গে 'মামলার ফল' সিনেমায় শুটিং দেখতে গিয়ে ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায় বাপ-মা মরা মেয়েটার। ভিড়ের মধ্যেই তিনি নজরে পড়ে গিয়েছিলেন পরিচালক পশুপতিনাথ চট্টোপাধ্যায়ের। তিনি তাকে ভিড়ের একটি দৃশ্যে অভিনয় করার সুযোগ দিয়েছিলেন। এরপর সরাসরি তার কাছে সুযোগ আসে অন্তরীক্ষ ছবিতে অভিনয় করার। এরপর বাকিটা ইতিহাস। একের পর এক অভিনয় করেছেন জনপ্রিয় সব বাংলা সিনেমায়। তালিকায় রয়েছে 'ভ্রান্তিবিলাস', 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ', 'দাদার কীর্তি'. 'পলাতক','ঠগিনি',' ফুলেশ্বরী' কিংবা 'বাবা তারকনাথ'-এর মতো জনপ্রিয় সব বাংলা সিনেমায়। শুধু তাই নয়, সন্ধ্যা রায় অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলেন বেশ কিছু হিন্দি সিনেমাতেও। সেই তালিকায় রয়েছে পূজা কি ফুল, আসলি নকলি, অপরিচিত ইত্যাদি। এখানে উলেস্নখ করা প্রয়োজন, সিনেমার অভিনয়ের সূত্রেই পরিচালক তরুণ মজুমদারের সঙ্গে প্রেম হয় তার। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সালে বিয়েও করেছিলেন তারা। কিন্তু সেই বিয়ে স্থায়ী হয়নি। লোকে বলে প্রেমের বিয়ে স্থায়ী হয় না। তা-ই ঘটলো সন্ধ্যা রায়ের জীবনে। পরবর্তী সময়ে পরিচালক তরুণ মজুমদারের সঙ্গে নাম জড়ায় মহাশ্বেতা রায় নামে এক ওড়িষ্যার অভিনেত্রীর। এরপরেই ফাটল ধরে তরুণ মজুমদার এবং সন্ধ্যা রায়ের সংসারে। আইনি বিচ্ছেদ না হলেও ছাদ আলাদা হয়ে যায় তাদের। প্রসঙ্গত, গত দুই বছর আগে প্রয়াত হয়েছেন তরুণ মজুমদার। কিন্তু আজও অভিনেত্রী তার স্বামী হিসেবে তরুণ মজুমদারকেই মানেন। তার মাঝে আসে রাজনৈতিক জীবন। রাজনীতিতেও তিনি সফল ছিলেন। তিনি প্রথমবার ভোটে দাঁড়িয়েই যেতেন। পরবর্তীকালে বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি আর রাজনীতিতে সেইভাবে যুক্ত থাকেননি। তাকে অনেক ধৈর্যশীল নারীর চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গেছে, যার তুলনা কেবল তিনিই। বাংলা সিনেমার দর্শকরা তাকে মনে রাখবেন বহুকাল।