উৎসারিত আলো স্বস্তিকা মুখার্জী

'পালাবদলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছেন আপনারা, সবার আগে বাংলাদেশের হিন্দুদের প্রাণ বুক দিয়ে রক্ষা করুন।' 'আপনাদের স্বপ্ন ছিনতাই হতে দেবেন না। তরুণদের ত্যাগকে ব্যবহার করে কোনো শক্তি যেন গণহত্যা না চালায়। সেই দায়দায়িত্বও আপনাদের। বাংলাদেশে শান্তি, গণতন্ত্র, সংখ্যালঘুদের অধিকার ফিরুক যত শিগগিরই সম্ভব।'

প্রকাশ | ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

মাতিয়ার রাফায়েল
কোটা সংস্কার চেয়ে আন্দোলনরতদের এক দফা দাবিতে যখন উত্তাল হয়ে উঠেছিল রাজপথ তখন তার সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেছেন দেশের বাইরের তারকরাও। '৪৭ স্বাধীনতা উত্তর হোক আর '৭১ স্বাধীনতা উত্তর হোক, কী এক কারণে যেন কখনোই বাংলাদেশের আন্দোলন, বিক্ষোভ নিয়ে মাথা ঘামায়নি প্রতিবেশী ভারত। কিন্তু ইতিহাসে এবারই প্রথম বাংলাদেশের ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পশ্চিমবঙ্গের ছাত্রজনতাও একাত্মতা ঘোষণা করে বিক্ষোভ করেছে। এটা একটা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। যা ইতিপূর্বে ঘটেনি। সে বিক্ষোভে এমনকি তারা স্বৈরাচার শেখ হাসিনার শাস্তিও দাবি করেছে। তাকে স্বৈরাচার বলেও ঘোষণা দিয়েছে। ভারতের ইতিহাসেই এ এক অভাবিত ঘটনা। এখানেই থেমে থাকেনি পশ্চিমবঙ্গ। শুরু থেকেই পশ্চিমবঙ্গের শোবিজের একাংশ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চটা দিয়েই মুখ খুলেছেন। মুখ খুলেছেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখার্জী। আগে থেকেই নানা কারণে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার প্রতি সংক্ষুব্ধ গায়ক কবীর সুমন এ নিয়ে 'স্বৈরাচারবিরোধী' নামে গান গেয়েছেন। অভিনেত্রী স্বস্তিকা নিজের ফেসবুক একাউন্টে এক আবেগঘন পোস্টে লিখেছেন, 'প্রায় এক মাস হলো আমি নিজের দেশে নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খবরের চ্যানেলে তৃতীয় বিশ্বের কোনো খবরই তেমন একটা চলে না। আর আমি খুব একটা ফোনের পোকা নই, তাই এত খারাপ একটা খবর কানে আসতে দেরি হলো। এই তো কয়েক মাস আগে বাংলাদেশ গেলাম, খুব ইচ্ছে ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার। চারুকলা যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, জীবনের একটা স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে। প্রতিবার আসি, ব্যস্ততায় যাওয়া হয় না, মা'ও খুব যেতে চাইতেন বাংলাদেশ, নিয়ে যাওয়া হয়নি, কিন্তু আজ একটা ভিডিও দেখলাম, গুলির ধোঁয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আক্রান্ত। ছাত্রত্ব বয়স গেছে সেই কবে, তবে জাহাঙ্গীরনগর আর আমার যাদবপুর খুব কাছাকাছি। কাঠগোলাপের গাছগুলোও কেমন এক রকম। এক রকম আকাশের মেঘগুলোও। কেবল আজ ওখানে বারুদের গন্ধ।' এই স্ট্যাটাসটি দেন তখন যখন আন্দোলনের ময়দানে আসলেই বাতাসে বারুদের গন্ধ। তাই নিজের আবেগ দিয়ে লিখেছেন কয় ছত্র কবিতাও। 'ময়দান ভারী হয়ে নামে কুয়াশায় দিগন্তের দিকে মিলিয়ে যায় রুটমার্চ তার মাঝখানে পথে পড়ে আছে ও কি কৃষ্ণচূড়া? নিচু হয়ে বসে হাতে তুলে নিই তোমার ছিন্ন শির, তিমির।' বোঝাই যায়, স্বস্তিকার অন্তরজুড়ে বাংলাদেশ নিয়ে একটা আলাদা আবেগ আছে। তাইতো তিনি সেই স্ট্যাটাসেই লিখেন, 'এমন এক আপ্যায়নপ্রিয় জাতি দেখিনি, খাবারের নিমন্ত্রণ যেন শেষ হতেই চায় না, অমন সুন্দর করে সারা রাস্তা জুড়ে ভাষার আল্পনা আর কোথায় দেখব? নয়নজুড়ানো দেওয়াল লেখা? এ বোধ হয় মুক্তিযুদ্ধের শপথ নেওয়া একটা জাতির পক্ষেই সম্ভব। 'আজ, অস্থির লাগছে। আমিও তো সন্তানের জননী। আশা করব, বাংলাদেশ শান্ত হবে। অনেকটা দূরে আছি, এই প্রার্থনাটুকুই করতে পারি। অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো- সেই আমাদের আলো... আলো হোক...ভালো হোক সকলের।' এই স্বস্তিকা মুখার্জী, যিনি বাংলাদেশের জন্য হৃদয়ের টানেই যে বললেন, 'অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো- সেই আমাদের আলো... আলো হোক.... ভালো হোক সকলের'- সেই বাক্যটিকেই বিকৃত করেছে আমাদের এপার বাংলার এক দল হৃদয়হীন, পাষন্ড, বিকৃত রুচির অভিনেতা-অভিনেত্রী একজোট হলেন- এই বাক্যটিকেই অবলম্বন করে 'আলো আসবেই' নামে একটা গ্রম্নপ। যে গ্রম্নপ থেকে উৎসাহ দেওয়া হয় 'ছাত্রদের ওপর গরম জল' ঢেলে দিতে। এসব লোক অভিনেতা-অভিনেত্রী হতে পারে, কিন্তু 'শিল্পী' তো কিছুতেই হতে পারে না। তবে স্বস্তিকা মুখার্জী বাংলাদেশের আন্দোলনে হৃদয় উজার করে সমর্থন দিলেও বাংলাদেশে ঘটা অপর নেতিবাচক কাজটি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। কিছু দুষ্কৃতকারী যখন দেশের মন্দিরে মূর্তি ভাঙচুর করে, আগুন লাগায় তখন ব্যথিত হৃদয় স্বস্তিকা প্রশ্ন করেন, 'মূর্তি ভাঙা, আগুন লাগিয়ে দেওয়াই কি ছিল আন্দোলনের উদ্দেশ্য?' সুন্দর, সাজানো-গোছানো একটি আন্দোলনকেও কালিমালিপ্ত করতে কেউ কেউ এমন দুষ্কৃত ঘটনা ঘটায়- কিন্তু এমন মুষ্টিমেয়রা সেই সুযোগই বা পায় কী করে- যেখানে বিজয়ী বীর ছাত্র ও মহাজনতা বীরদর্পে হাঁটছে? স্বাভাবিক কারণেই এবারের শারদীয় দুর্গোৎসব বড় ধরনের প্রহরাধীনে অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু যে পূজা সার্বজনীন সেই সার্বজনীন পূজা কি কোন প্রহরাধীনে আনন্দপূর্ণ হয়? এ নিয়েও মুখ খুলেছেন স্বস্তিকা। আবারও স্ট্যাটাস দিয়েছেন ছাত্র আন্দোলন পরবর্তী ঘটনা নিয়ে। লিখেছেন তিনি : 'বাংলাদেশের নাগরিক না হয়েও, বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরা যখন গুলি খেয়েছেন, মার খেয়েছেন তাদের পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছি। কিন্তু দু'দিন ধরে দেখছি বাংলাদেশে হিন্দুদের ঘর পুড়ছে, মহিলাদের নিগ্রহ করা হচ্ছে। এমনকি, দুই বাংলার অত্যন্ত প্রিয় গুণী শিল্পী রাহুলের (রাহুল আনন্দ) বাড়ি আক্রমণ করা হয়েছে। এই দায় বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বকে নিতে হবে। নিতে হবে তামাম বাংলাদেশিদের।' কিন্তু একটি বিষয়টি সবচেয়ে বেশি স্পর্শকাতর, দুর্বলতম জায়গার একটি দিক, সেই জায়গাটি নিয়ে সাবোট্যাজ ঘটানোর জন্য দুষ্কৃতকারীও আছে- এ বিষয়টি নিয়ে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীকেই সজাগ ও সতর্ক থাকা উচিত। এই সাবোট্যাজ কাদের দ্বারা হতে পারে, বিজয়ীদের দ্বারা নাকি পরাজিতদের দ্বারা এ নিয়েও সজাগ ও সতর্ক থাকা উচিত। আর যারা পরাজিত হয় তারা তো ক্ষুদ্রই হয়ে যায়। এই পরাজিতরা যখন সাবোট্যাজ ঘটায় তখন তারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই সেটা করে। কিন্তু এই মূর্তি ভাঙা, অগ্নিসংযোগ যদি বিজয়ীদের মধ্য হয়ে থাকে তাহলে তাদের হিংসা, বিশ্বাস থেকেই ঘটে। এই ঘটনা যখন দু'তরফেই ঘটে কাজেই এটা রোখার দায়িত্ব বিজয়ীদেরই। পরাজিতদের নয়। কাজেই এমন সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটলে তো এই দায় বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলকেই নিতে হবে, নিতে হবে তামাম বাংলাদেশই। ওই দুষ্কৃতকারীগোষ্ঠীকে যদি প্রতিরোধ না করতে পারে তাহলে কীসের এবং কী জন্য এই বিজয়! মনে রাখতে হবে, এই ভাবনাটি যার হয়েছে তিনি স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বিপক্ষে থেকেই ছাত্র আন্দোলনকেই জোর সমর্থন দিয়েছিলেন। নিজের সম্প্রদায় সম্পর্কে এ কথা তো তিনি বলতেই পারেন। স্বস্তিকা প্রশ্ন তোলেন, 'মূর্তি ভাঙা, মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘরে আগুন দেওয়া, এই কি ছিল কোটা আন্দোলনের উদ্দেশ্য? মুক্তিযুদ্ধ তো জেনেছিলাম সব বাংলাভাষী মানুষের প্রাণের মূল্যের সমান। কীভাবে আপনারা একজন স্বৈরশাসককে হটাতে গিয়ে, এই মুক্তিযুদ্ধকে আঘাত করলেন? আপনারা সব ধরনের সাম্য ও মৈত্রীর কথা বলেছিলেন। তার প্রথম শর্ত একটি দেশের সংখ্যালঘুদের প্রাণ, মানবাধিকারের প্রতিষ্ঠা। সে সব ব্যর্থ হল।' স্বস্তিকা আরো লিখেন, 'পালাবদলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছেন আপনারা, সবার আগে বাংলাদেশের হিন্দুদের প্রাণ বুক দিয়ে রক্ষা করুন।' সব শেষে আবার স্বস্তিকা এটাও লিখতে ভুলেননি, 'আপনাদের স্বপ্ন ছিনতাই হতে দেবেন না। তরুণদের ত্যাগকে ব্যবহার করে কোনো শক্তি যেন গণহত্যা না চালায়। সেই দায়দায়িত্বও আপনাদের। বাংলাদেশে শান্তি, গণতন্ত্র, সংখ্যালঘুদের অধিকার ফিরুক যত শিগগিরই সম্ভব।' তবে পুজোর কথা বলতে গিয়ে স্বস্তিকা বলে, 'আমার কাছে পুজোটা পুজোই। উৎসব আলাদা। মানে আমাদের আন্দোলন চলবে। পুজোও হবে। কিন্তু খুব হইহুলেস্নাড়ে থাকব না। আমি যেমন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে লরিতে নাচতে নাচতে ভাসানে যাই। এ বার কি কেউ সেটা করতে চাইবে? মন সায় দেবে? তাই উৎসবে ফিরছি না। আর আমি সম্পূর্ণ আমার মতো বলেছি। উৎসবে ফিরুন যেমন বলা যায় না। উৎসবে ফিরবেন না, এটাও বলা যায় না। আমি কি অঞ্জলি দেব না? দেব। আর পুজোর বিরোধিতা করে আমি পুজোর সঙ্গে যুক্ত সমস্ত মানুষের পেটে লাথি মারব, এমনটা তো নয়। আর এই কথাটা মাননীয়ার 'উৎসবে ফিরুন' কথার পরিপ্রেক্ষিতে এসেছে। সব কি ভুলে যাব! যে দেশে মেয়েদের স্বাধীনতাই এখনও আসেনি সেখানে নিরাপত্তার কথা, স্বাধীন মত প্রকাশের কথা বলব না? আরে ইচ্ছেমতো জামাকাপড় পরার অবকাশ নেই, সারা ক্ষণ লোকজন বন্দুক তাক করে বসে আছে। আমি অন্যদের মতো এটাও বলব না যে, ঠিক আছে, 'প্রতিবাদ হোক', 'উৎসবে ফিরুন', 'ঢাক বাজুক', 'ফুচকা খাওয়া হোক'। আমার পেছনে কেউ আদাজল খেয়ে পড়ে গেলেও ওই নিরাপদ থাকার খেলা আমি খেলতে পারব না। যারা ও ভাবে ভাবছেন, তারা ভাবুন। আমার জীবনটাই এমন। সহজ। কঠিন। দ্বন্দ্বে। ছন্দে।'