পোশাকি বা ফ্যান্টাসি ছবির জনপ্রিয় নায়ক ওয়াসিম (আসল নাম মেজবাহউদ্দীন আহমেদ) ১৯৪৭ সালের ২৩ মার্চ, চাঁদপুর জেলায়, এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কলেজের ছাত্রাবস্থায় বডি বিল্ডার হিসেবে বেশ নাম করেছিলেন তিনি। ১৯৬৪ সালে, বডি বিল্ডিংয়ের জন্য 'মি. ইস্ট পাকিস্তান' খেতাব-এ ভূষিত হয়েছিলেন ওয়াসিম। ১৯৬৯ সালে ইংরেজি সাহিত্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। চিত্রপরিচালক এস এম শফি পরিচালিত ১৯৭২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছন্দ হারিয়ে গেল ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে ঢাকার চলচ্চিত্রজগতে আসেন ওয়াসিম। এই ছবির ছোট্ট একটি দৃশ্যে অভিনয়ও করেন তিনি।
নায়ক হিসেবে তার প্রথম ছবি মহসিন পরিচালিত ১৯৭৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'রাতের পর দিন'। এই ছবিতে তার নায়িকা ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রনায়িকা ববিতা।
পরের বছর ওয়াসিম অভিনীত ডাকু মনসুর, কে আসল কে নকল ও জিঘাংসা চলচ্চিত্রগুলো ব্যবসায়িকভাবে সফলতা অর্জন করে। ১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ইবনে মিজান নির্মিত দুই রাজকুমার চলচ্চিত্রটির অসামান্য সাফল্যে রাতারাতি তারকাখ্যাতি অর্জন করেন ওয়াসিম। পেয়ে যান সুপারহিট নায়কের তকমা। ১৯৭৬ সালে মুক্তিপায় এস এম শফি পরিচালনায়, ওয়াসিম-অলিভিয়া অভিনীত দি রেইন (যখন বৃষ্টি এল) চলচ্চিত্রটি। এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনি বিশ্ববাসীর কাছে, জনপ্রিয় চিত্রনায়ক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। বাংলা ও উর্দু, দুই ভাষায় নির্মিত দি রেইন চলচ্চিত্রটি সেই সময়ে পৃথিবীর ২৬টি দেশে মুক্তি পেয়েছিল। ১৯৮১ সালে ব্রিটিশের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ট্রেরেন্স ডেভিড ওয়াসিমের দৈহিক গঠন, দুধে-আলতা শরীরী রঙ এ মুগ্ধ হয়ে তার ইংরেজি উচ্চারণ শুনে হলিউডের মুভিতে নায়ক হিসাবে অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন কিন্তু ওয়াসিম সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
ওয়াসিম অভিনীত অন্যান্য উলেস্নখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো হলো- আকাশ কুসুম, দুশমন, জানোয়ার, বাহাদুর, জীবন মরণ, জীবনসাথী, দোস্ত দুশমন, রাজদুলারী, আসামি হাজির, মহেশখালীর বাঁকে, রাজমহল, গুনাহগার, বারুদ, বন্দুক, বুলবুল-এ বাগদাদ, শীষনাগ, ঈমান, চন্দ্রলেখা, বেদ্বীন, লুটেরা, মোকাবোলা, রাজকন্যা, ওমর শরীফ, শাহী দরবার, আকাশপরী, শাহাজাদী গুলবাহার, ওস্তাদ সাগরেদ, কুদরত, আবেহায়াত, প্রাণসজনী, তিন বাহাদুর, সওদাগর, ধন-দৌলত, বানজারান, পদ্মাবতী, ভাগ্যলিপি, প্রিন্সেস টিনা খান, রসের বাইদানী, নরম গরম, জালিম, চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা, রাজিয়া সুলতানা, লাল মেমসাহেব, জিপসী সর্দার, রাজদুলারী, ধর্ম আমার মা, আয়নামতি, নূরী, শিরি ফরহাদ, ডাকু ও দরবেশ, চাচা ভাতিজা, চন্দনা ডাকু, উনিশ বিশ, দিদার, প্রতিবাদ, রঙ্গীন জরিনা সুন্দরী, সেতুবন্ধন, মান-মর্যাদা, ঈমানদার, পর্বত, জবরদস্ত, সুখের স্বপ্ন, বাহার, মরণপণ, আগুন পানি, হিসাব চাই, জীবনধারা, বিধাতা, ছলনা, আঁচলবন্দি, আলাল দুলাল, রঙ্গীন সাগরভাসা, দুই বোন, কসম, তাকদিরের খেলা, বন্যা, গংগা যমুনা, মোহন বাঁশী, জবানবন্দী, আসমান জমিন, প্রতিঘাত, আজাদ, দিনকাল, জনি ওস্তাদ, আখেরী হামলা, মাটির দুর্গ, নাগপঞ্চমী, জুলুমের বদলা, ডাকাত, ক্ষুধা, মুখোশ, ভালোবাসা ভালোবাসা, মালেকা সুন্দরী, সোনার ময়না পাখি, সাথী তুমি কার, একশো কোটি টাকা, বকুল ফুলের মালা, অরুন শান্তি, ধনী গরীবের প্রেম, মুসা ভাই, ময়না মতির সংসার ইত্যাদি। তিনি কয়েকটি চলচ্চিত্র প্রযোজনাও করেছিলেন।
ব্যক্তিজীবনে নায়ক ওয়াসিম বিয়ে করেছিলেন, প্রখ্যাত অভিনেত্রী রোজীর ছোট বোনকে। তাদের দুই সন্তান- পুত্র দেওয়ান ফারদিন এবং কন্যা বুশরা আহমেদ। ২০০০ সালে তার স্ত্রীর অকালমৃতু্য ঘটে। ২০০৬ সালে ওয়াসিমের কন্যা বুশরা আহমেদ মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের পাঁচতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। তার একমাত্র পুত্র ফারদিন লন্ডনের কারডিফ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলএম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ব্যারিস্টার হিসেবে আইন পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পে সহকারী পরিচালক হয়ে এসে, এক সময়ে তুমুল জনপ্রিয় চিত্রনায়ক হয়ে যান ওয়াসিম। হয়ে যান সুপারহিট চিত্রতারকা। একের পর এক অভিনয় করে গেছেন, সব বাণিজ্যসফল চলচ্চিত্রে। একটানা ৫০টিরও বেশি সুপার হিট চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন তিনি। তখনকার সময়ে, অ্যাকশন ও ফোক-ফ্যান্টাসী ছবির অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক ছিলেন ওয়াসিম।
এমনও সময় গেছে, নায়ক ওয়াসিম যখন এফডিসি'র স্টুডিওতে হেঁটে যেতেন, পেছনে প্রযোজক-পরিচালকদের লাইন লেগে থাকতো। যদি তার একটু শিডিউল পাওয়া যায়, এই আশায়। ওই সময়ে তার শিডিউল পাওয়া ছিল সোনার হরিণের মতো। এমন মহাব্যস্ত নায়ক ছিলেন তিনি।
তার অভিনীত বহু ব্যাবসাসফল সব ছবি দিয়ে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন অনেক প্রযোজক-পরিচালক। অনেকের গাড়ি হয়েছে, বাড়ি হয়েছে। নায়ক ওয়াসিমও হয়েছেন জনপ্রিয়, সমাদৃত। আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প বাণিজ্যিকভাবে হয়েছে সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে বাণিজ্যিকভাবে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এক সফল চিত্রনায়কের নাম ওয়াসিম। আমাদের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নায়ক ওয়াসিম- চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।