ন্যায়ের জন্য দেদীপ্যমান মিথিলা

আমার শিক্ষা হচ্ছে অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করা। আমি দেখেছি অন্যায় হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের মারা হচ্ছে, প্রতিবাদ করেছি। আমার মনে হয়, সবারই অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করা উচিত। তাহলেই ভালো কিছু হবে। যেখানে অন্যায়, সেখানেই প্রতিবাদ করতে হবে। তাহলেই দেশটা সুন্দর হবে। যখন কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা হয়, তখন আমাদের সংহতি জানানো দরকার

প্রকাশ | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

মাতিয়ার রাফায়েল
রাফিয়াত রশীদ মিথিলা, যেন একই অঙ্গে বহুরূপ। মিথিলা যে কেমন তা সহজেই কেউ চট করে বলে দিতে পারেন না। মিথিলা নিজেও কি জানেন তিনি কেমন? তাহসানের সঙ্গে ২০১৭ সালে বিচ্ছেদ হয়। তৎক্ষণাৎ গোটা শোবিজ পাড়ায় যেন একটা ভূমিকম্প হলো। আর মিথিলা ও তাহসান, দুজনের ভক্তকুলে নানারকম প্রতিক্রিয়া। এক সময়ে উভয়ের দর্শকই ম্রিয়মাণ হয়ে গেল। বিশেষ করে মিথিলার প্রতি দর্শককুলের একটা ভালোবাসা ছিল তাতে ভালোমতোই চিড় ধরলো। তবে তাতে সহমর্মিতা বাড়ল তাহসানের প্রতিই। দর্শকের যত অবিশ্বাস হতে লাগলো মিথিলাকে নিয়ে। দীর্ঘদিনই এ দেশের দর্শকের ভালোবাসাহীন হয়ে থাকতে হলো মিথিলাকে। তবে এ দেশে যেমনই হোক দর্শকের প্রতিক্রিয়া কলকাতায় কিন্তু বেশ জমিয়েই রাখলেন মিথিলা। কিন্তু দেশের দর্শকপ্রিয়তার জায়গায় যদি না থাকতে পারেন তবে তিনি কীসের শিল্পী? সে দায় যেন এবার ঘুচানোর সময় এলো। দেশে কোটা ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠলো। মেধা না কোটা এ আন্দোলনে এক সময়ের মেধাবী ছাত্রী রাফিয়াত রশীদ মিথিলাও নেমে পড়লেন মেধাবী ছাত্রদের প্রতি সংহতি প্রকাশে। ছাত্র আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে 'দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ'-এর ব্যানারে রাজপথে নামেন। মেয়ে আয়রাও সেই আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি আঁকলো তার ক্যানভাসে। সেটার পোস্টও দিলেন মিথিলা। কিন্তু ছাত্রজীবনের তো তুখোর মেধাবী ছিলেন তাহসান রহমান খানও। তিনি তখন কী করলেন? মজলেন জননিন্দিত 'আলো আসবেই' গ্রম্নপে। জাতির এমন ক্রান্তিলগ্নে জিতে গেলেন রাফিয়াত রশীদ মিথিলাই। হেরে গেলেন তাহসান। এবার তাহসান পারলেন না। ছাত্র ও মহাজনতার রোষের পাত্রই হয়ে গেলেন। তিনি যে ছিলেন স্বৈরাচার শেখ হাসিনার যেভাবেই হোক কঠিন হাতে ছাত্র আন্দোলন দমনের নির্দেশের পক্ষে। ঠান্ডা, বিনয়ী মেজাজের তাহসানের অন্তর্জগৎটি যে এমনই শেখ হাসিনার মতোই নির্মম তা এবারের ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রকাশ হয়ে গেল। বোঝা গেল তার ঠান্ডা, বিনয়- এসব যেন স্বার্থপরতারই প্রকাশ। পরার্থপর ন্যায়ের প্রকাশ নয়। আর প্রকাশ হলো মিথিলার অন্তর্জগৎ কেমন ন্যায়ের পক্ষে দেদীপ্যমান। কলকাতা থেকে তার বর্তমান স্বামী সৃজিৎ মুখোপাধ্যায়ও ছিলেন বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে। তাইতো এবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ে রাজপথে দেখা গেছে অভিনেত্রী মিথিলাকে। সে সময় চলচ্চিত্র, আলোকচিত্র, থিয়েটারসহ শোবিজের নানা অঙ্গনের কর্মীরা রাজপথে নেমে এসেছিল। সেই ভিড়ে ছিলেন মিথিলাও। শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছেন। এ বিষয়ে মিথিলা বলেন, 'আমার শিক্ষা হচ্ছে অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করা। আমি দেখেছি অন্যায় হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের মারা হচ্ছে, প্রতিবাদ করেছি। আমার মনে হয়, সবারই অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করা উচিত। তাহলেই ভালো কিছু হবে। যেখানে অন্যায়, সেখানেই প্রতিবাদ করতে হবে। তাহলেই দেশটা সুন্দর হবে। যখন কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা হয়, তখন আমাদের সংহতি জানানো দরকার।' সেই সংহতিতে শুধু জয়ই হয়নি মিথিলার একেবারে ভূমিধ্বস বিজয় হয়েছে। পরাজয় হয়েছে ন্যক্কারজনকভাবে স্বৈরাচারের। পরাজয় হয়েছে শেখ হাসিনার। এমন বিজয়ের সামনে নিজের অভিনয় নিয়ে কী ভাবছেন মিথিলা? আপাতত অভিনয়ে ফেরার মানসিক অবস্থায় নেই অভিনেত্রী রাফিয়াত রশিদ মিথিলা। দেশের চলমান সার্বিক পরিস্থিতি নিয়েই উৎকণ্ঠায় আছেন এই অভিনেত্রী। জানালেন, নতুন এক বাংলাদেশ দেখার স্বপ্নে বিভোর আছেন তিনি। সেই স্বপ্নের মধ্যেই দুঃস্বপ্ন হয়ে এলো বন্যা। সেই বন্যা পরিস্থিতিতেও বেশ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। নিজ থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। মিথিলা বলেন, 'যখনই বন্যা হয়, চেষ্টা করি কিছু করতে। এবারও করছি। যতটুকু পারছি, করছি। বন্যার এ সময়টাতেও ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই নিজেদের সাধ্যমতো বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন- এটাই আমার দেশ, বাংলাদেশটা সাম্যের হোক। প্রত্যাশা থাকবে এ দেশে বিনা কারণে মানুষ যেন আর মারা না যায়। সাম্যের দেশ হোক এটাই চাওয়া।' কিন্তু এই 'ন্যায়-অন্যায়'বোধ আর 'সাম্য' কি মিথিলা নিজে তার ব্যক্তিগত জীবনে অনুসরণ করেন? কতটা অনুসরণ করেন? সেটা যখন তার মধ্যে দর্শক অনুসরণ করে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তখন কি রাফিয়াত রশীদ মিথিলাকে কিছুটা হলেও হতোদ্যম করে দেয় না? করে বৈকি! নয়তো এই কিছুদিন আগেও মিথিলা এ দেশের দর্শকের কাছে এখনো কতটা অপ্রিয় তা মিথিলার এক প্রতিক্রিয়াতে স্পষ্ট হয়। নয়তো দর্শকের প্রতিক্রিয়ার জবাব দেবেন কেন তিনি? দর্শকের প্রতিক্রিয়া নিয়ে মিথিলা বলেন, দীর্ঘদিন পর যখন একটি ওয়েব সিরিজে তাহসানের সঙ্গে অভিনয় করেন এটাও দর্শক ভালোভাবে নেয়নি। মিথিলা বলেন, '২০১৭ সালে আমাদের বিচ্ছেদ হয়। এ নিয়ে চারদিকে এখনো আলোচনা-সমালোচনা হয়। লোকে বলে, টাকা-পয়সার জন্য এক হয়েছে অথচ শিশু সন্তান এক রাখতে পারল না তাদের! লোকে তো জানেই না আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের কথা। আমরা খুব ভালো আছি। আমাদের যখন বিচ্ছেদ হয় আয়রার বয়স মাত্র এক বছর। ওকে নিয়ে সব জায়গায় ঘুরেছি। বাড়ির সাহায্য পেয়েছি। তাহসানের কাছে বাচ্চাকে রেখে বাইরে গেছি। কর্মসূত্রে যখন বাইরে যাচ্ছি, তখনো আমি আয়রাকে সঙ্গে নিয়ে গেলে কাজের জায়গা থেকে ওরা আপত্তি করেনি।' তিনি আরও বলেন, আফ্রিকায় একটা কথা আছে, 'একটা বাচ্চাকে বড় করতে পুরো গ্রামের প্রয়োজন'। এটাই সত্যি। আমি বলতে চাচ্ছি, বাচ্চা মানুষ করার ক্ষেত্রে দাদা-দাদি, শাশুড়ি ও বন্ধু সবার প্রয়োজন হয়। মিথিলা বলেন, দর্শকরা ভাবছেন, ২০১৬-এর পর ২০২৪-এ মিথিলা আর তাহসানের দেখা হলো। এটা তো না, আমাদের তো প্রতিদিনই কথা হয়। ব্যাপারটা ও রকম নয় যে, বহু বছর পর দুজনের দেখা হলো, আর পেছনে মিউজিক বাজছে, তা তো নয়। বিচ্ছেদের পর সম্পর্ক রাখা স্বাভাবিক কিনা, এমন প্রশ্নে মিথিলা বলেন, সব সম্পর্কে বন্ধুত্ব না-ও থাকতে পারে। কিন্তু সন্তান থাকলে তার স্বার্থ আগে দেখতে হবে। সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য আমার কাছে সবার আগে। এটাই উচিত। আমি আয়রাকে দেখতে পেলাম না। আমি আর তাহসান লড়াই করলাম, এই ইগোর যুদ্ধে তো বাচ্চার ক্ষতি হবে। আর এই সন্তানটি যদি কন্যা সন্তান না হয়ে ছেলে সন্তান হতো তাহলে তার এই চিন্তাটি কীভাবে সাজানো হতো? তিনি বলেন, আমি আর তাহসান ১৪ বছর একসঙ্গে থেকেছি, ঘরসংসার করেছি। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করেছি। দুজন দুজনকে ভালো করে জানি। আয়রা আমাদের দুজনের কাছে সবার আগে। নিজ কন্যা সেই আয়রাকেই যেন এবার দেখলেন বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া বিশাল মহাজনতা ও ছাত্রসমাজের মধ্যে। যে আয়রার মাঝে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনেন মিথিলা, সেই স্বপ্নই তো বাস্তবায়নের জন্য আত্মত্যাগের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে সম্মুখ সারিতে নেতৃত্ব দিয়ে ছাত্রসমাজ। আর তাদের সেই ঝাঁপিয়ে পড়া আন্দোলনেই এবার সুযোগ পেয়ে সংহতি প্রকাশ করলেন মিথিলা 'দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ' এর ব্যানারে। যে দর্শক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন এক বিয়েবিচ্ছেদে, সেই দর্শকের মাঝে, সেই মহাজনতার মাঝে 'আমি কে তুমি কে' এ প্রশ্নে আবার ফিরে আসার সুযোগ করে দিল মিথিলাকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে। নতুন এক দেশে। নতুন 'স্বাধীন বাংলা'র দেশে।