জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি

উপমহাদেশের খ্যাতিমান শিল্পী মোহাম্মদ রফি

প্রকাশ | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

আহমদ মতিউর রহমান
মোহাম্মদ রফি উপমহাদেশের একজন অনন্য সাধারণ সঙ্গীত শিল্পী। সঙ্গীত ভুবনে সুদীর্ঘ চার দশক সময়কাল অতিবাহিত করে চমৎকার কণ্ঠ সুষমায় উপহার দিয়েছেন হাজার হাজার গান। গানের এই আধিক্য একটি রেকর্ড। কেউ তার এই রেকর্ড ছুঁতে পারবে বলে মনে হয় না। সঙ্গীত কলায় অসামান্য অবদান রাখায় শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবে জাতীয় পদক এবং ৬-বার ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন মোহাম্মদ রফি। এছাড়াও ১৯৬৭ সালে ভারত সরকার প্রদত্ত পদ্মশ্রী সম্মানেও অভিষিক্ত হয়েছেন তিনি। ২০২৪ সাল তার জন্ম শতবর্ষ। জন্মের একশো বছর পরেও দেখা যাচ্ছে এই সঙ্গীত শিল্পীর গান ভক্তদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। সঙ্গীত জগতে থাকাকালীন ছাব্বিশ হাজারেরও বেশি চলচ্চিত্রের গানের নেপথ্য গায়ক বা পেস্নব্যাক সিংগার হিসেবে সম্পৃক্ত ছিলেন মোহাম্মদ রফি। তিনি বহুবিধ গানে অংশ নেওয়ার বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, দেশাত্মবোধক গান, বিরহ-বিচ্ছেদ, উচ্চ মার্গের প্রেম-ভালোবাসা, কাওয়ালি, ভজন, গজলসহ বিভিন্ন গোত্রের গানে দক্ষতা ও পারদর্শিতা দেখিয়েছেন সমানভাবে। বিশেষ করে, হিন্দি এবং উর্দু ভাষায় সমান দক্ষতা থাকায় তার গানগুলোতে বৈচিত্র্য এসেছে। তিনি বহু বাংলা গান গেয়েছেন- যা এখনো সবার মুখে মুখে ফেরে। তার জনপ্রিয় একটি বাংলা গানের কথাই ধরা যাক। পাখিটার বুকে যেন তীর মের না ওকে গাইতে দাও। এই গানটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এতে আছে একটি সুন্দর বক্তব্য। কাহিনী ভঙ্গিতে গাওয়া এই গানটির আবেদন ব্যাপক বলে সঙ্গীত জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা মত প্রকাশ করেছেন। হিন্দি ও বাংলাসহ কোনকানি, উর্দু, ভোজপুরী, উড়িয়া, পাঞ্জাবি, মারাঠি, সিন্ধি, কানাড়া, গুজরাতি, তেলুগু, মাঘি, মৈথিলি, অহমিয়া ইত্যাদি ভাষায় তিনি গান গেয়েছেন। এছাড়াও আরও গান গেয়েছেন- ইংরেজি, ফার্সি, স্প্যানিশ এবং ডাচ ভাষায়। ২৪ জুলাই, ২০১০ তারিখে টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে তার চমকপ্রদ কণ্ঠস্বরকে বিশেষভাবে মূল্যায়িত করা হয়েছে। আমি তোমাকে ভালোবাসি বা (আই লাভ ইউ) বাক্যটিকে যদি ১০১ প্রকারে গান আকারে গাইতে বলা হয়, মোহাম্মদ রফি ওই ১০১ প্রকারে তার সবটুকুই করতে পারতেন। প্রায় চার দশকের গানের ভুবনে অসাধারণ অবদানের জন্য মোহাম্মদ রফি তাই সব সময়ের, সব কালের ও সব বিষয়ের শিল্পী হিসেবে পরিগণিত হয়ে আছেন। রফির পারিবারিক জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। ভারত বিভাজনের সময় মোহাম্মদ রফি ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বোম্বেতে চলে আসে। তিনি তার চাচাতো বোনকে বিয়ে করেছিলেন। দেশ বিভক্তির পর তিনি তার স্ত্রী বশিরা বিবিকে ভারতে আনতে পারেননি। ফলে, তিনি পাকিস্তানের লাহোরে অবস্থান করেন। এই সংসারে তার একটি পুত্র সন্তান রয়েছে। বোম্বেতে অবস্থানকালে তিনি বিলকিস বানু নামে এক রমণীকে বিয়ে করেন। তাদের সংসারে ৩ পুত্র ও ৩ কন্যার জন্ম হয়। ৩১ জুলাই, ১৯৮০ উপমহাদেশের অমর সঙ্গীতকার মোহাম্মদ রফি ৫৬ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে বলিউডে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য গায়কদের তুলনায় রফিকেই দেখা গিয়েছিল সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও, হিন্দি ছবিতে তিনি অনেক খ্যাতনামা চলচ্চিত্র তারকার জন্য গান গেয়েছেন। ১৯৭?১-১৯৭৩ সময়ের মধ্যে মোহাম্মদ রফি'র সঙ্গীত ভুবনে অংশগ্রহণ কমতে থাকে। যদিও, এ সময়ে তিনি কিছুসংখ্যক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। ১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে রফি শীর্ষস্থানীয় কণ্ঠশিল্পী হিসেবে সঙ্গীত জগতে নিজের স্থান পুনরায় দখলে রাখেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ঊষা খান্না'র গীত রচনায় হাওয়াস ছবিতে তেরি গালিওন মে না রাখেঙ্গে কদম আজ কে বাদ গান গেয়ে ফিল্ম ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে সেরা গায়কের পুরস্কার পান। ১৯৭৭ সালে হাম কিসি সে কাম নেহি শিরোনামের হিন্দি চলচ্চিত্রে আর. ডি. বর্মণের সঙ্গীত রচনায় ক্যায়া হুয়া তেরা ওয়াদা গানের জন্য ভারতের জাতীয় পদক এবং ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেন। ঋষি কাপুর অভিনীত চলচ্চিত্র হিসেবে- অমর আকবর এন্টনি (১৯৭৭), সরগম (১৯৭৯) এবং কর্জ (১৯৮০) ছবিগুলোয় নেপথ্যে কণ্ঠ দেন মোহাম্মদ রফি। তন্মধ্যে অমর আকবর এন্টনি চলচ্চিত্রের পর্দা হে পর্দা কাউয়ালিটি সব স্তরের দর্শক-শ্রোতাদের কাছে ভীষণভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এছাড়াও ১৯৭০ দশকের শেষ দিক থেকে ১৯৮০ দশকের শুরুর দিকে কণ্ঠসঙ্গীতে রফি'র স্মরণীয় অংশগ্রহণ ছিল- লায়লা মজনু (১৯৭৬), আপনাপান (১৯৭৮), কুরবানি (১৯৮০), দোস্তানা (১৯৮০), দ্য বার্নিং ট্রেন (১৯৮০), নছিব (১৯৮১), আবদুলস্নাহ (১৯৮০), শান (১৯৮০) এবং আশা (১৯৮০) চলচ্চিত্রসমূহে। লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে মোহাম্মদ রফির জুটিকে বলিউড ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ জুটি ধরা হয়। তারা ১৯৪৯ সালে বারসাত ছবি থেকে শুরু করে একনাগাড়ে রফির মৃতু্য পর্যন্ত ৫০০ এর অধিক দ্বৈত গানে অংশ নেন। আশা ভোঁসলের সঙ্গে রফির জুটিকে পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জুটি বলা হয়। তারা ১৯৫০-৮৭ সাল পর্যন্ত সঙ্গীতে যুক্ত ছিলেন (১৯৮০ সালে তার মৃতু্যর পর এক দশক পর্যন্ত রফির গান মুক্তি পেতে থাকে)। আশা ভোঁসলে আর মোহাম্মদ রফি মোট ৯১৮টি দ্বৈত গানে কণ্ঠ দিয়েছেন- যা বলিউডের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।