সোহেল রানা, আসল নাম মাসুদ পারভেজ, বাংলাদেশের সংস্কৃতিক অঙ্গনের একমাত্র পুরুষ যিনি ১৯৭১-এও স্বাধীনতা যুদ্ধে সশরীরে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আবার ২০২৪-এর বৈষম্যমুক্ত স্বাধীনতা যুদ্ধেও শুরু থেকে লড়াই করেছেন। লড়াই করেছেন কথায় আর লেখায়। প্রথমটি স্বাধীনতাযুদ্ধে লড়াই করেছেন তারুণ্যের অহংকার নিয়ে আর দ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধে সেই তারুণ্য দিয়ে কিছু দিতে পারলেও তারুণ্যের ভাষা দিয়ে এবার ২০২৪-এর বৈষম্যমুক্ত আন্দোলনে লাগাতার সমর্থন যুগিয়েছেন তিনি। বলা যায়, সব ইতিবাচক লড়াইয়েই সোহেল রানা অবিচল।
জাতির ক্রান্তি লগ্ন যখন নিজের ঘরের দরোজার সামনে তখন একমাত্র স্বাধীনতাকামী ব্যক্তিই রুখে দাঁড়াতে জানে। সোহেল রানাকে আমরা '৭১-এর যুদ্ধে পেয়েছিলাম। আবার তিনি ২০২৪ সালেও বিশাল ছাত্র-জনতাকে বিমুখ করেননি। স্বাধীনতা এসেছিল ১৯৪৮-এও। কিন্তু সেই স্বাধীনতা যখন বৈষম্যে রূপ নিল, পরিণামে '৭১ আবার স্বাধীনতা যুদ্ধে নামতে হলো দেশের জনতাকে। এবার এই স্বাধীনতা যুদ্ধকে তারা নিজের যুদ্ধ বলে গ্রহণ করল না- যারা পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন করেছিল। পরিণামে তারা রাজাকার হয়ে গেল। ঠিক সেই মুসলিম লীগের লোকবল নিয়ে সৃষ্ট আওয়ামী লীগও একই ভূমিকা নিল, ২০২৪ সালের বৈষম্যমুক্ত স্বাধীনতাকে তারাও মেনে নিতে পারল না। বরং তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অস্ত্র হাতে ১৯৭১-এর মতো পাক মুসলিম লীগ-জামায়াতের মতোই। এক্ষেত্রে একমাত্র অনন্য সোহেল রানাই- যিনি '৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধেও ছিলেন ২০২৪-এও থেকেছেন বৈষম্যমুক্ত স্বাধীনতার লড়াইয়ে। কথায় বা লেখার মধ্য দিয়ে।
প্রথমে সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন জানান প্রযোজক ও অভিনেতা মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা। শুধু তাই নয়, কোটাপদ্ধতিতে চাকরি এবং ভর্তির প্রক্রিয়াটি মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করার শামিলও বলেছেন তিনি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তখন সোহেল রানা লিখেছেন, 'মুক্তিযোদ্ধাদের নাম বারবার বলা হচ্ছে কেন? দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫৩ বছর।' কায়েমী ক্ষমতাসীনরা যে মুক্তিদ্ধাদের নাম ভাঙিয়ে তাদের শাসনক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে চায় এই মুক্তিযোদ্ধা সোহেল রানার বুঝতে বাকি থাকেনি।
তাই এরপর তিনি বলেন, 'তার সঙ্গে যদি আরও ১২ বছর যোগ করা হয়, তাহলে তার বয়স হয় ৬৫। এই বয়সে তো নিশ্চয়ই কেউ চাকরির জন্য চেষ্টা করে না বা স্কুল-কলেজে ভর্তি হয় না। তাদের সন্তানদের বাবার কারণে কোটা সিস্টেমে চাকরি এবং ভর্তি হতে হবে, এটা মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করার শামিল। নিজ ম্যারিটের গুণে তারা ভর্তি হবে, পরীক্ষা দেবে এবং চাকরিতেও ইন্টারভিউ দেবে। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা কখনো এ ধরনের সুযোগ চাইনি। সম্মান যখন নেই, তখন এই ধরনের সুযোগ দিয়ে তার সন্তানদেরও সম্মান দেখানো একটা অপচেষ্টামাত্র।'
তাই সর্বস্তরে কোটাপদ্ধতি বাতিল করার আহ্বান জানিয়ে সোহেল রানা তখন আরও লেখেন, 'সম্মানী দেওয়া ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আপনারা কী করেছেন? মুখে মুখে তাদের জন্য মায়াকান্না করেছেন। ড্রেস থেকে শুরু করে চিকিৎসা বা চলাফেরা, কোনো কিছুতেই কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি, আমরা কখনোই কিছু চাইনি। জাতির পিতার নির্দেশে দেশ স্বাধীন করার দরকার ছিল, আমরা সেটাই করেছি। সর্বস্তরে এই কোটা সিস্টেম বাতিল করা হোক, এটা দেশের সকলের দাবি।'
সোহেল রানা যদিও বলেছেন দেশের সবার দাবি, কিন্তু একমাত্র আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলীয় জোটের সবাই এই বৈষম্যমুক্ত আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিল। শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকে বলেছিলেন ৫/১০ হাজার ফেলে দিতে। এটা ঠিক বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রধানকে '৭১-র ইয়াহিয়া খান বানানোর পাঁয়তারা ছিল শেখ হাসিনার। কিন্তু বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান এই ড্রাকুলারূপী হাসিনার কথার ফাঁদে পা দেননি।
সেনাবাহিনী সম্পর্কে তিনি বলেন, 'আমাদের সেনাবাহিনী অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। যেখানে তারা একটি গুলিও ফোটায়নি।'
শুধু তাই নয়, সোহেল রানা বৈষম্যমুক্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার হত্যালীলা দেখে বলেন, '?স্বৈরশাসনে শেখ হাসিনার কাছে এরশাদ স্কুলছাত্র।'
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নতুন এক বাংলাদেশের অভু্যদয় ঘটেছে। এতদিন স্বাধীনতা একটি দলের মধ্যে কুক্ষিগত হয়ে পড়েছিল। পাকিস্তান আমলে যেমন বাংলাদেশ হওয়ার সময়েও তেমনই একচেটিয়া কুক্ষিগত হয়ে পড়েছিল। ফলে, আবার স্বাধীন হয়েও পরাধীন হয়ে থাকতে হলো বাংলার জনতাকে একটি পরিবারের অধীনে। এক স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে দেশ ছাড়া করতে ৮ শতাধিক মানুষের আত্মত্যাগের ঘটনা ইতিহাসে বিরল। তবে দেশের ইতিহাসে স্বৈরাচার বলতে শুধু হাসিনাই নয়, অনেকে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকেও স্বৈরাচার মনে করতেন। এই এরশাদের সঙ্গে সোহেল রানার ওঠাবসা ছিল।
সে প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন সোহেল রানা। তিনি জানালেন, দীর্ঘ সময় ধরে এরশাদকে একজন ভালো মানুষ মনে করেন তিনি। কিন্তু তাকে স্বৈরশাসকের সঙ্গে তুলনা করা হতো। সে প্রসঙ্গে সোহেল রানা বলেন, 'তাকে (এরশাদ) নয় বছরের স্বৈরশাসক হিসেবে অনেকে বলে। আমি বলি, যদি ওনাকে স্বৈরশাসক বলা হয়, তাহলে গত ১৬ বছরের ক্ষমতায় থাকা কথিত সরকারদের স্কুলে এরশাদ সাহেবকে ভর্তি করতে হবে, সেটাই শিখতে যে স্বৈরতন্ত্র কী, স্বৈরশাসন কাকে বলে, সেটা কীভাবে করা উচিত এবং স্বৈরশাসনের অবস্থানটা কী।'
দেশ, জাতি ও ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে একেবারেই সন্তুষ্ট নন সোহেল রানা। চলচ্চিত্রের ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কয়েক বছর আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন 'এটা ডেড, এটা কবে আবার পুনরুজ্জীবিত হবে জানি না।' ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ এবং এর পরবর্তী ঘটনাপরম্পরা তাকে বিচলিত করে।
বাংলা ভাষা সম্পর্কে বলতে গিয়ে সোহেল রানা বলেন, 'দেখুন, পৃথিবীর প্রতিটি জাতিই নিজ ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। নিজ ভাষাতে কথা বলেই তৃপ্ত ও গর্বিত। এজন্য আমাদের মতো তাদের আত্মত্যাগ ও লড়াইও কিন্তু করতে হয়নি। তারপরেও তাদের নিজ নিজ ভাষার প্রতি যে প্রেম ও শ্রদ্ধাবোধ আছে সেখানে নিজ ভাষার প্রতি আমাদের প্রেম ও শ্রদ্ধাবোধ কোথায়? বরং আমরা বাংলার চেয়ে ইংরেজিকেই শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করছি, সর্বত্র ইংরেজিকেই প্রাধান্য দিচ্ছি। নিজের ভাষাকে জগাখিচুড়ি বানিয়ে ফেলছি। ইংরেজিটা কিন্তু শুদ্ধ ছাড়া অশুদ্ধভাবে বলার চিন্তাও করি না। বরং বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিলিয়ে এক ধরনের বাংলিশ করার প্রবণতা বাড়ছে আমাদের। আসলে জাতি হিসেবে আমরা খুবই হীনম্মন্য বলেই এমনটা হচ্ছে। এখন তো নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিতেও লজ্জা করে আমার।'
এরপর তার সেই যুদ্ধের দিনগুলোর স্মৃতি সম্পর্কে কিছু বলতে বললে তিনি বলেন, 'এখন আমি আমার যুদ্ধের সেই স্মৃতি থেকে এমন বলব, অনেকে যেমন টক শো'তে বলেন, যুদ্ধে তারা একেকজন মহাবীর আলেকজেন্ডার। তাদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, তারা যদি আলেকজেন্ডারই হবেন তাহলে সেই যুদ্ধে বিজয়ী হতে নয় মাস লাগলো কেন? ৩০ লাখকে কেন শহীদ হতে হলো? সেটা তো সাত দিনেই শেষ করে দেওয়া যেত! কিন্তু যুদ্ধটা সেরকম মহাবীর আলেকজেন্ডারের মতো হয়নি। আমাদের এ জন্য অনেক কাঠখড়ও পোড়াতে হয়েছে। পাকিস্তান আর্মি তো যুদ্ধের প্রথম তিন মাসেই গোটা বাংলাদেশ দখল করে নিল। এজন্য আমাদের আগে নিজেদের বাঁচিয়ে প্রথম চারমাসই গেছে যুদ্ধের জন্য যা যা লাগে তা সামলাতেই। আমাদের তখন অস্ত্র বলতে ছিল পিস্তল, রাইফেল এসব। এগুলো দিয়ে তো যুদ্ধ করা যায় না। আমরা যুদ্ধ করেছি নিজেদের বাঁচিয়ে 'হিট অ্যান্ড রান' গেরিলা পদ্ধতিতে। কাজেই দিস ইজ নট ওয়ার। কিছু কিছু অংশে প্রথম তিন মাস সরাসরি যুদ্ধ করেছে আমাদের বাঙালি আর্মি, ইস্ট বেঙ্গল, বিডিআর (বাঙালি ইপিআর)- তারা। তারপর আমরা ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে বা দেশে কোথাও ট্রেনিং নিয়ে সম্মুখযুদ্ধ শুরু করি।'