সোনালি যুগের হিন্দি সিনেমার জনপ্রিয় নায়িকা বৈজয়ন্তীমালা। বহুমাত্রিক অভিধায় যুক্ত করা যায় তাকে। ভরতনাট্যম নৃত্যশিল্পী, কার্ণাটিক গায়িকা, নৃত্য নির্দেশিকা ও বিশিষ্ট সংসদ সদস্য তিনি। তিনি ১৯৪৯ সালে তামিল ভাষায় নির্মিত ভাজকাই চলচ্চিত্রে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অভিষেক ঘটে তার। এরপর ১৯৫০ সালে তেলেগু চলচ্চিত্র জিভিথামে অভিনয় করেন বৈজয়ন্তীমালা। পরবর্তী সময়ে দক্ষিণ ভারতের অন্যতম প্রতিভাবান অভিনেত্রীর মর্যাদা লাভসহ বলিউডের স্বর্ণযুগে প্রবেশ করেন তিনি।
বৈজয়ন্তীমালা প্রায় দুই দশকব্যাপী বলিউড তারকাদের মধ্যে অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ছিলেন। প্রথম দক্ষিণ ভারতীয় অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় তারকায় পরিণত হন ও অন্যান্যরা তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ধাবিত হন বলিউডের দিকে। বৈজয়ন্তীমালা নৃত্যকলায়ও পারঙ্গমতা দেখান এবং বলিউডে অর্ধ-ধ্রম্নপদী নৃত্যের অন্তুুর্ভুক্তিতে অন্যতম ভূমিকা রাখেন। বেশ কিছুসংখ্যক চলচ্চিত্রে নৃত্য সহযোগে অভিনয়ের কারণে তিনি 'টুইঙ্কল টোজ' পদবি লাভ করেন। এছাড়াও, তাকে হিন্দি সিনেমার অন্যতম প্রথম প্রমিলা চিত্রতারকাদের একজনরূপে গণ্য করা হয়ে থাকে। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে তার বর্ণাঢ্যময় চলচ্চিত্র জীবনের কারণে তাকে 'নুমেরো ইউনো অভিনেত্রী' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বৈজয়ন্তীমালা তামিল, তেলেগু, হিন্দি, কন্নড়, মোট চারটি ভাষাতে কাজ করেছেন। তার প্রথম ছবি তামিলে ভাজকাই।
পার্থসারথি মন্দিরের কাছে ত্রিপলিকানে এক তামিল পরিবারে জন্ম তার ১৩ আগস্ট, ১৯৩৬। তার বাবা এম ডি রমন ও মা বসুন্ধরা দেবী। তার মা ১৯৪০-এর দশকে তামিল চলচ্চিত্রে শীর্ষস্থানীয়া অভিনেত্রী ছিলেন। বসুন্ধরা অভিনীত মাঙ্গামা সাবাথাম ১৯৪৩ সালে প্রথম তামিল চলচ্চিত্ররূপে বক্স অফিস হিট করে। শৈশবে তিনি মাকে নাম ধরে ডাকতেন, যখন তার মায়ের বয়স সবেমাত্র ষোলো বছর ছিল। একইভাবে বাবাকে তিনি আন্না নামে ডাকতেন, যার অর্থ বড় ভাই। হিন্দু যৌথ পরিবারে সর্ববয়োঃজ্যেষ্ঠকে আন্না নামে ডাকা হতো। মূলত তিনি মাতুলালয়ে দিদিমা জাদুগিরি দেবীর কাছে ও এম ডি রমনের কাছে বড় হন। 'পাপাকুত্তি' নামে পরিচিত ছিলেন তিনি, যার অর্থ ছোট্ট শিশু। চেন্নাইয়ের চার্চ পার্কের সাক্রেড হার্ট উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন তিনি।
পাঁচ বছর বয়সে ধ্রম্নপদী ভারতীয় নৃত্য পরিবেশনের জন্য মনোনীত হন। ১৯৪০ সালে ভ্যাটিকান সিটিতে দ্বাদশ পোপ পিয়াসের সৌজন্যে অনুষ্ঠিত ওই নৃত্যে তার মা দর্শক হিসেবে উপবিষ্ট ছিলেন। ১৯৫৪ সালে নাগিন চলচ্চিত্রে সফলতা লাভের পর বৈজয়ন্তীমালা নিজেকে বলিউডের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় অভিনেত্রী হিসেবে গড়ে তোলেন। পাশাপাশি তামিল ও তেলেগু চলচ্চিত্রেও সফলতা পান। বাণিজ্যিকধর্মী চলচ্চিত্রে সফলতা লাভের পর দেবদাস চলচ্চিত্রে চন্দ্রমুখীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তার প্রথম নাটকীয় চরিত্রের জন্য ৪র্থ ফিল্মফেয়ার পুরস্কারের প্রথম সেরা সহ-অভিনেত্রী হিসেবে মনোনীত হন। কিন্তু তিনি ওই পুরস্কার নিতে অনীহা প্রকাশ করেন। তার মতে তিনি কোনো সহকারীর ভূমিকায় অভিনয় করেননি। ফলে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। এ ঘটনার পর নিউ দিলিস্ন, নয়া দৌড় ও আশার ন্যায় একগুচ্ছ বস্নকবস্নাস্টার চলচ্চিত্রে অংশগ্রহণ করেন। তন্মধ্যে ১৯৫৮ সালে খ্যাতির তুঙ্গে পৌঁছেন দুটি ছবির মাধ্যমে। সাধনা ও মধুমতী এ দুইটি ছবি ব্যাপকভাবে আলোচনায় স্থান পায় ও বাণিজ্যিকভাবে সফলতা লাভ করে। এ দুটি চলচ্চিত্রই ফিল্মফেয়ার সেরা অভিনেত্রী পুরস্কার বিভাগের জন্য মনোনীত হয়েছিল। তন্মধ্যে প্রথমটি পুরস্কার পায়।
এ সময়েই তিনি তামিল চলচ্চিত্রে ফিরে আসেন। ভঞ্জিকোত্তাই বলিবান, ইরুম্বু থিরাই, ভগবৎ থিরুদান ও থেন নীলাভুর ন্যায় বাণিজ্যিকধর্মী চলচ্চিত্রে সাফল্য লাভ করেন। ১৯৬১ সালে দিলীপ কুমারের গঙ্গা-যমুনায় ভোজপুরী সংলাপ সমালোচকদের কাছে অদ্যাবধি সেরা হিসেবে মনে করে থাকেন। এ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনি তার দ্বিতীয় ফিল্মফেয়ার সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬২ সালের শুরু থেকে অভিনীত চলচ্চিত্রসমূহ গড়পড়তা অথবা দুর্বলমানের ছিল। কিন্তু ১৯৬৪ সালে সঙ্গম চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনি পুনরায় স্বর্ণশিখরে পৌঁছেন। এক আধুনিক ভারতীয় মেয়ে হিসেবে স্বল্পবসন ও সুইমস্যুট পরিধান করে পর্দায় নিজেকে উপস্থাপন করেন। সঙ্গমে রাধা চরিত্রে অনবদ্য অভিনয়ের কারণে ১২শ' ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে সেরা অভিনেত্রীর মর্যাদা লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি আম্রপালির বৈশালীর নাগ্রাবাদুর জীবনীকে ঘিরে রচিত ঐতিহাসিক নাটক আম্রপালির চলচ্চিত্রায়নে অভিনয় করেন। বৈশ্বিকভাবে ব্যাপক সহায়তা পেলেও বক্স অফিসে ব্যর্থ হয় ছবিটি। এর ফলে, বৈজয়ন্তীমালা ব্যাপকভাবে নিরাশ হন ও চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এতে তিনি চলচ্চিত্র জীবনের ইতি ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেন। চলচ্চিত্র জীবনের শেষদিকে তার প্রায় সব চলচ্চিত্রেই বাণিজ্যিকভাবে সফলতা লাভ করেতে দেখা যায়। সুরজ, জুয়েল থিফ ও প্রিন্সের পাশাপাশি হাটে বাজারে ও সংঘর্ষ ছবিও কিছুটা আলোচিত হয়। এ সব চলচ্চিত্রের অধিকাংশই চলচ্চিত্র জীবন ত্যাগ করার পর মুক্তি পেয়েছিল। বৈজয়ন্তীমালার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ১৯৮৪ সালে। ওই বছর তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলের মনোনীত প্রার্থীরূপে তামিলনাড়ু সাধারণ নির্বাচনে দক্ষিণ চেন্নাই সংসদীয় আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তার প্রতিপক্ষ ছিলেন জনতা পার্টির নেতা ও সংসদ সদস্য ইরা সেজিয়ান। নির্বাচনী প্রচারণায় সেজিয়ান প্রধান বক্তব্য রাখতেন, আমাকে লোকসভায় নিয়ে যাও, তাকে আর আর সভায় পাঠাও। তা সত্ত্বেও প্রত্যক্ষ ভোটে বৈজয়ন্তীমালা প্রায় ৪৮,০০০ ভোটের ব্যবধানে তাকে পরাজিত করেন। তিনি সর্বমোট ৩,১৩,৮৪৮ ভোট পান- যা মোট ভোটের ৫১.৯২ শতাংশ ছিল। ফলে, লোকসভায় প্রথমবারের মতো অভিষেক ঘটে তার।
১৯৮৯ সালে অনুষ্ঠিত তামিলনাড়ু সাধারণ নির্বাচনে তিনি পুনরায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এবার তিনি দ্রাবিড়া মুনেত্রা কাঝাগামের আলাদি অরুণার মুখোমুখি হন। তিনি পুনরায় ১২,৫৮৪ ভোটের ব্যবধানে তার প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৩ সালে ভারতীয় সংসদের রাজ্যসভায় তিনি ছয় বছর মেয়াদে মনোনীত হন।
১৯৬৮ সালে চমনলাল বালির সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন বৈজয়ন্তীমালা। বিয়ের পর অভিনয় জীবনের সমাপ্তি ঘটে তার; এরপর চেন্নাইয়ে চলে যান। ঙ্গুচিন্দ্র বালি নামের এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চেন্নাইয়ে পদ্মবিভূষণ পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রবীণ অভিনেত্রী বৈজয়ন্তীমালার সঙ্গে দেখা করেন। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্টও শেয়ার করেছেন। অভিনেত্রীর সংস্কৃতি দুনিয়ায় অবদানকে স্মরণ করেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বৈজয়ন্তীমালা তার ভারতীয় চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় অনবদ্য অবদানের জন্য সারাদেশে প্রশংসিত। শুধু অভিনয় নয়, নৃত্যশিল্পী হিসেবে যে ধারা তিনি তুলে ধরেছিলেন তা সত্যিই চমকে দিয়েছে ভক্তদের বারবার। একজন গুণী শিল্পী হিসেবে তার অবদান আজীবন মনে রাখবে ভক্তরা।