সমাজে বৈষম্য আছে, শিল্পে নয় নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী
প্রকাশ | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
মাতিয়ার রাফায়েল
'আমি ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে কুৎসিতদর্শন অভিনেতা।' নিজের সম্পর্কে নিজেরই এই মূল্যায়ন যার- তিনি এই মুহূর্তে বলিউডের তারকা অভিনেতা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী। অভিনেতা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর অসংখ্য অনুরাগী। যিনি তার অসাধারণ অভিনয় শৈলীর সুবাদে তিনবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কারের মনোনয়ন লাভ করেন এবং দ্য লাঞ্চ বক্স চলচ্চিত্রের জন্য একবার শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব-অভিনেতা বিভাগে এ পুরস্কার অর্জন করেন। এ ছাড়া তিনি একবার করে
শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব-অভিনেতা বিভাগে স্ক্রিন পুরস্কার ও জি
সিনে পুরস্কার লাভ করেন।
এর কারণ হলো গত দু'দশকে বলিউডে শিল্পীদের চেহারার পরিবর্তে অভিনেতার অভিনয় ক্ষমতার ওপর নির্মাতারা বেশি জোর দিচ্ছেন। আর তা না হলে, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী, সুনীল শেঠিদের মতো অভিনেতারা মূলধারার ছবিতে হয়তো জায়গা পেতেন না। সম্প্রতি এ বিষয়ে নিজের মতামত
ব্যক্ত করেছেন 'গ্যাংস অফ
ওয়াসিপুর' খ্যাত অভিনেতা।
অথচ জীবনের শুরু দিকে ধারদেনা করেই চলত তার সংসার। চৌকিদারের কাজও করেছেন। কী দুর্বিষহ কেটেছে
নওয়াজের শুরুর দিনগুলো?
সাক্ষাৎকারে এমন কিছু কথা বলেছেন যা পিলে চমকে দেওয়ার মতো। তিনি নিজেকে একজন নোংরা কদাকার চেহারা এবং কুৎসিত অভিনেতা মনে করেন। অভিনেতার কথায়, আয়নায় নিজেকে দেখে প্রশ্ন করেন কেন
ইন্ডাস্ট্রিতে এলেন! তবে নিজের
সম্পর্কে কেন এমন কথা বললেন অভিনেতা? কেনই বা ইন্ডাস্ট্রির জন্য বারবার নিজেকে আনফিট বলে
মনে হয়েছে তার!
নওয়াজউদ্দিন হিন্দি চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির একজন জনপ্রিয় অভিনেতা। ১৯৯৯ সালে পদার্পণ করে বলিউডে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন। বহু চড়াই-উৎরাই শেষে সাফল্য অর্জন করেছেন এবং এর পুরো কৃতিত্ব তার অভিনয়ের। বহু খারাপ সময় যাওয়ার পর এখন তার জীবনের কষ্টের দিনগুলো কেটে গিয়েছে। তবু পুরনো কথা মনে করে তিনি নিজেকে একজন 'কুৎসিত' অভিনেতা বলে বর্ণনা করেছেন। বৈষম্যের বিষয় প্রকাশ্যে আসতেই তিনি পরিচালকদের ধন্যবাদও জানান।
একটি অনলাইনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী বলেন, 'আমি জানি না কেন কিছু লোক আমাদের মুখকে ঘৃণা করে। কারণ আমাদের চেহারাটাই হয়তো এমন। আমরা সত্যিই খুব কুৎসিত। আমরা যখন আয়নায় নিজেদের দেখি, তখন আমরাও অনুভব করি। আমরাও মনে মনে বলি, 'এমন নোংরা মুখ নিয়ে চলচ্চিত্র জগতে এলেন কেন?'
৫০ বছর বয়সি এ অভিনেতা আরও বলেন, 'আমি শারীরিকভাবে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে কুৎসিত অভিনেতা। এটাই আমি বিশ্বাস করি। কারণ, আমি শুরু থেকেই এসব শুনে আসছি এবং এখন বিশ্বাস করতেও শুরু করেছি। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই।
তিনি বলেন, 'চেহারার দিক থেকে আমি ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে কুৎসিতদর্শন অভিনেতা। শুরু থেকেই প্রচুর কটাক্ষ শুনেছি, তাই এখন মনে মনে সেটা বিশ্বাসও করি।' যদিও দীর্ঘসময় চেহারা নিয়ে কটু কথা শোনার পরও নওয়াজ মনের জোরে বলিউডে অভিনয় চালিয়ে গিয়েছেন। পাশাপাশি আবার এও বলেন, 'আমার মুখ দেখে এমন লাগে, কিন্তু আমি গরিব নই'।
নওয়াজ বলেন, তাদের পরিবারে তেমন কোনো অভাব
ছিল না। স্বেচ্ছায়
তিনি চৌকিদারের কাজ করতেন, কিন্তু তার মুখ
দেখে অনেকেই ভাবতেন
তিনি দরিদ্র পরিবারের ছেলে। নওয়াজ বলেন,
'আমার মুখটা আসলে
এমন! কিন্তু গরিব আমি ছিলাম না।'
পরিবারের থেকে আর্থিক সাহায্য নিতে চাইতেন না বলেই তিনি চৌকিদারের কাজ করতেন বলে জানান নওয়াজ।
নওয়াজউদ্দিন, ১৯৯৯ সালে আমির খানের চলচ্চিত্র 'সারফারোশ'-এ একটি ছোট চরিত্রে অভিনয় করে তার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। তাকে তার প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার জন্য বলিউডকে ধন্যবাদও জানিয়েছেন অভিনেতা। তিনি বলেন, 'ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমি সেসব পরিচালককে ধন্যবাদ জানাতে চাই, যারা আমাকে বিভিন্ন ধরনের চরিত্র দিয়েছেন। আপনার যদি সামান্য প্রতিভা থাকে, তবে ইন্ডাস্ট্রি অনেক
কিছু দেয়। সমাজে বৈষম্য আছে, শিল্পে নয়।'
নওয়াজউদ্দিন অনুরাগ কাশ্যপের 'গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর'-এ ফয়জল খানের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। এবং তার অভিনয় অত্যন্ত প্রশংসিতও হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে অভিনেতা বলেন, গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর মুক্তির পাঁচ মাস পরও যেখানেই যেতাম, লোকে আমাকে বলত, 'স্যার, ছবিটি আমরা ২৫ থেকে ৩০ বার দেখেছি।' আমি ভেবেছিলাম তারা আমাকে নিয়ে মজা করছে। ৩-৪ বছর ধরে আমি বিশ্বাস করেছিলাম যে এসব হয়তো মিথ্যা। আমি ভেবেছিলাম লোকেরা আমাকে নিয়ে মজা করছে এবং আমি তাদের সামনে চলে আসায় মন রাখতে বলছে। অনেক পরে আমি বিশ্বাস করতে শুরু করি যে ছবিটি অনেক বড় জায়গায় গিয়েছে এবং লোকেরা অবশ্যই এটি অনেকবার দেখেছে।
'মুন্নাভাই এমবিবিএস' ছবিতে একটা অপাঙ্ক্তেয় চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, সেখান থেকে 'দ্য লাঞ্চ বক্স' ছবিতে অভিনয় করে জিতে নিলেন
ফিল্মফেয়ার পুরস্কার। কতটা লড়াই ছিল নওয়াজের?
বলিউডের বিগ স্ক্রিনে যাদের দেখা যায়, তাদের জীবনের লড়াইটাও কিন্তু ছবির গল্পের লড়াইয়ের থেকে কম কিছু নয়। প্যাশন আর ডেডিকেশন বুকে নিয়ে লাখ লাখ ভাগ্যান্বেষীদের মধ্য থেকে নিজের যোগ্যতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন বহু অভিনেতা। শাহরুখ খান থেকে হাল আমলে পঙ্কজ ত্রিপাঠী, তাদের জীবনের কঠিন লড়াই অনুসরণযোগ্য। তেমনই একজন গুণী শিল্পী নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী। হিন্দি ছবির জগতে পা রাখার আগে সংসার চালানোর জন্য নানা ধরনের অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ করতে হয়েছে তাকেও। কখনো পাহারাদারের কাজ, কখনো ধনেপাতা বিক্রি- লড়াই তারও কিছু কম ছিল না। অনুরাগ কাশ্যপের ছবি 'গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর'-এ অভিনয় করেই অভিনেতা হিসেবে জনপ্রিয়
হয়ে ওঠেন নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী। তবে এর
আগের ১২টা বছর
কীভাবে কেটেছে তার? কতটা কঠিন ছিল লড়াই?
২০১৯ সালে এক সাক্ষাৎকারে নওয়াজ নিজের জীবনের অনেক ঘটনার কথা তুলে আনেন। 'হিউম্যানস অফ বম্বে'-কে দেওয়া সেই সাক্ষাৎকারে নওয়াজউদ্দিন জানান তার আর্থিক অবস্থা মোটেও তখন খুব একটা ভালো ছিল না। বন্ধুদের থেকে ধারদেনা করতেন প্রায়ই, বলতেন ২ দিনের মধ্যেই মিটিয়ে দেবেন। তারপর দুদিন পরে অন্য আরেকজনের থেকে ধার নিয়ে সেই বন্ধুর ধার মেটাতেন নওয়াজ। আরও চারজনের সঙ্গে একটা ফ্ল্যাটে থাকতেন তিনি। বেঁচে থাকাটাই সেখানে কঠিন লড়াই ছিল। কখনো চৌকিদারের কাজও করেছেন তিনি, কখনো রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ধনেপাতা বিক্রি করেছেন। আবার অভিনয়ের ওয়ার্কশপেও গিয়েছেন তিনি। ১০০টিরও বেশি অডিশন দিয়েছেন নওয়াজ, যখন যেখানে সামান্য কাজ পেতেন করতেন তিনি। কোনো পছন্দের জায়গা ছিল না। নওয়াজ জানান, এভাবেই কেটেছে ১২ বছর। তারপর 'গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর' ছবিতেই ব্রেক পান নওয়াজউদ্দিন।
'মুন্নাভাই এমবিবিএস' ছবিতে একটা অপাঙ্ক্তেয় চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, সেখান থেকে 'লাঞ্চ বক্স' ছবিতে অভিনয় করে জিতে নিলেন ফিল্মফেয়ার পুরস্কার। 'সরফোরাশ' ছবিতে তাকে দেখেও কেউ চিনতে পারেনি। কিন্তু সেই নওয়াজই যখন গণেশ গায়তোন্ডের চরিত্রে অভিনয় করেন, সারা দেশবাসীর কাছে একডাকে পরিচিত হন তিনি। তার নিজের কথায়, 'আমি একজন ওয়াচম্যান থেকে হয়ে উঠেছি ওয়াচ-মি-ম্যান...'।
কী ভাবে এত রকম ধরনের কাজে সমতা রাখেন, তা নিয়েও কথা বলেছেন অভিনেতা। তার কথায়, 'আমি সবসময় সবকিছুকে নিয়ে সমতা বজায় রাখার চেষ্টা করি। কোনো ছবি করার পর সেটি নিজেই ভালো করে খুঁটিয়ে দেখি। ছবিগুলো নিয়ে ভাবি। একটি বড় বাজেটের ছবি করার পর তিন-চারটে ছোট বাজেটের ছবি করি। ছোট বাজেটের ছবিতে
হয়তো বেশি টাকা পাওয়া যায়
না। কিন্তু সমতা রাখা তো দরকার! ক্যারিয়ারের
শুরুর দিকে এভাবেই
আমি ছবি করছি। এখনো তাই করছি।'
তবে শোবিজে এমন ঘটে, যার খ্যাতি আছে তার নামের পাশে কুখ্যাতিও জুড়তে সময় লাগে না। সাংসারিক জীবনে এমনই ঘটনা ঘটে গেছে প্রথম স্ত্রী আলিয়া সিদ্দিকী পান্ডে ওরফে অঞ্জলি কুমারীর সঙ্গে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর। হয়েছে তার সুনীতা, শীবা, নীহারিকা, সুজানসহ আরও অনেক নারীসঙ্গ।
সম্প্রতি, ওটিটিতে মুক্তি পেয়েছে নওয়াজ অভিনীত 'রাউতু কা রাজ' ছবিটি। এ ছাড়া বেশকিছু নতুন ছবির শুটিংয়ে ব্যস্ত রয়েছেন অভিনেতা।