অনন্যময়ী রিচির পর্দায় ফেরা
প্রকাশ | ১৫ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
মাতিয়ার রাফায়েল
বাংলাদেশের ছোটপর্দার এক সময়ের দারুণ জনপ্রিয় অভিনেত্রী রিচি সোলায়মান। অভিনয়, সৌন্দর্য ও বাচনভঙ্গি- সব মিলিয়েই তিনি অনন্যা। একটা সময় প্রচুর নাটক করেছেন। তার অভিনীত অসংখ্য নাটক দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। দেশের শোবিজ অঙ্গনে রিচি সোলায়মান একজন নজরকাড়া নন্দিত শিল্পী। দর্শকের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে অপরিসীম। কিন্তু এই দর্শকের কাছে অপরিসীম চাহিদা থাকা সত্ত্বেও এক সময়ে স্বেচ্ছায় টিভি পর্দায় তাকে অনিয়মিত হয়ে যেতে হয়।
দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী বাসিন্দা অভিনেত্রী রিচি সোলায়মান। সংসার-সন্তান নিয়েই তার ব্যস্ততা। তবে মাঝে মধ্যে দেশে ফেরা হয় তার। পরিবার, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে যান। সেই সঙ্গে ঢুঁ মারেন শোবিজ পাড়ায়, হাজিরা দিয়ে যান দর্শকের কাছে। তবে এখন ঢাকায় অনেকদিন ধরে বসবাস করলেও এটাও অনেকেই জানেন না।
ফলে নারীর সনাতন জীবনচক্রে যা হয় সেটাকেই জীবনের বাস্তবতা হিসেবে মেনে নিয়ে সুদূর আমেরিকায় পারি জমানো রিচি আজ এ দেশের নাট্যজগতে ঈদের চাঁদ বললেও চলে। এভাবেই ব্যস্ত নায়িকাদের অন্যতম এ নায়িকার হঠাৎ করেই যেন অভিনয় থেকে এক প্রকার বিরতিতেই যাওয়া হয়ে যায়। এভাবেই কেটে গেছে দীর্ঘ ৮ বছর। এ সময়ের মধ্যে তাকে আর নাটকে তেমন একটা অভিনয় করতে দেখা যায়নি। অবশেষে দীর্ঘ ৮ বছর পর আবারও অভিনয়ে ফিরছেন তিনি।
ওয়েবফিল্ম 'গিরগিটি' নিয়ে দীর্ঘ বিরতি ঘোচালেন লাস্যময়ী এই অভিনেত্রী। সম্প্রতি শুটিং করেছেন কলকাতায়।
২০০৮ সালের ২৮ ফেব্রম্নয়ারিতে বিয়ে করা রিচি সোলায়মান সেখানেই পেতেছেন তার চৌদ্দ বছরের সুখের সংসার। মাঝে-মাঝে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে বাংলাদেশে আসেন। সেই ফাঁকে কোনো নাটকে যে অভিনয় করবেন তারও সুযোগ হচ্ছিল না।
অথচ একটা সময় টেলিভিশন নাটকের জননন্দিত অভিনেত্রী রিচি। বহু নাটকে অভিনয় করে তিনি দর্শকের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। স্বামী রাশেক মালিক বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক পুলিশের ডিটেক্টিভ। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে রিচি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই বসবাস করছিলেন। তবে কয়েক বছর ধরে রিচি ঢাকায় অবস্থান করছেন দুই সন্তানকে বাংলাদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে বিকশিত করে তোলার জন্য। এরই মধ্যে টুকটাক নাটকে কাজও করেছেন তিনি। এবার তাকে দেখা যাবে একটি ওয়েব ফিল্মে। এর শুটিং শেষ করেছেন রিচি।
এ বিষয়ে রিচি সোলায়মান বলেন, '৮ বছর অভিনয় থেকে দূরে ছিলাম। তার মূল কারণ হচ্ছে আমার দুই সন্তান। ওদের সময় দিয়েছি। ওদের বড় করেছি। সন্তানদের প্রাধান্য আমার কাছে আগে ছিল।'
'তবে এখন আমার দুই সন্তান নিজেদের পড়ালেখা নিজেরা করতে পারে। ওদের পড়াশোনার জন্য চাপ কিংবা বলে দিতে হয় না। এটা আমার বড় প্রাপ্তি। এজন্যই এত বছর পর অভিনয়ে ফিরলাম,' বলেন রিচি।
এই দীর্ঘদিন পর অভিনয়ে ফিরে কেমন লাগছে জানতে চাইলে রিচি বলেন, 'ভীষণ ভালো লাগছে। ফেরার আনন্দটা সত্যিই অন্যরকম, বলে বোঝানো যাবে না। অনেক খুশি আমি। দর্শকদের সামনে আসছি এটা অনেক আনন্দের।'
'সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যদি নতুন করে কাজে ফিরি তাহলে ভালো কোনো কিছু দিয়ে ফিরব। সেভাবেই ফিরেছি। তিন মাসে হয়ত একটি কাজ করব। আমি মনে করি, ভালো কাজ একজন শিল্পীকে অনেকদিন বাঁচিয়ে রাখে। ভালো কাজ করতে চাই। সংখ্যায় কম হোক,' বলেন তিনি।
নতুন ওয়েব ফিল্মে অভিনয় করার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, 'এই ওয়েব ফিল্মটি নারী প্রধান গল্পের। সেজন্য কাজটি পছন্দ হয়েছে। সেভাবেই অভিনয় করেছি। দুজন মেয়েকে নিয়ে গল্প এগিয়ে যাবে।'
দীর্ঘ অভিনয় ক্যারিয়ারে এবারই প্রথম পুলিশ অফিসারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন রিচি। তিনি বলেন, '৩-৪ মাস প্রস্তুতি নিয়েছি পুলিশ অফিসার শোভনা চরিত্রটির জন্য। যিনি মূলত একটি খুনের রহস্যের উদ্ঘাটন করেন। অনেক ভেবেছি। পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে কথাও বলেছি। কিছু কাজ দেখেছি। অনেক রকম প্রস্তুতি নিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছি।'
এই দীর্ঘ আট বছরে দর্শকদের কতটা মিস করেছেন জানতে চাইলে রিচি বলেন, 'মিস তো অনেক করেছি। দর্শকরাও আমাকে মিস করেছেন। হাজার হাজার মানুষ আমাকে প্রশ্ন করেছেন কবে ফিরব অভিনয়ে? আমার ছেলে বলেছে, মা, তুমি আবার রিচি সোলায়মান হয়ে যাও। তারপর আশিক ভাই অভিনয়ে ফেরার কথা বলেছেন। আমি সবাইকে বলেছি, ফেরার মতো কাজ কিছু পেলে ফিরব।'
গিরগিটি ওয়েব ফিল্মের জন্য কলকাতায় ৮ থেকে ১০ দিন শুটিং করেছেন। পুরো শুটিং শেষ করেই দেশে ফিরেছেন। ওখানকার কাজের পরিবেশ সম্পর্কে রিচি বলেন, 'ওরা খুব প্রফেশনাল। পেশাদারিত্বটা ভালো লেগেছে।'
সাত্যকি তরফদারের রচনায় ও কলকাতার বিজয়া জানার পরিচালনায় ওয়েব ফিল্ম 'গিরগিটি'তে অভিনয় করেছেন রিচি। প্রথমবার ওয়েব ফিল্মে অভিনয় করা প্রসঙ্গে রিচি বলেন, 'আমেরিকায় একটি অনুষ্ঠানে আরটিভির আশিক ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়। আশিক ভাই আমাকে কাজের কথা বললে আমি এটা বলি যে, আমি আমার মনের মতো গল্প, চরিত্র না পেলে কাজ করব না।
এ ওয়েব ফিল্মে যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে রিচি বলেন, 'আরটিভির আশিক ভাইয়ের পরিকল্পনাতেই গিরগিটিতে যুক্ত হওয়া। অনেকের মতো তিনিও জানতেন না কয়েক বছর ধরে আমি ঢাকায় থাকি। যুক্তরাষ্ট্রের একটি অনুষ্ঠানে আশিক ভাই আমাকে গল্প শোনান। গল্প ভালো লাগার কারণেই কাজটির সঙ্গে যুক্ত হওয়া।'
সিনেমাটির অগ্রগতি সম্পর্কে রিচি বলেন, 'গিরগিটি একটি নারীপ্রধান গল্পের সিনেমা। আমাদের দেশে মেয়েদের প্রাধান্য দিয়ে গল্প কম হয়। এ নিয়ে আমাদের শিল্পীদেরও মন খারাপ থাকে। সেদিক থেকে গিরগিটি একটি অন্যরকম কাজ। পুরো কাজটাই কলকাতায় হয়েছে, শতভাগ পেশাদারি দায়িত্বে থেকে কাজটি করেছেন সবাই। আমার বিশ্বাস, কাজটি দর্শকের মন ভরিয়ে দেবে।'
বিদেশ ছেড়ে আপাতত দেশে থাকা নিয়ে তিনি বলেন, 'আমার দুই সন্তানকে দেশে রেখে এখানে পড়াশোনা করানো এবং দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে একটু একটু করে ধারণা দিয়ে তাদের তৈরি করার চেষ্টাটার কারণই হলো বাংলাদেশি মূল্যবোধটা তাদের মধ্যে জাগ্রত করা।'
বেঙ্গল মাল্টিমিডিয়া লিমিটেডের প্রযোজনায় গিরগিটি ওয়েব ফিল্মটি শিগগিরই বিশেষ কোনো দিবসে 'আরটিভি পস্নাস'-এ প্রচার হবে।
দর্শকপ্রিয় এই অভিনয়শিল্পী বলেন, 'জনপ্রিয়তা, মানুষের ভালোবাসা, এসব সৃষ্টিকর্তার দান। মানুষের ভালোবাসা সত্যিই বড় বিষয়। এটাকে আমি সম্মান করি।'
অভিনয়ের জন্য শুধু স্কিপ্ট দেখে কীভাবে বুঝবেন কোন ধারার নাটক করছেন, এমন কথায় রিচি সোলায়মান বলেন, 'আমি তো পান্ডুলিপি দেখে প্রথমে হোম ওয়ার্ক করব তারপরে অভিনয় করব। নাটকের চলমান ধারা তো দেখার দরকার নেই। এটা ঠিক, কোনো স্ক্রিপ্ট রাইটার আমাকে স্ক্রিপ্ট দেন না। নির্মাতাই স্ক্রিপ্ট দেন। সেক্ষেত্রে আমার কাছে নির্মাতাই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, একজন নির্মাতা দুর্বল পান্ডুলিপিকেও ঘষেমেজে সেটাকে ভালো নাটক বা সিনেমা হিসেবে উপস্থাপন করতে পারেন। আবার ভালো পান্ডুলিপি হওয়া সত্ত্বেও অনেকে সেটা নিয়ে ভালো কিছু করতে পারেন না। সেদিক থেকে আমার কাছে নির্মাতাই গুরুত্বপূর্ণ।'
নাটকে নিয়মিত হবেন কিনা এমন কথায় রিচি বলেন, 'আমি কখনোই অভিনয়ে নিয়মিত হতে চেষ্টা করিনি। যখন নিয়মিত কাজ করেছি প্রচুর নাটক করেছি। এরপর আমার ঘরসংসার হয়েছে, তখন তো আমাকে এটাকেই প্রাইয়রিটি দিতে হবে- তাই না! আসলে হয়েছে কি, মানুষের- বিশেষ করে মেয়েদের জীবনে একেক সময়ে একেকটি প্রাইয়রিটি আসে। এক সময়ে তো শুটিংয়ের জন্য বহু জায়গায় ছুটাছুটি করেছি। তারপরে চলে গেলাম আমেরিকায়। দুটো সন্তান হলো- সংসার দেখাশোনার কাজ বাড়লো, এখন তো আমার এইগুলোই প্রাইয়রিটি। আর আমি তো আমার ক্যারিয়ার করেছিই। আবার অনেকে আছেন বলতে পারেন, 'আমি অনেক কষ্ট করে আমার ক্যারিয়ার করেছি আমি কেন এটা হুট করে ছেড়ে দেব!' এটাও কিন্তু খারাপ না। আমি তাদের সিদ্ধান্তকেও রেসপেক্ট করি। এটা একেবারেই যার যার ব্যক্তিগত অভিমত।
উলেস্নখ্য, রিচি সোলায়মান নব্বই দশক থেকে একাধারে বিজ্ঞাপন ও নাটকে অভিনয় করে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। দেড় শতাধিক খন্ড এবং ৪০টির বেশি ধারাবাহিক নাটকে কাজ করেছেন তিনি। ২০১৯ সালের দিকে সিনেমা প্রযোজনার ঘোষণা দিয়েছিলেন রিচি। তবে সেই উদ্যোগের আর অগ্রগতি দেখা যায়নি।